জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহর সৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠতম রাহমাতুল্লীল আলামীন (.)

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহকে ভয় করুন, মহান প্রতিপালকের প্রশংসা করুন। যিনি আমাদের প্রতি তাঁর প্রিয় নবীকে প্রেরণ করে অনুগ্রহ করেছেন। যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ বিশ্ববাসীকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বেরিয়ে এনেছেন।

আল কুরআনের আলোকে রাসূলুল্লাহ’র সমুন্নত মর্যাদা: জেনে রাখুন! আমাদের মহান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি সমগ্র নবী রাসূলগণের ইমাম। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর সুমহান মর্যাদা বর্ণনায় অসংখ্য আয়াত অবর্তীণ করেছেন। যে গুলো তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। যেমন পবিত্র কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে, আমি আপনার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছি (সূরা ইনশিরাহ, আয়াত:)

কলেমা, আযান, ইকামত, তাশাহুদ, খুতবা ইত্যাদি জিকরসহ প্রতিটি ইবাদতে আল্লাহ তাঁর নবীজির নাম মোবারক কে তাঁর নামের সাথে সংযুক্ত করেছেন। নামাযের মধ্যে তাশাহুদের সময় তাঁর নবীজিকে সালাম দেয়াকে বান্দার উপর ওয়াজিব করেছেন। এরশাদ হয়েছে হে প্রিয় রাসূল! আমি আপনাকে চাক্ষুষ সাক্ষী (হাজির নাযির), জান্নাতের সুসংবাদদাতা ও জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে প্রেরণ করেছি। যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন। রাসূলকে সাহায্য করো, তাঁকে উচ্চমানের সম্মান প্রদর্শন করো এবং সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর সালাত পাঠ করো। (সূরা আল ফাতাহ, আয়াত নং ০৯)

এভাবে আরো এরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ, নির্দেশ মান্য করো আল্লাহর এবং নির্দেশ মান্য করো, রসূলের আর তাদেরই যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। (সূরা নিসা: আয়াত নং ৫৯)

হে মুমীনগণ! মহান প্রভূর আদেশ মান্য করুন। নবীজির প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করুন। নবী প্রেম অন্তরে ধারণ করে অন্তরাত্না আলোকিত করুন। কেননা হুব্বে রাসূল তথা নবী প্রেমই ঈমান। যার অন্তরে নবীজির মহব্বত নেই তাঁর ঈমান নেই। মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, হে হাবীব আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাকো তবে আমার অনুসারী হয়ে যাও, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করবেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু। (সূরা: আলইমরান, পারা: , আয়াত নং ৩১)

ধরাধামে নূর নবীজির শুভাগমন: আল্লাহর নিকট হতে নূর ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এর দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন। এবং অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান।

(সূরা: মায়িদা, আয়াত: ১৫১৬)

মহান আল্লাহ তা’য়ালা অন্য আয়াতে আরো এরশাদ করেছেন, “তিনি আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন। অপর সমস্ত ধর্মের উপর বিজয়ী করার জন্য, আর স্বাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।

(সূরা: ফাতহ: আয়াত: ২৮)

হাদীস শরীফের আলোকে যে নামের বরকতে ধন্য মোদের জীবন বাতি: হযরত জুবাইর ইবন মুত্‌ঈম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার পাঁচটি নাম আছে, আমি মুহাম্মদ (প্রশংসিত), আহমদ (প্রশংসাকারী), আমি মাহি (মোচনকারী), আল্লাহ তা’য়ালা আমার দ্বারা কুফরী নিশ্চিহ্ন করবেন। আমি হাশির (একত্রিতকারী), সব লোককে কিয়ামত দিবসে আমার কদমের নিকট সমবেত করা হবে। আর আমি আকিব (সর্বশেষ আগমনকারী সর্বশেষ নবী) (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৩৩৩৯, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং :২৩৫৪)

খোদার সৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি: জেনে রাখুন! সরওয়ারে কায়েনাত হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্বসৃষ্টির মূল উৎস। সৃষ্টির রূহ। প্রখ্যাত ইমাম মুহাম্মদ আল মাহদী আহমদ স্বীয় কিতার “মাতালিউল মুসিররাত” এ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃজন করেছেন, আমার নূর হতে প্রতিটি বস্তু সৃজিত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন, সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রাণ এবং বিশ্বসৃষ্টির অস্তিত্বের রহস্য।

