জুম্‌’আর খুতবা

মুসলিম উম্মাহর কিংবদন্তি ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)’র জীবন কর্ম ও তাঁর অবদান

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! কুরআন সুন্নাহর আলোকে শরয়ী বিষয়ে আইনজ্ঞ মুজতাহিদ ইমামগণের প্রবর্তিত ও উদ্ভাবিত নির্দেশনা মেনে চলুন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করুন, কুরআন সুন্নাহর আলোকে শরীয়তের শাখা প্রশাখায় প্রতিটি বিষয়ে মাসআলা মাসায়েল আহরণের ক্ষেত্রে চার মাযহাবের ইমামদের মধ্যে ইমাম আযম আবু হানিফা (.) এর স্তরে কেউ উপনীত হতে পারেননি, তিনি ছিলেন সকলের রাহনুমা পথ নির্দেশক। তিনিই একমাত্র ইমাম যিনি সরাসরি সাহাবা ও অসংখ্য তাবিঈ থেকে ইলম অর্জন করেছেন।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে তাঁর আবির্ভাব: প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে বসা ছিলাম এমন সময় পবিত্র কুরআনের সূরা “জুম’আ” নাযিল হয়। নবীজি সূরা “জুম’আ” তিলাওয়াত করে যখন সূরা জুমআর তিন নম্বর আয়াত পর্যন্ত পৌছলেন, অর্থ: এবং তাদের মধ্য থেকে অন্যান্যদের কে পবিত্র করেন এবং জ্ঞান দান করেন তাদেরকে যারা পূর্ববতীদের সাথে মিলিত হয়নি এবং তিনিই পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সূরা: জুমআ, পারা,২৮, আয়াত: ০৩)

জিজ্ঞেস করা হলো ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এ আয়াত যাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে তাঁরা কারা? নবীজি উত্তর দিলেন না। প্রশ্নকারী তিনবার জিজ্ঞেস করলেন, নবীজি তখন হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কাঁধে হাত মোবারক রেখে এরশাদ করলেন, “যদি দ্বীন আকাশের সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকটেও থাকে তবুও পারস্যের সন্তানদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি এসে তা নিয়ে নিবে এবং অর্জন করবে। (সহীহ মুসলিম, খন্ড, পৃ: ৩১২)

হাদীসের ব্যাখ্যা: বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ুতী (.) (৮৪৯৯১১) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহর পবিত্র বানী দ্বারা ইমাম আ’যম (.) এর দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, হাদীসে পারস্য বংশোদ্ভুত ওলামায়ে কেরামের কথা বলা হয়েছে, একথা সর্বজন বিদিত যে, ইমাম আবু হানিফা (রা.) ছাড়া কোনো মুজতাহিদ ফকীহ বা হাদীস বিশারদ পারস্য বংশোদ্ভূত ছিলেন না। সুতরাং হাদীসের সুস্পষ্ট মর্ম ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.) ছাড়া অন্য কেউ নন। পারস্যের ওলামাদের মধ্যে ইলম, তাকওয়া, সততা, বিশ্বস্ততা ও দ্বীনি খিদমতে কেউ ইমাম আবু হানিফার সমকক্ষ হতে পারেনি।

ইমাম আযম’র নাম ও বংশ পারিচয়: ইমাম আয’ম (.)’র জন্ম ৮০ হিজরিতে কুফায়। তাঁর নাম নুমান উপনাম আবু হানিফা উপাধি ইমাম আযম তাঁর পিতার নাম সাবিত, দাদার নাম যুত্বী আবু হানিফার পিতৃপুরুষদের মধ্যে তাঁর দাদা যুত্বীই সর্ব প্রথম মুসলমান। ইমাম আবু হানিফা (রা.)’র দাদা সুত্বী তাইম গোত্রের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে তারা তাঈমী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন অনারব তথা পারস্য বংশোদ্ভূত। ইমাম আবু হানিফার নাতি ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা পারসিক আমরা স্বাধীন বংশের লোক, আমাদের পূর্বপূরুষদের উপর কখনো দাসত্বের পর্ব আসেনি। (তারিখে বাগদাদ ১৫/৪৪৮)

