রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুমহান চরিত্রের অধিকারী
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে তাঁর প্রিয় হাবীব অনুপম সৃষ্টির অসাধারণ পথ প্রদর্শক, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জীবনাদর্শ অনুসরণ করুন। তাঁর উত্তম আখলাক ও সুুন্দর চরিত্রের সুনাম–সুখ্যাতি কেবল আজকের যুগে নয় অজ্ঞতা ও বর্বর যুগের মানুষগুলোও যাঁর সততা সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতার কথাগুলো অকপটে স্বীকার করতো এমনকি মক্কার লোকেরা তাদের দামি দামি স্বর্ণালংকার দিনার–দিরহাম ও মূল্যবান জিনিসগুলো তাঁর কাছে আমানত রেখে নিশ্চিত থাকতো। আরবের অহংকারী মানুষগুলো যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারতনা তারাই তাঁকে আল আমীন (পরম বিশ্বস্ত) আস–সাদিক (সত্যবাদী) উপাধিতে ভূষিত করেছিল, কুফর ও শির্কের অসভ্য সমাজে বাস করেও কোনো ধরনের অন্যায় বা ত্রুটি বিচ্যূতির কালো দাগ নিজের চরিত্রে লাগতে দেননি। যাঁর মুখ থেকে কেউ কখনো কোনো অশোভন বা মন্দ কথা শোনেনি, উত্তম গুণাবলী ও সচ্চরিত্রের দ্বারা সবার হৃদয়রাজ্য জয় করে নিয়েছিলেন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে তাঁর সুমহান চরিত্র:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সামগ্রিক জীবনে নিজেকে উত্তম আখলাকের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর চরিত্র কে “আযীম” আখ্যা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।” (সূরা: কলাম, ৬৪ আয়াত:৪)
আল্লাহ তা’আলা বিশ্ববাসীকে সেই সুন্দরতম আদর্শ ও চরিত্র অনুসরণ করার গুরুত্বারোপ করেছেন। এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ। (সূরা: আহযাব, ৩৩ আয়াত:২১)
আরবের সত্য সন্ধানী মানুষগুলো “উসওয়াতুন হাসানা” উত্তম আদর্শের সংস্পর্শে ও পরশে এসে নিজেদের জীবনের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিলেন। নবীজির জীবন্ত আদর্শ বুকে ধারণ করে নিজেদেরকে সোনার মানুষের কাফেলায় শামিল করার সৌভাগ্য অর্জন করলেন। এই নূরানী কাফেলায় একে একে অন্তর্ভূক্ত হলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.), হযরত উসমান ইবনু আফফান জিন্নুরাইন (রা.), হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম প্রমূখ সাহাবায়ে কেরাম।
আলে কুরআনই রাসূলুল্লাহর সুমহান চরিত্র, সততা, সত্যবাদিতা, অঙ্গীকার পূরণ, আমানতদারিতা ও বিশ্বস্ততা, উদারতা, মানবিকতা, সহনশীলতা, বিনয়, ধৈর্য্য, ক্ষমা ও দানশীলতা ইত্যাদি অনুপম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের জন্য পবিত্র কুরআনে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। সাহাবায়ে কেরাম উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা সিদ্দিকাকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করলেন নবীজির চরিত্র কেমন ছিল? মা আয়েশা (রা.) বললেন কেন তোমরা কুরআন পড়নি? কুরআনই তো নবীজির চরিত্র। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত সাঈদ ইবন হিশাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর নিকট উপস্থিত হলাম আমি জিজ্ঞেস করলাম আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র চরিত্র সম্পর্কে বলুন, তিনি বলেন, আল কুরআনই হলো তাঁর চরিত্র। (ইমাম মুসলিম, হাদীস: ৭৪৬)
সকল নবীদের চারিত্রিক গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল মহানবীর পবিত্র জীবনে:
আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (আ.) হতে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত পৃথিবীতে মানবজাতির হেদায়তের জন্য অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছিলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হিসেবে বিশ্বমানবতার অগ্রদূত, বিশ্বশান্তির মূর্ত প্রতীক, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ প্রেরণ করে তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের অভিধায় ভূষিত করেছেন, সকল নবীগনের সুমহান গুণাবলী এককভাবে তাঁর পবিত্র সত্তায় তাঁর পুত:পবিত্র চরিত্রে সমাবেশ ঘটিয়ে তাঁকে পূর্ণতার শীর্ষে আরোহন করিয়েছেন। সকল নবীগণের সুন্দর চরিত্র ও গুণাবলীর অভূতপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে, যেমন আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.)’র মহত্ব, হযরত নুহ (আ.)’র চেষ্টা প্রচেষ্ঠা সাধনা, হযরত ইবরাহীম (আ.)’র একত্ববাদ, শির্কমুক্ত তাওহীদ প্রতিষ্ঠা, হযরত ইসমাঈল (আ.)’র আত্মত্যাগ ও কুরবানী হযরত ইউসূফ (আ.)’র সৌন্দর্য, হযরত ইয়াকুব (আ.)’র ধৈর্য, হযরত দাউদ (আ.)’র সাহসিকতা, হযরত সোলাইমান (আ.)’র ঐশ্বর্য, হযরত ইয়াহিয়া (আ.)’র সরলতা, হযরত ইউনূস (আ.)’র অনুশোচনা, হযরত ঈসা (আ.)’র অমায়িকতা ইত্যাদি। জীবনের বিশাল বিচিত্র মুক্ত প্রাঙ্গণে ইসলামী দর্শনকে জানার জন্য মহানবীর সুমহান চরিত্র সমগ্র মানব মন্ডলীর মানবতার এক চূড়ান্ত উত্তরণ। তাঁর সুমহান আদর্শ ও চরিত্র সমগ্র মানবজাতির জন্য মানব জাতির ইতিহাসে তিনি এক নিখুঁত অতুলনীয় পবিত্র সত্বা। তাঁর চরিত্রে উদ্ভাসিত বহুমাত্রিক গুণাবলী, তিনি বিশ্বসমাজের ত্রাণকারী, বিচারাসনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মহাবিচারক, মহানবী ক্ষমা ও করুণার মূর্তপ্রতীক, বিশ্ব ভাতৃত্ব ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অসাধারণ চরিত্রের ধারক মহান নবী, জড়জগৎ, উদ্ভিদ জগৎ, প্রাণীজগৎ থেকে মনুষ্য জগতের প্রতিটি পরতে পরতে এক অনুস্মরণীয় সত্তা, দূর্গত মানবতার কল্যাণে ভালোবাসার পরম আদর্শ। জাতিগত বর্ণগত শ্রেণিগত ভেদাভেদ নির্মূলে আদর্শ জীবনধারার মহান স্থপতি। অশিক্ষা কুশিক্ষা ও নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে সুশিক্ষিত আদর্শ জাতিগঠন ও সভ্যতার বিনির্মাণে উজ্জ্বলতম আদর্শ স্থাপনকারী, অন্যায় অসত্য জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে আপসহীন একনিষ্ট জিহাদ পরিচালনাকারী, যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মুক্তিকামী সত্যান্বেষী মানুষের কল্যাণে ছিল উৎসর্গীত। যাঁর চরিত্র ছিল পুত:পবিত্র। হযরত হাসসান ইবন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ওহে প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনাকে প্রত্যেক দোষত্রুটি থেকে মুক্ত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। আপনাকে যেন আপনি যে রকম চেয়েছেন সেইরূপ সৃষ্টি করা হয়েছে।
ধৈর্য ও ক্ষমা প্রদর্শনে মহানবী:
আরবের কাফির মুশরিকরা রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, নবীজি জীবনে কাউকে কটু বাক্য বলেননি কাউকে আঘাত করেননি কারো ক্ষতির চিন্তাও করেননি ওহুদের ময়দানে তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ করেছেন তায়েফের ছোট ছোট বালকরা তাকে বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপ করেছে, নবীজির দেহ মুবারক জামা মুবারক রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, তিনি তো আল্লাহর পেয়ারা নবী আল্লাহর প্রদত্ত শক্তিতে শক্তিমান। ফেরেস্তারা তাঁর সাহায্যের জন্য সার্বক্ষনিক প্রস্তুত, কাফিরদের চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার অনুমতি চাইলেন, তিনি অনুমতি দেননি, বদদুআ করেননি, তাঁদের হেদায়তের জন্য দুআ করেছেন। হে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজির খিদমতে আরজ করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি মুশরিকদের বদদোয়া করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমাকে লানত (অভিসম্পাতকারী) কারী হিসেবে প্রেরণ করা হয়নি, আমাকে রহমতরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। (ইমাম মুসলিম, হাদীস: ৬৬১৩)
