জুম্‌’আর খুতবা

হযরত হুদ আলাইহিস সালাম’র দ্বীনি দাওয়াত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৭ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

নবীরাসূল আলাইহিমুস সালামদের প্রেরণের উদ্দেশ্য:

মহান আল্লাহ নিখিল বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা। মানুষ তাঁরই সৃষ্টি। আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপনেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, আল্লাহর দাসত্ব ও তাঁরই ইবাদত করা ঈমানের একমাত্র দাবী। নবী রাসূলগণের প্রদত্ত জীবন বিধানই একমাত্র অনুকরণীয়। নবী রাসুলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে পথ প্রদর্শক। নবী রাসূল গণ মানব জাতির আদর্শ শিক্ষক, নবী রাসূল গণের প্রদত্ত শিক্ষা অনুসরণেই রয়েছে মানুষের সাফল্য ও মুক্তি। তাঁরা ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। নবী রাসূলগণ মানব জাতিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে পরিচালিত করেছেন, আল্লাহকে অত্যাধিক ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছেন সর্দাসর্বদা, দিনেরাতে, প্রকাশ্যেঅপ্রকাশ্যে, সকালসন্ধ্যায় একমাত্র আল্লাহকে স্মরণ করার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা না করা ও কারো কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা দিয়েছেন, সুখেদুখে, বিপদে, সংকটে, আল্লাহর উপর ভরসা করার শিক্ষা দিয়েছেন, আল্লাহর প্রশংসা, গুণগান, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও আল্লাহর মহানত্ব শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ এবং একমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন।

মহাগ্রন্থ আলকুরআনে হুদ (.)’র দ্বীনি দাওয়াতের বর্ণনা:

পৃথিবীর দেশে দেশে দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে দ্বীন প্রচার হয়েছে। নবী রাসূলগণ দ্বীনি দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করেছেন। কুফর, শির্ক ও মূর্তিপুজার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন, নবী রাসূলগণ খোদাদ্রোহী কুফরীশক্তির সাথে কখনো আপোষ করেননি। পার্থিব স্বার্থ সিদ্ধির জন্য দ্বীনের আদর্শকে বিন্দুমাত্র জনাঞ্জলি দেন নি। আল্লাহ তা’আলা হযরত হুদ (.)’র দ্বীনি দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন যে, “আর আদ সম্প্রদায়ের নিকটে আমি তাদের ভাই হুদকে প্রেরণ করেছিলাম, সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ব্যাতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। অতঃপর তোমরা কি আল্লাহভীরু হবে না? তার সম্প্রদায়ের কাফির নেতারা বলল আমরা তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত দেখতে পাচ্ছি। এবং আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করি। হুদ বলল! হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোন নির্বুদ্ধিতা নেই বরং আমি বিশ্ব প্রতিপালকের প্রেরিত একজন রাসূলমাত্র। আমি তোমাদের নিকট প্রতিপালকের পয়গামসমূহ পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের হিতাকাঙ্খী ও বিশ্বস্ত। (সূরা: আলআরাফ, আয়াত:৬৫৬৯)

নবী রাসূলগণ দাওয়াতী কাজে পার্থিব বিনিময় গ্রহণ করেন নি। নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম ছিলেন নির্লোভ নির্মোহ, তাঁদের অন্তরে ছিলনা, লোভ ও পার্থিব মোহ, দ্বীনের দায়িত্ব পালনে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণরূপে একনিষ্ঠ ও নিবেদিত প্রাণ, অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা হযরত হুদ (.) সম্পর্কে এরশাদ করেন, “আর আদ জাতির প্রতি তাদের ভাই হুদকে প্রেরণ করেছিলাম সে তাদেরকে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো মাবুদ নেই, বস্তুত তোমরা সবাই এ ব্যাপারে মিথ্যাচার করছ। হে আমার জাতি,আমার এ দাওয়াতের জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনোরূপ বিনিময় চাইনা, আমার প্রতিদান তাঁরই কাছে রয়েছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমরা কি বুঝনা? হে আমার জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তারই দিকে ফিরে যাও। তিনি আসমান থেকে তোমাদের ওপর বারিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন, তোমরা অপরাধীদের ন্যায় মুখ ফিরিয়ে নিও না। (সূরা: হুদ, আয়াত: ৫০৫৫)

হযরত হুদ (.)’র বংশ পরিচয়:

পবিত্র কুরআনের ১১তম সূরার নাম “সূরা হুদ”। হযরত হুদ (.) ছিলেন আল্লাহর একজন নবী। হুদ (.) ছিলেন নূহ (.)’র বংশধর। তিনি নূহ (.)’র পঞ্চম অথবা অষ্টম অধস্তন পুরুষ। হুদ (.) আদ জাতির নিকট নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন, আদ জাতি ও ছামুদ জাতি ছিল নূহ (.)’র পরবর্তী বংশধর, আদ সম্প্রদায়ের ১৩টি গোত্র ছিল আম্মান থেকে শুরু করে হাযারা মাউত ও ইয়েমেন পর্যন্ত তাদের বসবাস ছিল। আরবের প্রাচীন অধিবাসীদের আরবে বায়িদা বলা হয়, যাদের গোত্রগুলোর নাম হচ্ছে আদ, ছামুদ, আবীল, আমালিকা, তাসাম, জুরহাম, প্রভৃতি এরা সকলেই হযরত নূহ (.)’র পৌত্র সামের বংশধর ছিল। আদ গোত্রটি ছিল অত্যন্ত প্রসিদ্ধ দীর্ঘাকৃতি, দৈহিক শক্তি পাথরছেদন শিল্পে তাদের বিশেষ খ্যাতি ছিল এরা আহকাফ সমতলে বসবাস করতো। তাফসীরে কাশশাফের প্রণেতা “আল্লামা যামাখশরীর” বর্ণনা মতে জানা যায় সামের প্রাপৌত্র আদ ইবন আউস ইবন ইরাম এর তিন পুত্র ছিল ১. শাদ্দাদ, . শাদীদ, . ইরাম, এরা একের পর এক রাজত্বের অধিকারী হন। ঐতিহাসিক মাসউদী বর্ণনা করেন, আদ ইবনে আওস দামেশ বিজয় করে মর্মর পথর ও অন্যান্য বহু মূল্যবান পাথর দিয়ে বিশাল এক প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল যার নামকরণ করেছিল ইরাম। শাদ্দাদ ইবনে আদ আদন মরুভূমিতে ইরাম নগরীর পত্তন করেছিল। আল্লাহ তা’আলা আদ জাতির হেদায়াতের জন্য হযরত হুদ (.) কে নবীরূপে প্রেরণ করেন, তিনি তাদেরকে অনবরত তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন। তারা নবীর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করেন, দৈহিক শক্তির কারণে জুলম, নির্যাতন, পাপাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতায় লিপ্ত হয়। কুফর শির্ক ও মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়ে আল্লাহর অবাধ্যতায় সীমা লঙ্ঘন করতে থাকে। এ অবাধ্য জাতি আল্লাহর নবী হযরত নূহ (.)’র কথায় কর্ণপাত করলনা। পৃথিবীতে তাদের চেয়ে বড় শক্তিধর কে আছে? এমন অহংকারের কারণে তাদের উপর আল্লাহর গযব আযাব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। নবীর প্রতি আনুগত্য না করার কারনে তাদের উপর যে ধ্বংশাত্মক পরিণতি হয়েছিল আল্লাহ তা’ আলা এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, তারা (আদ ও ছামুদের লোকেরা) বলেছিল আমাদের প্রভু ইচ্ছে করলে অবশ্যই ফেরেশতা পাঠাতেন। অতএব আমরা তোমাদের আনীত বিষয় অমান্য করলাম। অতঃপর আদ এর লোকেরা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করল এবং বলল, আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিধর কে আছে তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর? বস্তুত: তারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করত। অতঃপর আমি তাদের উপর প্রেরণ করলাম প্রচন্ড শীতল বায়ু। তাদের অশুভ দিনগুলোর মধ্যে যাতে তাদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনার কিছু আযাব আস্বাদন করা যায়। আর পরকালের আযাব তো আরো লাঞ্ছনাকর, যেদিন তারা কোনোরূপ সাহায্য প্রাপ্ত হবেনা। (সূরা: হামীম, আসসাজদাহ, ১৪১৬)

বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায়:

হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ারখান নঈমী (রহ.) “তাফসীরে নূরুল ইরফানে” বর্ণনা করেন, তারা মানবীয় আকৃতিতে পৃথিবীতে নবী প্রেরণকে অস্বীকার করতো, তারা বলতো যদি মহান বর কাউকে নবী বানাতেন তবে ফেরেস্তাদেরকেই বানাতেন। আমাদের মতো মানুষকে বানাতেন না অথচ নবুওয়ত হচ্ছে মানবসূলভ যোগ্যতার চেয়ে বহু উর্ধ্বের যোগ্যতা ও মর্যাদা। এরা মূর্তি পূজা করতো, মহান রবকে অস্বীকার করতো, মানবীয় আকৃতিতে নবীদেরকে মেনে নিতে পারতো না। অহংকার বশত: আল্লাহর মকবুল বান্দা নবীদেরকে অস্বীকার করত, মহান আল্লাহ বড় বড় শক্তিমান লোকদেরকে প্রচন্ড শীতল বায়ু বজ্রাঘাত দিয়ে ধ্বংস করে দেন যে ভাবে মহান রব মা’মুলি জিনিস দ্বারা নমরূদকে মশার মাধ্যমে, আবরাহার হস্তবাহিনীকে আবাবিল পাখি দ্বারা ধ্বংস করেছেন। (সূরা: ৪১, হামীম, আসসাজদাহ, কানযুল ঈমান ও তাফসীর নুরুল ইরফান, পৃ: ১২৮০)

আদ সম্প্রদায়ের উপর খোদায়ী গযব:

২২ শাওয়াল বুধবার থেকে আরম্ভ হয় আর তা আটদিন সাত রাত পর্যন্ত স্থায়ী হয় ২৯ শাওয়াল পর্যন্ত আযাব অব্যাহত থাকে। (রুহুল বয়ান)

হযরত হুদ (.) কে অমান্যকারী জাতির উপর খোদায়ী গযব:

হযরত মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, আদ জাতির অমার্জনীয় ধৃষ্টতা ও হঠকারিতার কারণে আল্লাহ তা’আলা গযব হিসেবে উপর্যপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেন, তাদের শষ্যক্ষেত সমূহ মরুভূমিতে পরিণত হয়। সাত রাত ও আটদিন ব্যাপী অনবরত ঝড় তুফান মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রাঘাতে বাড়িঘর ধ্বংসস্তুপে পরিণতি হয়, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বৃক্ষরাজি উপড়ে যায়। শক্তিশালী ও সুঠামদেহের অধিকারী এ জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গযব নাযিলের পূর্বেই আল্লাহ তাঁর নবী হযরত হুদ (.) ও ঈমানদার লোকদের কে উক্ত এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার নির্দেশ দেন, ঈমানদারগণ, আযাব থেকে রক্ষা পান, হযরত হুদ (.) মক্কায় চলে যান, সেখানেই ওফাত প্রাপ্ত হন। (তাফসীরে কুরতুবী)

আল্লামা ইবনে কাছীর হযরত আলী (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, হযরত হুদ (.) ইয়েমেনেই ওফাত প্রাপ্ত হয়েছেন, সেখানেই কবরস্থ হয়েছেন। (কাসাসুল আম্বিয়া কৃত: আল্লামা ইবন কাছীর, পৃ: ৫০।)

হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের ঈমানে পূর্ণতা দান করুন। আমাদের ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম’র জীবনাদর্শের শিক্ষণীয় বিষয় আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

 

আবদুল মাজেদ আনোয়ারি

চাতরি চৌমুহনী, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: জানাযা নামাযের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জানলে কৃতার্থ হব।

উত্তর: জানাযা নামায ফরযে কেফায়া, একজনও যদি আদায় করে সবই দায়িত্বমুক্ত হবে। অন্যথায় সংবাদ প্রকাশের পর কেউ আদায় না করলে সবাই গুনাহগার হবে। প্রত্যেক মুসলমানের জানাযা নামায পড়া যাবে, যদিও বা যেকোন প্রকার গুনাহগার হোক না কেন? আত্ন হত্যা করা কবীরা গুনাহ, তবুও এর জানাযা পড়া যাবে। জানাযার শর্ত হল, মৃত ব্যক্তি, মুসলমান হতে হবে। মৃত ব্যক্তির শরীর পবিত্র হওয়া, তাকে গোসল দিতে হবে। গোসল বিহীন জানাযা পড়লে হবেনা। মৃত ব্যক্তি উপস্থিত থাকা অনুপস্থিত গায়েবানা জানাযা জায়েজ নেই। জানাযা বা লাশ নামাযীর আগে হওয়া, মৃত ব্যক্তি ইমামের সামনা সামনি রাখতে হবে। জানাযা নামাজের রুকন দু’টি। ১. চার তাকবীর বলা, . দাঁড়িয়ে নামায পড়া, বসে জানাযা পড়লে হবে না। জানাযা নামাযে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ তিনটি। ১. ছানা পড়া, . রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর দরুদ শরীফ পড়া, . মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করা। (দুররুল মুখতার, রদ্দুল মুখতার, আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ১৯৩১৯৪)

পূর্ববর্তী নিবন্ধতওবার আলোকিত দরজা : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাঃ) এর জীবনের শিক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধজুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা জুলাইযোদ্ধার