আমিরুল মু’মেনীন হযরত মাওলা আলী (.)’র দুআ: ইমাম আযমের পিতা সাবিত জন্ম হওয়ার পর তাঁর দাদা নুমান নিজ সন্তান সাবিতকে বেলায়তের স্রোতস্বিনী প্রস্রবন হযরত মাওলা আলী (রা.)’র দরবারে নিয়ে গেলেন, মওলা আলী শেরে খোদা এ নবজাতক শিশু সন্তানের জন্য এবং তাঁর ভবিষ্য প্রজন্মের জন্য কল্যাণ ও বরকতের দুআ করলেন, এ প্রসঙ্গে ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ বলেন, আমার দাদা সাবিত আলী (রা.)’র দরবারে গেলে তিনি তাঁর জন্য এবং তাঁর সন্তানদের জন্য বরকতের দুআ করেছেন। আমাদের বিশ্বাস হলো আল্লাহ তা’আলা আমাদের জন্য হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)’র দুআ কবুল করেছেন। (তারিখে বাগদাদ, খন্ড:১৩, পৃ: ৩২৭, আল খায়রাতুল হিসান, পৃ: ৩০)

ইমাম আযম আবু হানিফ (রা.) তাবেঈ ছিলেন: ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (.)’র বর্ননা মতে তাবেয়ী বলা হয় যিনি সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ ইবনে আলওয়ী আল মালিকী আল মক্কী বর্ণনা করেন, যিনি মুমীন অবস্থায় সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং ঈমান অবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন যদিও সাহাবাদের সাহচর্য লাভ করেননি এবং তাঁদের থেকে হাদীসও বর্ণনা করেননি। (মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহ, পৃ: ৪০৫)

হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের থেকে সর্বোত্তম যুগ হলো আমার যুগ। অত:পর যারা তাঁদের সাথে মিলবেন (তাবেয়ী) অত:পর যারা তাঁদের সাথে মিলবে (তবেঈতাবেঈন)(মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বল, হাদীস, ১৯৯০৬)

তাওরাত শরীফে ইমাম আযম (রা.)’র উল্লেখ: হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, আসমানী কিতাব তাওরাত শরীফে হযরত ইমাম আবু হানিফা (রা.)’র কথা উল্লেখ রয়েছে, হযরত কা’ব আখবার (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের মধ্যে এমন এক নুর হবে, যার উপনাম হবে আবু হানিফা ইমাম আযমের উপাধি “সিরাজুল উম্মাহ” এ বর্ণনার সমার্থক। (আনোযারুল বয়ান, খন্ড: , পৃ: ৪৫৬)

শিক্ষা দীক্ষা: তৎকালীন সময়ে ইরাকের কুফা নগরী ছিল ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান তাহজীব তমুদ্দুন ও সভ্যতা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ইমাম আযম সে যুগের খ্যাতিমান মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম হাম্মাদ এর সান্নিধ্যে থেকে ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহ অর্জন করেন। ইমাম আযম ইমাম হাম্মাদ (রা.)’র ইন্তিকাল (১২০ হি.) পূর্ব পর্যন্ত সূদীর্ঘ আঠার বছর ধারাবাহিকভাবে তাঁর সান্নিধ্যে থেকে ইলমে ফিকহ শাস্ত্রে গভীর বুৎপত্তি অর্জন করেন। হাদীস শাস্ত্রে হযরত আমির শা’বী হিলেন তার প্রসিদ্ধ ওস্তাদ। তাঁর ওস্তাদের সংখ্যা চার হাজার “উক্‌দুল জুম্মান” কিতাবে দু’ই শত আশি জন উস্তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্যবসা বাণিজ্যে সততা ও দানশীলতা: হালাল পন্থায় জীবিকা অর্জনের জন্য আল্লাহ তা’আলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন। হালাল উপার্জন করা ফরজ। ইমাম আযম কারো হাদীয়া তোহফার মুখাপেক্ষী ছিলেন না। নিজেই নিজের জীবিকা উপার্জন করতেন ইলমে দ্বীন অর্জন ও দ্বীনি খিদমতের পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবসা করতেন কুফায় তাঁর কাপড়ের দোকান ছিল বেশ সুপ্রসিদ্ধ। তিনি কুফা বসরাসহ আরো দুর দুরান্তের শহরে ব্যবসার প্রয়োজনে সফর করতেন তিনি প্রাত্যাহিক কিছু সময় ব্যবসার জন্য ব্যয় করতেন। লেনদেনে ছিলেন বিশ্বস্ত, আমানতদার, তাঁর ব্যবসায়ী পাটনার ছিল। কোনো নিম্ন মানের কাপড় হলে যা কাপড়ে খুত বা ত্রুটি থাকলে তিনি অংশীদার বা ক্রেতাকে বলে দিতেন তাঁর পাটনার দায়িত্ববান তিনিও ছিলেন সৎ। কাপড় বিক্রির সময় কোনো একদিন ভুলক্রমে কাপড়ের খুঁতের কথা ক্রেতাকে বলতে ভুলে যান। কার নিকট বিক্রি করা হয়েছে ক্রেতাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলনা পরিশেষে সেদিন হিসাব করে জানাগেল ত্রিশ হাজার মুদ্রার সমপরিমাণ কাপড় বিক্রয় হয়েছিল। তিনি তাঁর ব্যবসাকে সম্পূর্ণরূপে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য সেদিনকার ত্রিশ হাজার মুদ্রা অসহায় দরিদ্র ফকীর মিসকীনদের মাঝে সাদকা হিসেবে দিয়ে দিলেন। সততা ও দানশীলতার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইসলামী অর্থনীতি ও বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুস্মরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে। (শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, ফিকহ ও তাসাউফ, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:, পৃ: ৪৬৪)