আল্লাহ তা’আলা নবীজি কর্তৃক বিনয় ও ক্ষমা কোমলতা প্রদর্শনের উত্তম গুণের প্রশংসা করেছেন, এরশাদ করেছেন, আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি নম্র ছিলেন, যদি আপনি কঠোর স্বভাব এবং কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে আপনার নিকট থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন সুতরাং আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাঁদের জন্য ইস্তিগফার করুন অর্থ্যাৎ সুপারিশ করুন।
নবীজির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বজনীন:
নবীজি কেবল মুসলমানদের নবী ছিলেন না। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের নবী হিসেবে ও আল্লাহর রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে (প্রিয় নবী) আপনি বলুন, হে মানব মন্ডলী, আমি তোমাদের সকলের জন্যই আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। (সূরা: আরাফ, আয়াত: ১৫৮)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, আমি আপনাকে বিশ্ব জগতের করুণা স্বরূপ ব্যতীত প্রেরণ করিনি। (সূরা: আম্বিয়া, ২১: আয়াত:১০৭)
একটি রাষ্ট্রে সকল ধর্মের লোকেরই বসবাস, সকলের মাঝে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরী করা, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা, মানবিকতার পরিচয়। নবীজি এরশাদ করেছেন, হযরত জাবীর ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা সেই ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন না যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করেনা। (মিশকাত শরীফ)
সমগ্র সৃষ্টির প্রতি সদ্ব্যবহার করা নবীজির চরিত্র:
ধর্মীয় বিদ্বেষের কারনে সমাজে ও রাষ্ট্রে অশান্তি সৃষ্টি করা, ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করা, ভিন্ন ধর্মের লোকদের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ চরিতার্থ করা, ভিন্ন ধর্মের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করা, তাদের প্রাণ হানি ও সম্পদ বিনষ্ট করা, ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সকল জাতির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা, মহানবীর আদর্শ। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) ও হযরত আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সমস্ত সৃষ্টি জগত আল্লাহর পরিবার স্বরূপ সুতরাং সৃষ্টি জগতের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় যে আল্লাহর পরিবারের সাথে সদ্ব্যবহার করে। (মিশকাত শরীফ)
আমানতদারিতা ও বিশ্বস্ততা:
আমানতদারিতা ও বিশ্বস্ততা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র চারিত্রিক গুণাবলীর উত্তম নিদর্শন। আমানতদারিতা মু’মীনের জীবনকে মহিমান্বিত করে, বিশ্বস্ততা নৈতিকতাকে উন্নত করে এ চরিত্রগুলো ঈমানের পরিচায়ক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার মধ্যে আমানতদারীতা নেই তার ঈমান নেই। (মুসলিম শরীফ)
আরো এরশাদ করেছেন, খিয়ানত দারিদ্র্য ডেকে আনে। খিয়ানত দ্বারা মানুষ লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়, পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রাসূলুল্লাহ চারিত্রিক গুণাবলী অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।
অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।