আল কুরআনের আলোকে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব: আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন ইসলামের অপরিহার্য দাবী। তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ গোমরাহী ও মুনাফিকীর পরিচয়। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে আহলে বাইতের সুমহান মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, আপনি বলুন! আমি সেটার জন্য তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাইনা কিন্তু চাই নিকটাত্মীয়তার ভালোবাসা। (সূরা: ৪২, আশ শূরা, পারা: ২৫, আয়াত: ২৩)
আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্য প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফির মুশরিকদের পক্ষ থেকে বর্ণনাতীত জুলুম নির্যাতন, নিপীড়ন ও কষ্ট সহ্য করেছেন, তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত হয়েছেন, ওহুদের ময়দানে দাঁত মুবারক শহীদ করেছেন, প্রাণ প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা মুকাররমা ত্যাগ করে মদীনা মুনাওয়ারা হিজরত করেছেন। শত বাধা বিপত্তি প্রতিকূলতা মুকাবিলা করেছেন। তাবলীগে দ্বীনের মিশনকে বাস্তবায়ন করার মহান লক্ষ্যে সর্বত্র আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ইসলামকে বিজয়ী ধর্ম হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মহান সংগ্রামে যে ত্যাগ ও কুরবানী পেশ করেছেন, উম্মতের পক্ষ থেকে তাঁর কোন প্রতিদান চাননি। মহান আল্লাহর নির্দেশে একমাত্র তাঁর আহলে বাইত তথা নিকটাত্নীয়দের প্রতি ভালবাসা চেয়েছেন।
আহলে বাইত দ্বারা কারা উদ্দেশ্য: বর্ণিত আয়াতে করীমায় আহলে বাইত বলতে কারা উদ্দেশ্য? এ প্রসঙ্গে তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত রয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম তাবেঈন ও একদল তাফসীরকারদের বর্ণনা মতে প্রিয় নবীর আহলে বাইত দ্বারা হযরত মাওলা আলী (রা.) হযরত ফাতেমা (রা.) হযরত ইমাম হাসান, হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় একদল তাফসীর বিশারদদের বর্ণনা মতে, আহলে বাইত দ্বারা নবীজির পবিত্র সহধর্মিনীগণ, বুঝানো হয়েছে। (বরকাতে আলে রাসূল, পৃ: ৩২)
আহলে বাইতের মর্যাদা ও পবিত্রতা বর্ণনায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে আহলে বাইত আল্লাহ তা’আলা তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূরীভূত করবেন এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করবেন। (সূরা: আহযাব, আয়াত: ৩৩)
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, উপরোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফজর নামাযের জন্য তাশরীফ নিতেন হযরত ফাতেমা (রা.) এর ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলতেন হে আহলে বাইত! নামায পড়ুন। নবীজির সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশ দিন ফজরের নামাযের সময় হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার দরজার পাশ দিয়ে গমন করতেন এবং বলতেন হে আহলে বাইত, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক, নামায পড়ুন! আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর রহমত বর্ষণ করবেন, অত:পর “ইন্নামা ইউরিদুল্লাহু …… আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করতেন, হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা বর্ণনা করেন, নবীজি সাত মাস অপর বর্ণনায় আট মাস পর্যন্ত এ আমল অব্যাহত রেখেছিলেন। আয়াতে করীমায় আহলে বাইতে বলতে পাক পঞ্জেতন উদ্দেশ্য। (বরকাতে আলে রাসূল পৃ:-২৫, আনোয়ারুল বয়ান, ১ম খন্ড, পৃ:৩০)
হাদীস শরীফের আলোকে আহ্লে বাইত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহলে বাইতের আদর্শ অনুসরণ ও তাঁদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন, হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হে মানব মন্ডলী! আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা আকড়িয়ে ধর, কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা, আল্লাহর কিতাব (আল কুরআন) ও আমার বংশধর আহলে বাইত। (মিশকাত, পৃ: ৫৬৯)
হযরত আবু যর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বায়তুল্লাহ শরীফের দরজা ধরে বর্ণনা করেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি শুনেছি! তোমাদের মধ্যে আমার আহলে বাইতের দৃষ্টান্ত হলো নূহ আলাইহিস সালাম এর কিস্তি স্বরূপ যে এতে আরোহন করেছে সে মুক্তি পেয়েছে, যে এতে আরোহন করেনি পশ্চাতে রয়েছে সে ধ্বংস হয়েছে। (মিশকাত, পৃ: ৫৭৩)
হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার সাহাবাগন নক্ষত্ররাজিতুল্য, তাঁদের মধ্যে তোমরা যাদেরকে অনুসরন করবে সঠিক পথের দিশা পাবে। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৫৪)।
আহলে বাইতের প্রতি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র ভালবাসা: নবীদের পর সর্বোত্তম মানব আমিরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটাত্বীয়দের সাথে সদাচরন করা, আমার নিকট অধিক প্রিয় আমার নিকটাত্মীয়ের সাথে সদাচরন করার চেয়ে। (আশশরফুল মুয়ায়্যাদ, পৃ: ৮৭)
একদিন আমিরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মিম্বর শরীফে খুতবা দিচ্ছিলেন হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কম বয়সের শিশু, তিনি এসে বললেন এ মিম্বর আমার নানাজানের, মিম্বর থেকে আপনি অবতরন করুন। হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) বললেন, হে ইমাম হাসান, আপনি সত্যি বলেছেন, আল্লাহর শপথ নি:সন্দেহে এ মিম্বর আপনার নানাজানের অত:পর তিনি হযরত ইমাম হাসান (রা.) কে স্নেহভরে নিজ কোলে তুলে নিলেন এবং কেঁদে দিলেন। অনুরূপ ঘটনা হযরত উমর ফারুক আযম (রা.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে। (আররিয়াদুন নাদ্বরাহ, ৩য় খন্ড, পৃ: ২৯)
আহলে বাইতের প্রতি হযরত ওমর ফারুক আযম (রা.)’র ভালবাসা: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন, আমিরুল মু’মিনীন হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে মাদায়েন বিজয় হলো, মসজিদে নববী শরীফে গনীমতের মাল হাজির করা হলো, তখন হযরত ইমাম হাসান (রা.) উপস্থিত হয়ে বললেন হে আমিরুল মু’মিনীন! আমার হক আল্লাহ তা’আলা যতটুকু নির্ধারণ করেছেন আমাকে প্রদান করুন। আমিরুল মু’মিনীন এক হাজার দিরহাম প্রদান করেন, এরপর হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) তাশরীফ আনলেন উনাকেও এক হাজার দিরহাম দেয়া হলো। অত:পর আমিরুল মু’মিনীন’র সাহেবজাদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর তাশরীফ আনলেন উনাকে পাঁচশত দিরহাম দেয়া হলো, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর আবেদন করলেন হে আমিরুল মু’মিনীন! আমি রাসূলুল্লাহর বরকতময় যুগে যুবক ছিলাম, আপনার সাথে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছি, হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (রা.) সে সময় শিশু ছিলেন মদীনার গলিতে খেলাধুলা করতেন, আপনি উনাদের এক হাজার দিরহাম দিলেন? তখন ফারুকে আজম (রা.) বললেন প্রিয় পুত্র! প্রথমে ইমামে হাসান ও ইমাম হোসাইনের মর্যাদা অর্জন করো। অত:পর হাজার দিরহামের দাবী কর। তুমি কি জান না? উনার নানাজান রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, উনাদের পিতা শেরে খোদা হযরত আলী (রা.), উনাদের মাতা ফাতেমা (রা.), উনাদের নানী হযরত খাদীজাতুল কুবরা, চাচা জাফর তাইয়্যার (রা.) ফুফী হযরত উম্মে হানী, মামা ইবরাহীম ইবনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খালা হযরত রোকেয়া, উম্মে কুলসুম, হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম। এ কথা শ্রবণ করে শাহাজাদা হযরত আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু চুপ হয়ে গেলেন। (আর রিয়াদুন নাদ্বয়াহ, ২য় খন্ড, পৃ: ২৮)
আওলাদে রসূলের প্রতি ইমাম আযমের গভীর ভালবাসা: হানাফী মযহাবের প্রবর্তক হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির অন্তরে ছিল আওলাদে রাসুলের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা। এমনকি ইমাম আযমের পিতা ও দাদার সাথে ছিল হযরত মাওলা আলী শেরে খোদার সাথে গভীর সুসম্পর্ক ও ভালোবাসা। ইমাম আযমের আব্বাজান হযরত সাবিত তাঁর পিতা যুতীর সাথে বাল্যকালে ইরাকের কুফা শহরে হযরত মাওলা আলী (রা.)’র সান্নিধ্যে গমন করেন, মাওলা আলী (রা.) তাঁদের পূর্ব পূরুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণ ও বরকতের জন্য দুআ করলেন। মাওলা আলী (রা.)’র দুআর বরকতে হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু জন্ম গ্রহণ করেন। (তোহফায়ে ইসনা আশরিয়া)
হযরত আবদুল আজীজ মুহাদ্দিস দেহলভী (র.) বর্ণনা করেন, ইমাম আযম আওলাদে রাসূল হযরত ইমাম মুহাম্মদ বাকের (রা.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদিক (রা.) যায়েদ ইবনে আলী ইবনে হোসাইন এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁদের সান্নিধ্যে ইলমে ফিকহ, হাদীস শাস্ত্র ও তাসাউফের ইলম অর্জন করেন।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের অন্তরে আহলে বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা দান করুন। সাহাবায়ে কেরামের মহান আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।