হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম’র দ্বীনি দাওয়াত
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহকে ভয় করুন, জেনে রাখুন পৃথিবীতে নবী–রাসূল আলাইহিমুস সালাম’র আগমনের অন্যতম লক্ষ্য মানব জাতিকে আল্লাহর প্রদত্ত শিক্ষা ও হিদায়াতের পথে আহবান করা। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মোট ৬০ বার পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের নির্দেশ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত সকল নবী–রাসূলগণই আল্লাহর বান্দাগণকে তাওহীদ তথা একত্ববাদের দাওয়াত দিয়ে গেছেন। তাঁদের দ্বীনি দাওয়াত ও প্রদত্ত হিদায়তে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত। আমরা মুসলমানরা নবী–রাসূলদের কারো মধ্যে পার্থক্য করিনা অর্থাৎ কোন নবীকে মান্য করবো ও কোন নবীকে মান্য করবোনা এমন নয়। আমরা আল্লাহর মনোনীত সকল নবী–রাসুলগণকেই মান্য করি।
হযরত সালেহ (আ.)’র পরিচয়:
হযরত সালেহ (আ.) একজন আল্লাহর নবী। তাঁর নাম সালেহ ইবনে ওবায়দ ইবনে আসিফ ইবনে ফাসিহ ইবনে ওবায়দ ইবনে হাযির ইবনে সামুদ। আল্লাহ তা’আলা সামুদ জাতির হিদায়াতের উদ্দেশ্য তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন নূহ (আ.)’র পুত্র সামের বংশধর। সামূদ সম্প্রদায় আদ সম্প্রদায়ের পরে হয়েছে, সালেহ (আ.) পৃথিবীতে হুদ (আ.)’র পরে আগমন করেন। (তাফসীর রুহুল বয়ান, কানযুল ঈমান ও তাফসীরে নূরুল ইরফান, সূরা: আল আ’রাফ, ৭৩ নং আয়াত সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা।)
পবিত্র কুরআনের ৩টি সূরার ৮ জায়গায় হযরত সালেহ (আ.)’র নাম উল্লেখ হয়েছে। তিনি সামুদ জাতির নিকট ইসলাম প্রচার করেন। তিনি পথভ্রষ্ট জাতিকে কুফর, শির্ক ও মূর্তিপুজা ত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান করেছেন। আদ জাতির ধ্বংশের প্রায় ৫০০ বছর পরে হযরত সালেহ (আ.) সামুদ জাতির নবী হিসেবে প্রেরিত হন। সামুদ জাতির বসবাস ছিল সৌদি আরবের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে হিজর নামক স্থানে।
স্থানটি “মাদায়েনে সালেহ” নামে পরিচিত। হযরত সালেহ (আ.) ও তাঁর দ্বীনি দাওয়াত এবং তাঁর অবাধ্য জাতির আচরণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ২২টি সূরায় ৮৭টি আয়াতে আলোকপাত হয়েছে। সামুদ জাতি ছিল শক্তিশালী বীরের জাতি। প্রস্তর খোদাই ও স্থাপত্য বিদ্যায় তাঁরা পারদর্শী ছিল। সমতল ভূমিতে বিশালাকায় অট্রালিকা প্রকৗষ্ট নির্মাণে তাঁদের দক্ষতা ও পারদর্শিতা ইহিতাস স্বীকৃত। মদীনা ও তাবুকের মাঝখানে মদীনা থেকে প্রায় ৩৫০ কি.মি. দূরে “মাদায়েনে সালেহ” নামক এলাকাটি অভিশপ্ত অঞ্চল হওয়ায় কেউ সেখানে বসবাস করেনা। এ স্থানে সামুদ জাতির উপর আল্লাহর গযব নাযিল হয়েছিল। ৯ম হিজরিতে তাবুক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরিয়া ও হিজাযের মধ্যবর্তী “হিজর” নামক স্থান অতিক্রম কালে সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দেন কেউ যেন ঐ অভিশপ্ত এলাকায় প্রবেশ না করে সেখানকার কুপের পানি কেউ পান না করে ও ব্যবহার না করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৩১)
