জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ

শাফায়াত শব্দের অর্থ:

শাফায়াত শব্দটি আরবি, এর অর্থ, কারো পক্ষে তদবীর করা, মধ্যস্থতা করা, এটি ধর্মীয় পরিভাষা। পবিত্র কুরআনে শাফায়াত বহু স্থানে ব্যবহার হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যার জন্য অনুমতি দেয়া হয় তার জন্য ব্যাতীত আল্লাহর কাছে কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবেনা।” (সূরা: সাবা, আয়াত: ২৩)

আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, “যে দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে সে ব্যাতীত আর কেউ সুপারিশ করার ক্ষমতা রখবেনা।” (সূরা: মরয়াম, আয়াত:৮৭)

আল্লামা ইবনুল আছীর (.) এর বর্ণনা মতে শাফায়াত হচ্ছে গুনাহসমূহ ও অপরাধের শাস্তি থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা। (নিহায়া, খন্ড:, পৃ: ৪৮৫)

আল কুরআনের আলোকে রাসূলুল্লাহর শাফায়াত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাফায়াতের সুমহান মর্যাদার অধিকারী হওয়া আল কুরআনের অসংখ্য আয়াতের আলোকে প্রমাণিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে এমনস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন যেখানে সবাই আপনার প্রশংসা করবে। (সূরা: আল ইসরা, আয়াত: ৭৯)

বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর বানী “মাক্বামে মাহমুদ” হলো “মাক্বামে শাফায়াত” তথা সুপারিশ করার স্থান। (তাফসীর তাবারী, ১৫/৪৪)

মাক্বামে মাহমুদ” এর ব্যাখ্যায় হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো নবীজি বলেন “মাক্বামে মাহমুদ” হলো সেই স্থান যেখানে আমি আমার উম্মতের জন্য সুপারিশ করতে থাকব। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৯৬৮৪)

ইমাম আলী ইবন ওয়াহিদী (.) বর্ণনা করেন, “মাক্বামে মাহমুদ হলো সুপারিশ করার স্থান যেখানে সমস্ত সৃষ্টি নবীজির প্রশংসা করবে। (তাফসীরে ওয়াহিদী, খন্ড:, পৃ: ৬৪৪)

নবীজি শাফায়াতের মালিক: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য শাফায়াতের অনুমতি প্রাপ্ত ও ক্ষমতা প্রাপ্ত। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে, এবং যখন তারা নিজেদের আত্মার প্রতি যুলম করে তবে হে মাহবুব (তারা) আপনার দরবারে হাজির হয় অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে আর রাসূল তাদের শাফায়াত করেন তবে অবশ্যই আল্লাহকে অত্যন্ত তাওবা কবুলকারী দয়ালু পাবে। (সূরা: নিসা, আয়াত: ৬৪)

বর্ণিত আয়াতে মুসলমানদেরকে এরশাদ করা হচ্ছে যদি তোমাদের থেকে কোন গুনাহ প্রকাশ পায় তোমরা নবীজির দরবারে উপস্থিত হয়ে যাও তাঁর কাছে শাফায়াতের আবেদন পেশ করো, যদি আমার প্রিয় রাসূল তোমাদের জন্য সুপারিশ করে তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিব। (ইমাম আহমদ রেযা, এসমাউল আরবাঈন ফী শাফায়াতি সাইয়্যিদিল মাহবুবীন)

নবীজির শাফায়াতে উম্মত জান্নাতে যাবেন: কিয়ামতের কঠিন মুহূতে রহমতের নবী, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে অপরিসীম ও অতুলনীয় মর্যাদার অধিকারী হবেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, অচিরেই আপনার প্রভূ আপনাকে এতো পরিমাণ দিবেন যে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।

(সূরা: আদ্ব দুহা, আয়াত: )

ইমাম দায়লামী (.) প্রণীত “মুসনাদুল ফেরদৌসে” আমীরুল মু’মিনীন মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবীজি এরশাদ করেন, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হবনা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার একজন উম্মতও জাহান্নামে থাকবে। (তাফসীরে দুররে মানসুর, খন্ড:, পৃ: ৩৬১)

মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমি আমার উম্মতের জন্য এমনভাবে শাফায়াত করতে থাকব, এমনকি পরিশেষে আল্লাহ বললেন হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি কি এখন সন্তুষ্ট তখন আমি আরজ করব হে আমার রব, হ্যাঁ আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। (ইমাম আহমদ রেযা (.) এসমাউল আরবাঈন ফী শাফায়াতি সাইয়্যিদিল মাহবুবীন, ইমাম যাহাবী (.) ইসবাতুশ শাফাআত)

হাদীস শরীফের আলোকে শাফায়াত:

দুনিয়ার খ্যাতিমান বড় বড় প্রতাপশালী রাজা বাদশাহগণ, শরীয়তের বিধান লঙ্ঘনকারী পার্থিব জীবনে জুলুম নির্যাতন মিথ্যাচার পাপাচার অশ্লীলতা নানাবিধ অন্যায় কাজে জড়িত অসংখ্য ব্যক্তিবর্গের জন্য সেদিন জাহান্নাম অপরিহার্য হয়ে যাবে। সেই কঠিন বিপদের মুহূর্তে নিজের গুনাহগার উম্মতের জন্য প্রিয় নবীজি মহান আল্লাহর নিকট সুপারিশের অনুমতি প্রার্থনা করে সুপারিশ করবেন, নবীজির সুপারিশের ভিত্তিতে আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য কবীরা গুনাহকারী বান্দাকে ক্ষমা করবেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস ইবনু মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কিয়ামত দিবসে আমার শাফায়াত আমার উম্মতের মধ্যে ঔইসব লোকদের জন্য যারা কবীরা গুনাহকারী। (আবু দাউদ, হাদীস: ৪৭৩৯)

