যাকাত’র আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ: যাকাত শব্দটি আরবি এর অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা অর্জন হওয়া, অর্থগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সুস্পষ্ট। যাকাত দানে ধন সম্পদ বৃদ্ধি ও পবিত্র হয়। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত হলো আল্লাহর উদ্দ্যেশে শরীয়তের নির্ধারিত বিধানানুযায়ী নিজের মালের একাংশের স্বত্বাধিকার কোন অভাবগ্রস্ত লোকের প্রতি অর্পণ করা, অসহায় গরীব মিসকীনকে বিনিময় ছাড়াই মালিক বানিয়ে দেয়ার নাম হলো যাকাত। (আলমগীরি, খন্ড:১, পৃ: ১৭০, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫ম, পৃ:২৭), এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো অভাবী ব্যক্তি সৈয়্যদ বংশীয় লোক হতে পারবেনা। সৈয়্যদ বংশীয়দের যাকাত দেয়া জায়েজ নেই। অনুরূপ অমুসলিমকে যাকাত দেয়া জায়েজ নেই।
আল কুরআনের আলোকে যাকাত বন্টনের খাত সমূহ: যাকাতের খাত সমূহ মহান আল্লাহ কর্তৃক পবিত্র কুরআনে নির্ধারিত, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যাকাত তো কেবল অভাবগ্রস্ত নিঃস্ব ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের অন্তর সমূহকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য, এটিই আল্লাহর বিধান, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা: তাওবা, ৯, আয়াত: ৬০)
আট খাতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: ১. ফকীর: ফকীর এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কাছে কিছু আছে কিন্তু তা নেসাব পরিমাণ নয়। ২. মিসকীন বলা হয় যার কাছে কিছুই নেই, এমনকি খাবার ও শরীর আবৃত করার পোশাকের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫ম, পৃ: ৭৯) ৩. আমেল: (যাকাত উসুলকারী) যাকাত সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে, তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে এ খাত থেকে দেয়া যাবে। যাকাত উশুলকারী যদিও সম্পদশালী হয় স্বীয় কাজের বিনিময় নিতে পারবে। ৪. মুআল্লাফাতুল কুলুব, অমুসলিমদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা এবং দুর্বল চিত্ত মুসলমানদেরকে ইসলামের উপর অটল অবিচল থাকার জন্য আর্থিক সাহায্য দ্বারা চিত্ত রঞ্চন করা। এ জন্য তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা করা যেতে পারে যেন পরিবার পরিজন ও আত্নীয় স্বজনের বাধা বিপত্তির মুখে ইসলামের উপর টিকে থাকতে পারে। ৫. মুক্তিপণের শর্তযুক্ত ক্রীতদাসকে মালের বিনিময়ে মুক্তিপন আদায় করে তাকে মুক্ত করে নেওয়ার জন্য যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে। ৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে “গারেম” দ্বারা ঐ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যার কাছে তার ঋণ পরিশোধ করার মত সম্পদ নেই অথবা সম্পদ আছে কিন্তু ঋণ পরিশোধ করার পর যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকবেনা এ ক্ষেত্রে যাকাতের অর্থ দিয়ে তাকে ঋণ পরিশোধে সহায়তা করা যাবে। (রদ্দুল মুহতার কিতাবুয যাকাত) ৭. “ফী সাবিলিল্লাহি” অর্থাৎ আল্লাহর পথে ব্যয় করা, এর কয়েকটি দিক রয়েছে যেমন কোন ব্যক্তি ইসলামী জিহাদে গমনে ইচ্ছুক তার বাহন ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের জন্য যাকাতের মাল দেয়া যাবে। কেউ যদি উপার্জনে অক্ষম হয় তাকে যাকাত দেয়া যাবে, তা আল্লাহর রাস্তায় দান হিসেবে গন্য হবে। কোনো বান্দা যদি হজ্বে যেতে ইচ্ছুক কিন্তু তার নিকট আর্থিক সামর্থ নেই তাকে যাকাত দেয়া যাবে, তবে হজ্বে গমনের জন্য মানুষের নিকট থেকে সাহায্য প্রার্থনা করা জায়েজ নেই। প্রত্যেক ভালকাজে যাকাত দান করাটা আল্লাহর রাস্তায় বুঝাবে। যদি মালিকানা স্বত্ব দান করা বুঝায়। মালিকানা স্বত্ব প্রদান ছাড়া যাকাত আদায় হবেনা। (দুরুল মুহতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫, পৃ: ৮১)