আল কুরআনের আলোকে হযরত সালেহ (আ.)’র দ্বীনি দাওয়াত:
সামুদ জাতি তাদের পূর্ববর্তী আদ জাতির মতো মুশরিক ছিল। আদ জাতির পর সামুদ জাতির উম্মেষ ঘটেছিল। তারা পাহাড় কেটে কেটে বিশাল বিশাল প্রসাদ নির্মাণ করতো তারা নিজেদেরকে শক্তিশালী মান করতো, কুফর শির্ক ও সীমা লংঙ্গনের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ অবাধ্য জাতিকে হেতায়াতের জন্য আল্লাহ তা’আলা তাদের মাঝে হযরত সালেহ (আ.) কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন। হযরত সালেহ (আ.) স্বীয় কওমের লোকদেরকে আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্ববাদের প্রতি দাওয়াত দেন। তিনি তাদেরকে অপরাধ কর্ম থেকে ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থেকে তাওবা ইস্তেগফার ও তাকওয়া অবলম্বনের উপদেশ দেন। দ্বীনের পথে তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন দাওয়াতী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। খোদায়ী গযবের বিভিন্ন প্রকৃতি ও ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদেরকে অব্যাহতভাবে সতর্ক ও সাবধান করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “আর সামুদ জাতির নিকট আমি তাদের ভাই সালেহকে পাঠালাম। তিনি বললেন হে আমার কওম একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপাস্য নেই। তিনিই তোমাদেরকে জমিন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে তোমাদেরকে আবাদ করেছেন। তারপর তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাও। তারপর তাঁর কাছে ফিরে আসে, নিশ্চয়ই আমার রব নিকটে আছেন এবং তিনি দুআ কবুল করেন, তারা বলল হে সালেহ এর আগে তুমি আমাদের মধ্যে এমন এক ব্যাক্তি ছিলে যার উপর আমাদের বড় আশা ছিল। আমাদের বাপ দাদা যেসব মা’বুদের পুজা করত তুমি কি আমাদেরকে তাদের পুজা করা থেকে নিষেধ করতে চাও? তুমি আমাদেরকে যে দিকে ডাকছ সে বিষয়ে আমাদের খুব সন্দেহ রয়েছে, যা আমাদেরকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সালেহ বললেন, হে আমার কাওম, তোমরা ভেবে দেখ, আমি যদি আমার রবের কাছ থেকে এক স্পষ্ট সাক্ষ্যের উপর কায়েম হয়ে থাকি এবং তিনি তাঁর খাস রহমত দিয়ে যদি আমাকে ধন্য করে থাকেন এ অবস্থায় আমি যদি তাঁর নাফরমানি করি তাহলে কে আমাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচাবে? আমাকে আরো বেশি ক্ষতির মধ্যে ফেলা ছাড়া তোমরা আমার আর কোন কাজে আসতে পর? (সুরা: হুদ, ৬১–৬৩)
সালেহ (আ.)’র মু’জিযা:
নবী রাসূলগণ জাতির পথ প্রদর্শক, তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে শত প্রতিকুলতা প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মানুষের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের মহান দায়িত্ব পালনে সদা সর্বদা তাঁরা অটল অবিচল ছিলেন। অবাধ্য জাতির পক্ষ থেকে নবীদের অঙ্গীকার করা হলে মু’জিযা প্রদর্শনের মাধ্যমে খোদা প্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতার বহি:প্রকাশ ঘটাল। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে হযরত সালেহ (আ.) এর বিস্ময়কর মু’জিযার উল্লেখ রয়েছে এ মু’জিযা কে উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় তোমাদের কাছে তোমাদের রবের নিকট থেকে উজ্জ্বল নিদর্শন এসেছে, এটা “আল্লাহর উটনি” তোমাদের জন্য নিদর্শন। (সূরা: আ’রাফ, আয়াত: ৭৩)
