জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

রমজানুল মুবারক গুরুত্ব ও করণীয়

আলকুরআনের আলোকে রোযার গুরুত্ব: হিজরি ২য় সনে পবিত্র রমজানের রোযা ফরজ হয়েছে, প্রত্যেক জ্ঞান সম্পন্ন বিবেকবান সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নরনারীর উপর রোজা রাখা ফরজ। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেন তোমরা তাকওয়াবান হতে পার। (সূরা: বাকারা, ২: আয়াত: ১৮৩)
আরো এরশাদ হয়েছে, “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে আর কেউ অসুস্থ থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
চাঁদ দেখে রোযা শুরু করা: সরকারে দুআলম নুরে মোজাচ্ছম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা শুরু করবে এবং চাঁদ দেখে তা শেষ করবে। (তিরমিযী)
চাঁদ দেখে রোযা শুরু করা ও চাঁদ দেখে রোযা সমাপ্ত করা অসংখ্য সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন তোমরা রমজানের চাঁদ দেখবে তখন রোজা শুরু করবে আবার যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখবে ঈদুল ফিতর পালন করবে। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তখন ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে। (বুখারী শরীফ)
ইসলামী বিধানে ২৯ শাবান সুর্যাস্তের পর রমজানের চাঁদ অনুসন্ধান করা ফরজে কেফায়া। (মারাকিউল ফালাহ, পৃ: ২৩৯)
পূর্ববর্তী নবীদের উপর রোযা ফরজ ছিল: হযরত আদম আলাইহিস সালাম প্রতি মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোযা রাখতেন। হযরত নুহ (আ.) পুরো বৎসর রোজা রাখতেন। হযরত দাউদ (আ.) একদিন রোযা রাখতেন একদিন বিরতি দিতেন, হযরত ঈসা (আ.) একদিন রোজা রাখতেন দুইদিন রাখতেন না। (তাফসিরে আজিজি, খন্ড ১, পৃ: ৬৩৯)
আল্লামা ইবনে কাসীর (র.)’র বর্ণনা মতে ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রতিমাসে তিনদিন রোযা রাখার বিধান ছিল। রমজানের রোজা ফরজ করা হলে তা রহিত হয়ে যায়। হযরত আস (রা.) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হযরত আতা, হযরত কাতাদাহ (রা.) প্রমূখের বর্ণনামতে হযরত নুহ (আ.)এর যুগ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব পর্যন্ত প্রতিমাসে তিন দিন রোযা রাখার বিধান বলবৎ ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোযা ফরজ করা হলে তা রহিত হয়।
রোজা রাখলে বিগত জীবনের গুনাহ ক্ষমা করা হয়: প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানের সিয়াম পালন করে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। (বোখারী শরীফ, খন্ড ১ম, পৃ: ৬৫৮, মুসলিম শরীফ, খন্ড ১ম, পৃ: ২৫৯, সুননে আবুদাউদ, খন্ড ১ম, পৃ: ১৯৪)
রমজানের প্রতিটি ইবাদতের বিশেষ ফযীলত: রমজানে প্রতি মূহুর্ত ইবাদত। তারাবীহ, তাহাজ্জুদ ও নফল নামায সমূহ আদায়ে রয়েছে বর্নণাতীত রহমত, বরকত ও ফযীলত। এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান ও সওয়াবের আশা রেখে কিয়ামে রমজান, প্রথমত: তারাবীহ দ্বিতীয়ত: তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নফল ইবাদত আদায় করবে। সে তার গুনাহ থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে যেন তার মায়ের উদর থেকে ভূমিষ্ট হয়েছে। (সুনানু নাসাঈ, হাদীস নং: ২২০৮)
করনীয়:
রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। অধিক পরিমাণ আল্লাহর ক্ষমা লাভের মাস, অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, মিথ্যাচার ও যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে নিজকে বিরত রেখে পরিশুদ্ধ মু’মীন ও মুত্তাকী হওয়ার মাস রমজানুল মুবারক। এ মহিমান্বিত বরকতমন্ডিত মাস আগমনের সাথে করনীয় আমলগুলো সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি।
১. রমজানের রোযা রাখা ফরজ: প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর উপর রমজানের রোযা রাখা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কেউ শরয়ী ওজর বা অসুস্থতা না থাকা সত্ত্বেও রমজানের একটি রোজা না রাখে সে জীবনভর রোযা রাখলেও তার ক্ষতিপূরণ হবেনা যদিও পরবর্তীতে রাখে। (ইবনে মাযাহ, পৃ: ১২০, আবুদউদ, খন্ড ১ম, পৃ: ৩২৬, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড ৩, পৃ: ২৭)
২. তারাবীহ নামায আদায় করা: তারাবীহ নামায সুন্নাতে মুআক্বাদাহ, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমজান মাসে আল্লাহ তোমাদের উপর রোযা ফরজ করেছেন, আমি এ মাসে তোমাদের জন্য কিয়াম তারাবীহ সুন্নাত করেছি। (ইবনে মাযাহ, হাদীস নং: ১৩২৮)
বিশ রাকাআত তারাবীহ নামায অসংখ্য সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, এরশাদ হয়েছে, আমিরুল মু’মেনীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তারাবীহ নামাযের জন্য ওবাই ইবনু কাব (রা.)’র পিছনে লোকদের একত্রিত করলেন তিনি তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাআত তারাবীহ নামায আদায় করলেন। (সুনানে আবু দাউদ , হাদীস নং: ১৪২৯)
তারাবীহ নামায বিশ রাকাত হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের (ইজমা) ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা অসংখ্য সহীহ হাদীস ও মুজতাহিদ ইমাম গণের বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত।
৩. সেহেরি খাওয়া : রোযার প্রস্তুতি শুরু হয় সাহেরি মাধ্যমে সমাপ্তি হয় ইফতারের মাধ্যমে। রোযা রাখার নিয়্যতে শেষ রাতে খাদ্য গ্রহণ করাকে সেহেরি বলা হয়। সাহেরি খাওয়া নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা সেহেরি খাও কেননা সেহেরিতে বরকত রয়েছে।” (সহীহ বুখারী, খন্ড ১ম, পৃ: ২৫৭, মুসলিম শরীফ, খন্ড ১ম, পৃ: ৩৫০, নাসাঈ, খন্ড ১ম, পৃ: ২৩৩, ইবনে মাযাহ, পৃ: ১২১)
সেহেরিতে সঠিক খাবার নির্বাচন জরুরি: সেহেরিতে ভাল খাবার খেলে কোষ্ঠ কাঠিন্য, মাথা ব্যথা, দুর্বলতা ইত্যাদি দূর করা যায়। চর্বি ছাড়া মাংস মুরগির মাংস মাছ ডিম দুধ শরীরে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করবে। অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার থেকে বিরত থাকুন। সেহেরির সময় অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। খাবার যদি নিয়মিত ও পরিমিত না হয় শরীরে নানাবিধ রোগব্যাধি সৃষ্টি হবে। নবীজি এরশাদ করেছেন, তোমরা রোযা রাখ সুস্থ থাক। (তাবরানী শরীফ)
৪. ইফতার করা: ইফতার অর্থ রোযা ভঙ্গ করা। শরয়ী পরিভাষায়, সূর্যাস্তের সাথে সাথে রোযাদার পানাহার করাকে ইফতার বলা হয়, ইফতার করা সুন্নাত। সূর্যাস্ত নিশ্চিত হয়ে মাগরিবের নামাযের পূর্বেই ইফতার করা মুস্তাহাব। (আলমগীরি)
খেজুর বা পানি দিয়ে ইফতার করা সুন্নাত: হাদীস শরীফে হযরত সোলায়মান ইবনে আমের হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের কেউ যখন ইফতার করে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে, এতে বরকত রয়েছে। খেজুর না পেলে পানি দিয়ে করবে কেননা পানি পবিত্র। (তিরমিযী, খন্ড ১ম, পৃ: ১৪৯)