আসমানি নূরের শুভাগমন: প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত ওয়াসেলা ইবন আসকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের মধ্যে বনু কেনানাহকে মনোনীত করেন, এবং তাদের মধ্যে কুরাইশকে এবং কুরাইশদের মধ্যে বনু হাশেমকে এবং আল্লাহ তায়ালা আমাকে বনু হাশেম থেকে মনোনীত করেছেন। (মুসলিম, হাদীস নং: ২২৭৬, তিরমিযী, হাদীস নং: ৩৬০৫)

নবীজির দেহ মোবারক গ্রাস করা মাটির উপর হারাম: হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের উত্তম দিবস হলো জুমু‘আর দিবস। কেননা এ দিবসে হযরত আদম আলায়হিস্‌ সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনে তাঁর প্রাণ কব্জ করা হয়েছে, এ দিনেই কিয়ামত হবে। অতএব, তোমরা অধিক পরিমাণে আমার উপর এ দিবসে দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের দরুদসমূহ আমার নিকট পেশ করা হয়। নবীজিকে জিজ্ঞেস করা হলো কীভাবে আপনার উপর দরুদ পেশ করা হবে অথচ আপনি তো মাটিতে মিশে যাবেন? রাবী বলেন, তারা তো বলতেই থাকে যে, ইন্তিকালের পর আপনার দেহ মাটির সাথে মিশে যাবে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কেরামের দেহ গ্রাস করা মাটির উপর হারাম করে দিয়েছেন। (ইবনে মাযাহ্‌ শরীফ, পৃ. ৭৬, মুসনাদে বাযযার, ২য় খন্ড,পৃ:১৭), কুরআন, সুন্নাহ্‌, এজমা কিয়াসের আলোকে দলীল চতুষ্টয় ইসলামী শরীয়্যার প্রমাণ্য দলীল। ‘হায়াতুন্নবী’ বিষয়টি কুরআন সুন্নাহর অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলিলাদির ভিত্তিতে প্রমাণিত।

আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীবের দরবারের আদব শিক্ষা দিয়েছেন: হযরত শায়খ তাকী উদ্দিন রহ. বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মসজিদে নববী শরীফে যে ব্যক্তি উচ্চস্বরে কথা বলতেন তাকে সাবধান ও সতর্ক করে দিতেন। মসজিদে নববী শরীফের পাশেই রওজা শরীফে শায়িত আছেন নূরনবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। যে নূরানী দরবারের সম্মান ও আদব রক্ষা করা মু’মিনের ঈমানের পরিচায়ক, জীবদ্দশায় যেভাবে নবীজির সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা নিষেধ ছিলো, নবীজির ওফাতের পরও রওজা শরীফে পবিত্র দেহ ও রুহের সমন্বয়ে জীবিত আছেন, এ কারণেই হযরত সিদ্দিকে আকবর ও হযরত ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার পক্ষ থেকে উচ্চস্বরে আওয়াজকারী ব্যক্তিকে সাবধান করা হয়েছে তোমরা উচ্চস্বরে আওয়াজ করে নবীজিকে রওজা শরীফে কষ্ট দিচ্ছ। আল্লাহ্‌ তা‘আলা প্রিয় হাবীবের দরবারের আদব শিক্ষা দিয়ে আল কুরআনে এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগণ তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ করোনা। (সূরা হুজরাত: ৪৯:)

উম্মুল মু’মিনীনদের আক্বিদা ছিল নবীজি রওজা শরীফে জীবিত আছেন। এ কারণে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা যখনই দেখতে পেতেন মসজিদে নববী সংলগ্ন কোথাও কোন পেরেক বা অন্য কিছু লাগানোর শব্দ যদি শুনতে পেতেন, সাথে সাথে তিনি নিষেধ করতেন, বলে দিতেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দিওনা। (শিফাউস্‌ সিকাম: পৃ. ১৫৪)

হে আল্লাহ! আমাদের কথায় কাজে কর্মে ও পবিত্র নিয়্যতে আপনার সন্তুষ্টি দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবোধচন্দ্র সেন : ছন্দবিশারদ ও রবীন্দ্রগবেষক
পরবর্তী নিবন্ধক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও একজন মানবিক মানুষ রেজাউল করিম আজাদ