৮. অষ্টম খাত হলো “ইবনুস সাবীল” এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এমন মুসাফির বা পথিক যে সফরের মধ্যে অর্থ সম্পদহীন হয়ে পড়ে। স্বদেশে তার অর্থ সম্পদ থাকলেও এখন তার সঙ্গে নেই বিধায় বর্তমানে সে নিঃস্ব ও রিক্ত হস্ত, এমন ব্যক্তিকে যাকাতের খাত থেকে এ পরিমান অর্থ প্রদান করা যাবে যাতে তার সফরের প্রয়োজন সমাধা করে নিজ গন্তব্যে যেতে পারে, তবে এ অবস্থায় উত্তম হলো কারো নিকট কর্জ পাওয়া গেলে কর্জ নিয়ে কাজ সমাধা করে নিবে। (আলমগীরি, দুরুল মুখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫, পৃ: ৮১)
যাকাত অস্বীকারকারী কাফির: যাকাত ফরজ। অস্বীকারকারী কাফির। যাকাত অনাদায়কারী ফাসিক। হত্যার যোগ্য। আদায়ে বিলম্বকারী গুনাহগার ও সাক্ষ্যের অনুপযোগী। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫, পৃ: ২৭)
কী পরিমাণ সম্পদে যাকাত ফরজ: প্রয়োজনীয় সব খরচ বাদ দিয়ে কারো নিকট যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য ৬১৩ গ্রাম। অথবা সাড়ে সাত তোলা (ভরি) বা ৮৮ গ্রাম স্বর্ণ অথবা সমপরিমাণ মূল্যের মালামাল বা নগদ অর্থ এক বছর জমা থাকে তার উপর যাকাত ফরজ। এটাকে যাকাতের নিসাব বলা হয়। (দুরুল মোখতার, রদ্দুল মুহতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫, পৃ: ৫৬)
বছরের শুরুতে এবং বছরের শেষে নিসাব পূর্ণ ছিল কিন্তু মাঝখানে নিসাব কমে গেল এ কম হওয়াটা প্রভাব ফেলবে না। যাকাত ওয়াজিব হবে। (আলমগীরি) সকল নগদ অর্থ রৌপ্যের নিসাবের সমমূল্য হলে চল্লিশভাগের এক ভাগ যাকাত আদায় করা ওয়াজিব। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড)
আল কুরআনে যাকাত অনাদায়ীদের প্রতি কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি: আল কুরআনের অসংখ্য আয়াত দ্বারা যাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত। যাকাতের বিধান অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে। এবং তা দ্বারা তাদের ললাট পার্শ্বদেশে দাগ দেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে এটিই ঐ বস্তু যা তোমরা পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করতে তা আস্বাদন কর। (সূরা, তাওবা, ৯:৩৪–৩৫)
হাদীস শরীফের আলোকে যাকাত অনাদায়ীর শাস্তি: হাদীস শরীফে যাকাত অনাদায়ীদের ভয়াবহ পরিণতি ও কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যাকে আল্লাহ তা’আলা ধন সম্পদ দান করেছেন, আর সে তার যাকাত প্রদান করেনি কিয়ামতের দিন তার সম্পদ টেকো মাথা বিশিষ্ট সাপের আকৃতি দেয়া হবে যার চক্ষুর উপর দুটি কালো বিন্দু থাকবে। কিয়ামতের দিন তাকে তার গলায় বেড়ী স্বরূপ করা হবে। অত:পর সাপ তার মুখের দুদিকে কামড় ধরবে, তারপর বলবে আমি তোমার সম্পদ আমি তোমার সঞ্চিত ধন। (বুখারী শরীফ, খন্ড:১, পৃ: ১৮৮)
তিন ব্যক্তি সর্বপ্রথম জাহান্নামে প্রবেশ করবে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে। ১. জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী শাসক, ২. ধনাঢ্য ব্যক্তি যে স্বীয় সম্পদ থেকে আল্লাহর হক যাকাত আদায় করেনা, ৩. অহংকারী দরিদ্র লোক। (মুসনাদে আহমদ, খন্ড: ২, পৃ: ৪৭৯)
যাকাতের মাল অন্য মালের সাথে মিশ্রিত করা নিষেধ: যাকাতের মাল যখন অন্য মালের সাথে মিশ্রিত হয় তখন এটা ঐ মালকে ধ্বংস করে দেয়। (মিশকাত: ১৭৯৩)