কিয়ামত দিবসে নবীজির শাফায়াত সর্ব প্রথম গৃহীত হবে:

যারা ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর মহান রাসূলের সুমহান মর্যাদাকে খাটো করে দেখে। নবীজির শানে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে, নবীজির অতুলনীয় মর্যাদার প্রতি অবমাননা করে সভা সেমিনারে বক্তৃতার মঞ্চে নবীজিকে সাধারণভাবে উপস্থাপন করে থাকে, তারা অভিশপ্ত। পরকালে তারা নবীজির শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের ময়দানে নবীজির শান ও অপরিসীম মর্যাদার প্রকাশ ঘটাবেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কিয়ামত দিবসে আমি হব রাসূলগণের নেতৃত্বদানকারী এতে আমার কোনো অহংকার নেই, আমি হব নবীদের আগমনের ধারা সমাপ্তকারী, এটা আমার কোনো গর্ব নয়, আমি হব প্রথম শাফায়াতকারী এবং আমার শাফায়াত কবুল করা হবে। এতে আমার কোন অহংকার নেই। (সুনানু দারেমী, হাদীস: ৫০)

কিয়ামত দিবসে নবীজির অসাধারণ মর্যাদা: অসহায় উম্মতের সহায়, পাপী তাপী গুনাহগার উম্মতের কল্যাণকামী নবী কিয়ামতের দিন, উম্মতের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবেন, হযরত আনাস ইবন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমিই সর্ব প্রথম কবর হতে উত্থিত হব, আমি সকলের ইমাম হব, যখন তারা আল্লাহর সমীপে উপস্থিত হবে, তখন তারা নীরব থাকবে আমিই হব তাদের মুখপাত্র। আমিই হব তাদের সুপারিশকারী যখন তারা আটকে যাবে। আমিই তাদের সুসংবাদ প্রদান করব, যখন তারা হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়বে, মর্যাদা ও কল্যাণের চাবিসমূহ সেদিন আমার হাতে থাকবে, আল্লাহর প্রশংসার পতাকা সেদিন আমার হাতেই থাকবে। আমার প্রভুর কাছে আদম সন্তানদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে অধিক মর্যাদাবান ও সম্মানী ব্যক্তি হবো, সহস্র খাদিম আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করবে, তারা ডিম বা বিক্ষিপ্ত মনিমুক্তা। (তিরমিযী, মিশকাত, পৃ: ৫১৪)

কিয়ামত দিবসে নবীজি সিজদা থেকে মাথা মুবারক উত্তোলন করবেন: কিয়ামত দিবসে সকলে আদম (.)’র কাছে গিয়ে সুপারিশের আরয করবে, তিনি বলবেন, এটা আমার কাজ নয়, অতঃপর তারা হযরত নূহ (.) অতঃপর হযরত ঈসা (.) এর কাছে যাবেন, তাঁরা প্রত্যেকে পৃথকভাবে বলবেন এটা আমার জন্য প্রযোজ্য নয়, এক পর্যায়ে ঈসা (.) বলবেন বরং তোমরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে যাও। তিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তাঁর ওসীলায় আল্লাহ (উম্মতের) পূর্বের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাছে আসবেন, আমি তাদেরকে নিয়ে যাবো এবং আমার রবের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করবো আমাকে অনুমতি দেয়া হবে। আর আল্লাহর সাক্ষাতের সাথে সাথে আমি সিজদায় পড়বো তখন আল্লাহ বলবেন আপনার মাথা মুবারক উত্তোলন করুন, আপনি চান, আপনাকে দেয়া হবে, আপনি বলুন আপনার কথা শ্রবণ করা হবে। আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ কবুল করা হবে। (বুখারী, হাদীস: ৭৪১০)

কিয়ামতের দিন নবীজির শাফায়াত হবে ব্যাপক: কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে শাফায়াতে অসীম ক্ষমতা দান করবেন, সেদিন সুপারিশের ক্ষমতা সীমিত থাকবেনা, নবীজির মহানত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এটাই যে, তিনি যে, অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অপরিসীম গুণাবলীর ধারক কিয়ামত দিবসে তা সকলে প্রত্যক্ষ করবে। নবীজি এরশাদ করেছেন, “যমিনের উপর যতগুলো বৃক্ষ, পাথর, টিলা রয়েছে, আমি কিয়ামত দিবসে সেগুলোর চেয়েও অধিক পরিমাণ লোকের শাফায়াত করবো। (তাবরানী, হাদীস: ৫৩৬০, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদ, ইসলামী আকায়িদ, প্রথম খন্ড, পৃ: ৪৭৬)

রওজা শরীফ যিয়ারতকারীদের জন্য শাফায়াতের সুসংবাদ: মদীনা মনোওয়ারায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রওজা শরীফ যিয়ারত করা এক পুণ্যময় ইবাদত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে আমার রওজা শরীফ যিয়ারত করল তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে যাবে। (সুনানে দারে কুতনী, পৃ: ২৭৮), হে আল্লাহ আমাদের কিয়ামতের দিন আপনার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াত নসীব করুন। আমীন।

লেখক : মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম;

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুশিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব
পরবর্তী নিবন্ধরাহাত্তারপুল থেকে ছিনতাই চক্রের ১০ সদস্য গ্রেপ্তার