জুম্‌’আর খুতবা

হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম’র দ্বীনি দাওয়াত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন, সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত ও দ্বীনের প্রতি হেদায়াত দানের উদ্দেশ্য মহান আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করে সত্যান্বেষী মানব জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। নবীরাসূলগণের পদাঙ্ক অনুসারীদের জন্য জান্নাতে প্রবেশের পথ সুগম করেছেন। মানব জাতির হেদায়ত ও পথ প্রদর্শকের জন্য নবী রাসূলগণকে সব ধরনের গুণাবলী, যোগ্যতা দিয়ে প্রেরণ করে তাঁদেরকে মহিমান্বিত করেছেন। নবী রাসূলগণের জীবনাদর্শকে যাবতীয় অপূর্ণতা ভুলভ্রান্তি, সন্দেহ সংশয় থেকে মুক্ত করেছেন। ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্য নবী রাসূল আলাইহিমুস সালামদের অনুসরণ ও অনুকরণ মানবজাতির জন্য অপরিহার্য করেছেন। নবী প্রেরণের ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহর অপার করুণা ও অনুগ্রহে মানব জাতির হেদায়তের জন্য হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর শুভাগমন ছিলো তাঁর উম্মতদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ রহমত।

হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম’র পরিচিতি:

আলকুরআনে বর্ণিত নবীগণের মধ্যে হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর নাতি। তাঁর পিতার নাম হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম। ইবরানী ভাষায় তাঁর অপর নাম ছিল ইসরাঈল। তাঁর পরবর্তী বংশধরগণ বনী ইসরাঈল নামে পরিচিত। পবিত্র কুরআনে ১৬ জায়গায় তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। ইবনে কাছীরের বর্ণনামতে ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ১৪০ বছর। তিনি তাঁর পিতার মতোই সিরিয়ার বৃহৎ অঞ্চলে বসবাস ও ধর্ম প্রচার করেন। শেষ জীবনে তাঁর পুত্রদেরসহ হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর আহবানে মিসরে গমন করেন এবং সেখানে বসবাস করেন।

হযরত ইয়াকুব (.)’র পরিবার ও সন্তান সন্তুতি:

হযরত ইয়াকুব (.)’র দু’জন স্ত্রী ছিলেন। প্রথমা স্ত্রীর নাম লাইয়া, তিনি ছিলেন তাঁর মামাতো বোন, তাঁর গর্ভের সন্তান সন্তুতির নাম যথাক্রমে শামউন, লাভী, ইয়াহুজা, সাবালন ও দ্বীনা নামে এক কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন। (ইবন জরীর তারীখুর রুসুলি ওয়াল মুলুক, খন্ড, , পৃ: ১২১)

হযরত ইয়াকুব (.)’র দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম রাহীলা। প্রথম স্ত্রীর ইন্তিকালের পর তিনি তাঁকে বিয়ে করেন, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ আল্লাহ নবী হযরত ইউসুফ (.) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তাঁর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র বিনয়ামীন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর পুত্র হযরত লাভী এর পঞ্চম অধস্তন পুরুষ হযরত মুসা (.) ও হযরত হারুন (.) নবী হিসেবে মনোনীত হন।

হযরত ইয়াকুব (.) ছিলেন বায়তুল মুকাদ্দাস এর প্রথম নির্মাতা,

হযরত সুলায়মান (.) পুনঃনির্মাণ করেছেন:

আল্লামা ইবন কাছীর (রহ.)’র বর্ণনা করেন, হযরত ইয়াকুব (.) ইরাকের হারান অঞ্চলে অবস্থিত তাঁর মামার বাড়িতে যাবার পথে রাত হয়ে গেলে কেনআনের অদূরে একস্থানে একটি পাথরের উপর মস্তক রেখে নিদ্রা যান। নিদ্রারত অবস্থায় স্বপ্ন দেখেন যে একদল ফেরেস্তা সেখান থেকে আসমানে উঠানামা করছে। এরই মধ্যে আল্লাহ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলছেন অতি সত্বর আমি তোমার উপর বরকত নাযিল করব, তোমার সন্তান সন্তুতি বৃদ্ধি করে দেব। তুমি ও তোমার উত্তরসূরীদেরকে এ জমীনের মালিক বানাবো। তিনি নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে আনন্দচিত্তে মান্নত করলেন যে, তিনি যদি নিরাপদে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারেন তাহলে এ স্থানে তিনি একটি “ইবাদতগাহ” নির্মাণ করবেন এবং আল্লাহ প্রদত্ত রিযকের এক দশমাংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করবেন। অতঃপর ঐস্থানে তিনি পাথরটির উপর একটি চিহ্ন এঁেক দিলেন, পরবর্তীতে সিরীয় অঞ্চল তথা ফিলিস্তিনে অবস্থানকালে এ স্থানে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেছিলেন, তিনিই বায়তুল মুকাদ্দাস এর প্রথম নির্মাতা। পরবর্তীতে প্রায় ১০০০ বছর পর হযরত সুলায়মান (.) তা পুন: নির্মাণ করেন। (ইবনে কাছীর ১ম খন্ড, পৃ: ১৯৪,১৯৬)

আল কুরআনের আলোকে উত্তরসূরীদের প্রতি হযরত ইয়াকুব (.)’র উপদেশ :

আম্বিয়া আলাইহিস সালাম হলেন সত্যের দিশারী, জাতির পথ প্রদর্শক। তাঁরা নিজেদের সন্তান সন্তুতিকে দ্বীনের পথে, হেদায়তের পথে, আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় পরিচালিত করার প্রয়াসে গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন, হযরত ইয়াকুব (.) নিজ সন্তানদের প্রতি দ্বীনি দাওয়াত ও অমূল্য উপদেশ বাণী দিয়ে মহান আল্লাহ ইবাদত তথা দাসত্বের যে শিক্ষায় তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ আল কুরআনে এরশাদ করেছেন, “স্মরণ করুন! যখন তাকে তাঁর পালনকর্তা বললেন, আত্নসমর্পণ কর। সে বলল আমি বিশ্ব প্রতিপালকের প্রতি আত্ন সমর্পণ করলাম। এরই অছিয়ত করেছিল ইবরাহীম তাঁর সন্তানদের এবং ইয়াকুবও তোমরা অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত বরণ করো না। তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে যখন ইয়াকুবের ইন্তিকালের সময় ঘনিয়ে আসে। যখন সে সন্তানদের বলল আমার পরে তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা বলল আমরা আপনার প্রভু এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের প্রভুর ইবাদত করব। যিনি একক ইলাহ এবং আমরা সবাই তাঁর প্রতি সমর্পিত। (সূরা: আল বাক্বারা, আয়াত: ১৩৩)

প্রতিকূল পরিবেশেও আল্লাহর ফয়সালার উপর অটল ছিলেন:

হযরত ইয়াকুব (.) প্রতিকূল পরিবেশেও আল্লাহ প্রদত্ত বিধান ও ফায়সালার উপর অটল অবিচল ও দৃঢ় থাকার নীতি অবলম্বন করেছেন। সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর নির্ভরতা ছিলো তাঁর দাওয়াতী নীতি ও কর্ম পদ্ধতির কৌশল। তিনি তাঁর সন্তানদের কে মিসরে প্রেরণের প্রাক্কালে সন্তানদেরকে শরয়ী বিধান ও আইন কানুন শিক্ষা দিয়ে ছিলেন, পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহর কোনো বিধান থেকে আমি তোমাদেরকে রক্ষা করতে পারিনা। নির্দেশ একমাত্র আল্লাহরই, তাঁরই উপর আমি ভরসা করি এবং তাঁরই উপর ভরসা করা উচিত ভরসাকারীদের। (সূরা: ইউসূফ, আয়াত: ৬৭)

নবীগণ জ্ঞান বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ পারদর্শী:

ওহীর জ্ঞানই পূর্নাঙ্গ জ্ঞান, নবীগণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্য সম্পর্কে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানে পরিপূর্ণ জ্ঞানী। অনেক লোকেরা আল্লাহ নবীগণ ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জ্ঞানকে অস্বীকার করে, হযরত ইয়াকুব (.) ‘ইউসূফ আলাইহিস সালাম এর অতীত ও ভবিষ্যতের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ইয়াকুব আলাইহিস সালাম নিজেই হযরত ইউসুফ (.) এর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেছিলেন। হযরত ইয়াকুব (.) জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কৌশল অবলম্বন করে দ্বীন প্রচারে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। (তাফসীরে নুরুল ইরফান, সূরা: ইউসূফ ৬৮ নং আয়াত সংশ্লিষ্ট তাফসীর)

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর সে ছিল এমন জ্ঞানের অধিকারী যা আমি তাঁকে শিখিয়েছি কিন্তু অনেক মানুষ তা অবগত নয়। (সূরা: ইউসূফ, আয়াত: ৬৮)

নবীগণের অনুসারীদের কোন শঙ্কা নেই:

আল্লাহর নবীরাসূলগণের আনুগত্য ও অনুসরণ করা ফরজ। তাঁদের আদেশ নিষেধ অমান্য করা, বিরোধী তা করা কুফুরী। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণে রয়েছে মানব জাতির মুক্তি ও পরকালীন সুখময় জান্নাত। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন “আমি রাসূলগণকে প্রেরণ করিনা কিন্তু সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শকরূপে। অতঃপর যে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সংশোধিত হয় তাঁদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবেনা। (সূরা: আল আনআম, আয়াত: ৪৮)

হে আল্লাহ আমাদেরকে হযরাতে আম্বিয়া কেরামের আদর্শ অনুস্মরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমিন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

 

মুহাম্মদ ফউজুল কবীর

আমান বাজার, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: কিছু মুসল্লী দেখা যায় ফরজ নামাযের আগে ও পরে যেসব “সুন্নাতে মুআক্কাদাহ” নামায রয়েছে তা আদায় করেনা এ বিষয়ে জানালে কৃতার্থ হব।

প্রশ্নের উত্তর: যে সুন্নাতের ব্যাপারে শরীয়তে তাগিদ রয়েছে বিনা ওজরে একবারও বর্জন করলে গুনাহগার হবে বর্জনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে ফাসিক, শরয়ী বিধানে তার সাক্ষ্য পরিত্যাজ্য, ইমামগণের মতে তাকে পথভ্রষ্ট হিসেবে গণ্য করা হবে। সুন্নাতে মুআক্কাদাহ বর্জনকারী নবীজির শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হবে। যেসব নামায সুন্নাতে মুআক্কাদাহ তা হলো:

ফজরের নামাজের পূর্বে দু’রাকাত। জোহরের নামাযের পূর্বে চার রাকাত ও পরে দু’রাকাত।

মাগরীবের নামাজের পরে দু’রাকাত। এশার নামাযের পরে দু’ রাকাত। জুমার নামাযের পূর্বে চার রাকাত এবং পরে চার রাকাত। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত ৪র্থ খন্ড, পৃ: ২২, ফিকহর কিতাব সমূহ)

পূর্ববর্তী নিবন্ধফরমালিনমুক্ত খাদ্য : নিরাপদ জীবনের পূর্বশর্ত
পরবর্তী নিবন্ধইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস এর আইসিএমএবি বেস্ট কর্পোরেট অ্যাওয়ার্ড লাভ