বিদায় হজ্বের ভাষণে যাকাতের ওপর গুরুত্বারোপ: বিদায় হজ্বের ভাষণ ছিলো মুসলিম উম্মাহর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত বিশ্ব মুসলিম জাতির মুক্তির দিক দর্শন। ঐতিহাসিক ভাষণে এরশাদ হয়েছে, “হযরত সুলাইম ইবন আমির (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আবু উসামা (রা.) কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিদায় হজ্বের ভাষণে বলতে শুনেছি, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহকে ভয় কর, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কায়েম কর, রমজান মাসে সিয়াম পালন কর, তোমাদের সম্পদের যাকাত প্রদান কর ও তোমাদের নেতৃবর্গের অনুসরণ কর, আর তোমাদের প্রভূর জান্নাতে প্রবেশ কর। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ৬১১)
যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না: নিজের মূল যেমন পিতা–মাতা, দাদা–দাদী, নানা–নানী, নিজের আওলাদ পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনী, দৌহিত্র, দৌহিত্রী প্রমুখকে যাকাত দেয়া যাবে না, অনুরূপ ওদেরকে সাদকা ফিতরা নজর কাফফারা দেয়া যাবে না। তবে নফল সাদকা দেয়া যাবে। বরং দেয়াটা উত্তম। (আলমগীরি, রদ্দুল মুহতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫, পৃ: ৮৩)
মাসআলা: স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে যাকাত দিতে পারবে না। পুত্র বধূ, জামাতা, সৎ মা, সৎ পিতা (মায়ের পূর্বের স্বামী) স্ত্রীর পূর্বের ঘরে সন্তান বা স্বামীর পূর্বের ঘরের সন্তানকে যাকাত দেয়া যাবে। (রদ্দুল মোহতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫ম, পৃ: ৮৩)
যাকাত দানে অগ্রাধিকার দেয়া: উত্তম হলো প্রথমে নিজ ভাইদের, বোনদের, অত:পর ওদের সন্তানদের অত:পর চাচা ও ফুফুদের অত:পর ওদের সন্তান সন্ততিদেরকে অত:পর মামা ও খালুদেরকে তারপর ওদের সন্তান সন্ততিদেরকে অত:পর রক্ত সম্পর্কীয় আত্নীয় স্বজনদেরকে অত:পর প্রতিবেশীদেরকে যাকাত দেয়া উত্তম। (জাওহেরা, আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫, পৃ: ৮৮)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে যাকাতের বিধান অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ মুসলিহ উদ্দিন
গাছবাড়ীয়া, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: সাদকাতুল ফিতরার গুরুত্ব ও এর পারিমাণ সম্পর্কে সংক্ষেপে জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: সাদকাতুল ফিতর সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদকাতুল ফিতর রোজাকে অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন কথা হতে পবিত্র করার জন্য এবং নিঃস্বদের মুখে খাবার দেয়ার জন্য নির্ধারণ করেছেন। (আবু দাউদ), রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, বান্দার রোজা আসমান ও জমীনের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে যতক্ষণ সাদকাতুল ফিতর আদায় না করে। (দায়লামী, মুসনাদুল ফেরদৌস), সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। ঈদের নামাযের পূর্বে আদায় করা সুন্নাত। (দুরুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫ম, পৃ: ৯০), সাদকায়ে ফিতর এর ক্ষেত্রে গম বা গমের আটা, গমের চেয়ে গমের আটা দেয়া উত্তম। (দুরুল মুখতার ও রদ্দুল মুখতার), গম বা গমের আটা দ্বারা আদায় করলে অর্ধ সা বা ১ কেজি ৬শ ৫০ গ্রাম এর প্রচলিত বাজার মূল্য ৬৫ টা হিসেবে ১১০/- আদায় করতে হবে। শরীয়া অনুযায়ী আটা “যব” কিসমিস খেজুর ও পনির ইত্যাদি পাঁচটি পণ্যের যেকোন একটি দ্বারা ফিতরা আদায় করা যাবে। প্রতিটির ক্ষেত্রে হিসাবের ভিন্নতা রয়েছে।