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইযার খান নাঈমী (রহ.) প্রণীত কানযুল ঈমান ও তাফসীরে নুরুল ইরফানে নিম্নোক্ত মু’জিযা উল্লেখ রয়েছে। সামুদ সম্প্রদায়ের সরদার জুনদা ইবনে আমর হযরত সালেহ (আ.)’র দরবারে আরজ করেছিল আপনার নবী দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে তবে পাহাড়ের এই এ পাথর থেকে একটি উটনি বের করে আনুন, আমরা আপনার মু’জিযা দেখে ঈমান গ্রহণ করবো, হযরত সালেহ (আ.) নিজ দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য মহান রবের দরবারে প্রার্থনা করলেন, সবার সামনে পাথর দ্বিখন্ডিত করলেন, পাথর থেকে একই আকৃতির একটি উটনী বের হয়ে আসলো পাথর থেকে উষ্টীটি বের হওয়া মাত্রই সমান আকৃতির একটি বাচ্ছা প্রসব করলো, এটা দেখে সরদার ও তাঁর বিশেষ সঙ্গীরা ঈমান আনলো হতভাগা অবশিষ্ট লোকেরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলো। (তাফসীর রুহুল বয়ান)
কওমে সামুদ উষ্টীকে হত্যা করলো:
সামুদ জাতির লোকেরা যে কূপ থেকে পানি পান করত ও তাদের গবাদি পশুদের পানি পান করাত এ উষ্টীও সে কূপ থেকে পানি পান করত। উষ্টী যে দিন পানি পান করত সেদিন কূপের পানি নিঃশেষে পান করে ফেলত, উষ্টী যখন ময়দানে বিচরণ করত তার বিশাল দেহ ও অপরূপ চেহারা দেখে অন্যান্য গবাদি পশু ভয় পেত। ফলে তারা উষ্টীকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। তাফসীরকার ইবনে জারীর এর বর্ণনামতে তারা পথভ্রষ্ট এক যুবককে উষ্টী হত্যায় রাজি করাল, অতঃপর তীর ও তরবারীর আঘাতে উষ্টীকে পা কেটে হত্যা করে ফেলল, এ অপরাধের কারণে গোটা সামুদ জাতি আল্লাহর গযবে পতিত হলো, হযরত সালেহ (আ.) তাদের ধ্বংস হওয়ার ব্যাপারে তিন দিনের সময় নির্ধারণ করে দিলেন। বিভিন্ন প্রকৃতির গযবের সূচনা হল, বৃহস্পতিবার ভোরে সামুদ জাতির অবিশ্বাসীদের মুখমন্ডল গভীর হলুদ বর্ণ ধারণ করল, দ্বিতীয় দিন মুখমন্ডল লাল বর্ণ, তৃতীয় দিন ঘোর কৃঞ্চ বর্ণ ধারণ করল। অতঃপর ভীষণ ভূমিকম্প শুরু হলো অবিশ্বাসীরা ধ্বংশ প্রাপ্ত হয়েছিল। হযরত সালেহ (আ.) ও তাঁর ঈমানদার অনুসারীদের আল্লাহ আযাব থেকে নাজাত দান করেছিলেন। (তাফসীর তাবারী, খন্ড: ১৯, পৃ: ৪৭৮)
তাফসীরকার আল্লামা আলুসী (রহ.)’র বর্ণনামতে হযরত সালেহ (আ.) আটান্ন বছর বয়সে মক্কা শরীফে ইন্তিকাল করেন। কাবা গৃহের পশ্চিম পাশে প্রায় চার হাজার কবর ছিল, হযরত সালেহ (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের কবর সেখানে রয়েছে মর্মে কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে। (রুহুল মা’আনী, ৮ম খন্ড, পৃ: ১৬৮), হে আল্লাহ! আমাদেরকে নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম এর আদর্শ অনুস্মরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।