ইমাম আযামের বৈশিষ্ট্য: আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ুতী (.) বলেন, ইমাম আযমের বৈশিষ্ট্য সমূহের বিশেষ দিক হলো তিনি সর্ব প্রথম শরয়ী ইলম (ফিকহ শাস্ত্র) উদ্ভাবন করেন এবং তা অধ্যায় আকারে বিন্যস্ত করেন। ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রা.) তাঁর মুয়াত্তা কিতাব বিন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁর অনুসরণ করেছেন। এবং ইমাম আবু হানিফা (রা.) এর আগে কেউ তা করতে পারেনি। (তাবয়ীযুস সহীফা, আল্লামা সুয়ুতী, পৃ: ১২৯)

পৃথিবীর দেশে দেশে হানফী মযহাব:

চার মাযহাবের মধ্যে হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব সুবিদিত। তাঁর নামানুসারে এ মাযহাবের নামকরণ হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হানফী মাযহাব সর্বাধিকভাবে সমাদৃত। বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান আফগানিস্তান মধ্য এশিয়া, তুরস্ক মিশর প্রভূতি দেশের অধিকাংশ মুসলমানরা হানফী মাযহাবের অনুসারী। তিনিই সর্ব প্রথম ফিকহ শাস্ত্র প্রণয়ন ও সংকলন করেন। হানাফী মযহাবে ইসলামের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব বিষয়ে জটিল কঠিন মাসআলা মাসায়েলের সহজ সরল সমাধান রয়েছে। ১৭০ হিজরিতে খলীফা হারুনুর রশীদ ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) কে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিকহ হানফীর ভিত্তিতে হানফী মাযহাবের প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যারা মুসলিম উম্মাহর মহান কিংবদন্তি ইমাম আযমের প্রতি অসম্মান ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন অশালীন উক্তিকরে তারা অকৃতজ্ঞ, বিভ্রান্ত পথভ্রষ্ট। ইসলামের সঠিক পথ থেকে তারা বিচ্যূৎ।

ইন্তিকাল: ইমামুল মুসলেমীন ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.) ৭০ বছর বয়সে ২ শাবান ১৫০ হিজরিতে ইন্তিকাল করেন, বাগদাদের খেযরান নামক কবরস্থানের পূর্ব পার্শ্বে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর সন্তান হযরত হাম্মাদ জানাযায় ইমামতি করেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এই মহান ইমামের আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

আব্দুর রহমান কাদেরী

আমান বাজার, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: শাবান মাসের ফযীলত সম্পর্কে সংক্ষেপে জানালে উপকৃত হব।

উত্তর: হাদীস শরীফ ও বুজুর্গানে দ্বীনের আমালের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে শাবান মাসের গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট শাবান মাসে রোযা রাখা অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি পছন্দনীয় ছিলো এ মাসে রোজা রাখতেন অত:পর একে রমজানের সাথে মিলিয়ে দিতেন। (আবু দাউদ, হাদীস: ২৪৩১)

নবীজি আরো এরশাদ করেন, রমজানের সম্মানে শাবানের রোযা। (তিরমিযী, হাদীস: ৬৬৩)

হযরত শায়খ শিহাবুদ্দিন আহমদ হিফাযী বর্ণনা করেন, নিশ্চয় শাবান মাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ পাঠ করার মাস, কেননা। (সূরা: আহযাব ৫৬ নং আয়অতে দরুদ এ মাসেই নাযিল হয়েছে। (মাওয়াহিবে লুদুন্নিয়া, /৫০৬)

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশের প্রকাশনা আর একুশের প্রথম প্রহর
পরবর্তী নিবন্ধআ.কাদের জিলানী (র.) স্মরণে সেমিনার আজ