ইফতারের মুহূর্ত আনন্দময়: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ একটি তার ইফতারের সময় আর একটি আনন্দ তার প্রভূর সাথে দিদারের সময়। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)
ইফতারিতে ভুরি ভোজন না করে অবশ্য হালকা আহার করা উচিৎ। অপচয় অপব্যয় ইসলামে হারাম। অতিরিক্ত আহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, হালকা আহারই কাম্য। দিনের বেলা উপবাস থাকার কারণে শরীরের পানি স্বল্পতা দূর করার জন্য ইফতারির সময় পরিমিত পানি, ডাবের পানি, ফলের রস, শরবত, শাক-সবজি, সালাদ বিভিন্ন প্রকার মৌসমী ফল তরমুজ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এ গুলোতে রয়েছে ভিটামিন এ ভিটামিন সি। ইফতারি ও সেহেরিতে অবশ্যই পুষ্টিকর খাবারের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। খেজুর দ্বারা ইফতার করা সুন্নাত। খেজুরের গুণাগুণ পরীক্ষিত ও এর খাদ্য শক্তি অপরিসীম। হাদীস শরীফে এসেছে, আজওয়া খেজুর জান্নাতের ফল। (তিরমিযী)
কুরআন মজীদ খতম করা: পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা সর্বোত্তম ইবাদত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো কেননা কিয়ামতের দিন তা তিলাওয়াত কারীর জন্য সুপারিশকারী হিসেবে উপস্থিত হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ১৩৩৭)
নবীজি নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। রমজানে তিলাওয়াতে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাধিক দানশীল ছিলেন। রমজানে তিনি আরো বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। প্রতি রমজানে জিবরীল আলাইহিস সালাম নবীজির সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং পরস্পরকে কুরআন শোনাতেন। (সুননাদে আহমদ, হাদীস নং: ৩৫৩৯)
ইমাম আজম আবু হানিফা (র.) প্রতি রমজানে একষট্টি কুরআন খতম আদায় করতেন। ত্রিশটি দিনে ত্রিশটি রাতে এক খতম তারাবীতে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড ৪র্থ, পৃ: ৫৫)
ইমাম বুখারী (র.) রমজান শরীফে এক চল্লিশ খতম কুরআন আদায় করতেন ত্রিশ দিনে ত্রিশ খতম তারাবীতে এক খতম, তাহাজ্জুদ নামাযে প্রতি তিন দিনে এক খতম করে ত্রিশ দিনে দশ খতম আদায় করতেন। (বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ হাদীয়ুস সারী, পৃ: ৪৮১)
তারাবীহ নামাযে একবার কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ, দু’বার খতম করা উত্তম, তিন বার করা অধিক উত্তম। (দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড ৪র্থ, পৃ: ৫৩)
হাফেজ কুরআনকে সম্মান করা: নবীজি এরশাদ করেছেন, তোমরা হাফেজে কুরআনদের সম্মান করো যে তাদেরকে সম্মান করলো সে আমাকে সম্মান জানালো। (কানযুল উম্মাল, খন্ড ২, পৃ: ২৫৮, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড ৩ পৃ: ৭)
এছাড়াও পবিত্র রমজান মাসে শেষ দশকে ইতিকাফ পালন করা, নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করা, এতিম মিসকীন দরিদ্র, অসহায় মানুষকে সাহায্য করা, শবে কদর অনুসন্ধান করা, অধিক পরিমাণ দান সাদকা করা, উত্তম আমল হিসেবে পরিগণিত করা, মহান আল্লাহ আমাদের সিয়ামের গুরুত্ব অনুধাবন ও করণীয় নেক আমল গুলো সঠিক ভাবে সম্পাদন করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র মাহে রমজানুল মোবারক
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে