আল কুরআনের আলোকে নামায হলো মুক্তির পাথেয় : নামায মু’মিনের আত্নার প্রশান্তি। জান্নাতের চাবিকাঠি। দ্বীনের মৌলিক স্তম্ভ। ঈমানের নিদর্শন, মু’মিনের পরিচায়ক, ঈমান ও কুফরের পার্থক্য বিধানকারী মৌলিক ইবাদত। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নর–নারীর উপর নামায ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমিই আল্লাহ, আমি ব্যাতীত কোনো ইলাহ নেই, অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে সালাত কায়েম কর। (২০–সূরা,ত্বাহা: ১৪)
হাদীসে রাসূলের আলোকে রাসূলুল্লাহর সালাত আদায়ের পদ্ধতি : নামায আদায়ে রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন যেমন রফয়ে ইয়াদাইন, তথা হাত উঠানোর বিধান, ইমামের পিছনে মুক্তাদির কিরআত পাঠ করা ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিধান সংক্রান্ত আলোচনার লক্ষ্যে এ সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন। ১. “রফয়ে ইয়াদাইন” তথা নামাযে হাত উঠানো প্রসঙ্গে হাদীসের আলোকে ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাখ্যা মতে নামাযে প্রথম তাকবির বলার সময়ই হাত উঠাতে হবে। এ ছাড়া রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় উভয় হাত উত্তোলন করা সুন্নাতের পরিপন্থি। এভাবে সিজদায় যাওয়ার সময় এবং সিজদা হতে মাথা উঠানোর সময় হাত উঠানো যাবেনা। ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ দাবীর সমর্থনে দলীল হিসেবে অসংখ্য হাদীস পেশ করেছেন। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস এতদসংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হল, “হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি কি তোমাদেরকে রসূলুুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র কিভাবে সালাত আদায় করে দেখাব না? তখন তিনি সালাত আদায় করেন, কিন্তু তিনি সালাতের মধ্যে শুধু প্রথমবার ছাড়া তাঁর দু’হাত উঠালেন না। (আল্লামা মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান, ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার)
প্রথমত: হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে শীর্ষ ফকীহ সাহাবী হিসেবে প্রসিদ্ধ। দ্বিতীয়ত: তিনি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নামাযের পদ্ধতি একদল সাহাবীর সামনে পেশ করেছেন। তিনি কেবল প্রথম তাকবিরেই হাত উঠান। এতে কেউ আপত্তি করেননি। সকলেই সমর্থন করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের সকলেই রসূলুল্লাহ’র নামায দেখেছিলেন। উপস্থিত কেউ এ পদ্ধতি অস্বীকার না করাটা প্রমাণ করে যে, তাকবিরে তাহরীমা ছাড়া হাত উঠানো যাবে না। তৃতীয়ত: ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি ‘হাসান’ বলেছেন। সুতরাং ইমামুল আইম্মা ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ হাদীসকে দলীলরূপে উপস্থাপন করা যথাযথ যুক্তিযুক্ত ও বাস্তব সম্মত। (মুফতি আহমদ ইয়ার খান (রহ.) জা’আল হক, ২য় খন্ড, পৃ:৭৬)
তাবিয়ী হযরত আসওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে সালাত আদায় করেছি। তিনি শুধুমাত্র সালাত শুরু করার সময় ছাড়া সালাতের মধ্যে কোন সময়ে দু’হাত উঠাননি। (ইমাম ইবনে আবি শাইবা তাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
হযরত ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা ‘আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে সালাত আদায় করেছি, তাঁরা সালাত শুরু করার সময় ব্যতীত অন্য সময় তাঁদের হাত উঠাতেন না। (দারে কুতনী, আস সুনান, বাবু যিকরিত তাকবীরে ওয় রফঈ, ২:৫২, হাদিস, ১১৩৩)
বর্ণিত হাদীসে চারটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। ১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ তিনজনের প্রত্যেকেই রসূলুল্লাহ্র পেছনে নামায আদায় করেছেন। ২. রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রথম তাকবির ছাড়া হাত উঠাননি, এ কথাটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে অন্য সনদসূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ৩. হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নামাযের শুরু ব্যতীত দু’হাত উঠাননি। এটা কোন সুন্নাত পরিপন্থিও হয়নি। ৪. হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নামাযের শুরু ব্যতীত “রফএ ইয়াদাইন” করেননি। এ বিষয়টি ইমাম বোখারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর ওস্তাদ ইমাম ইবনে শায়বা এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম তাহাবী নিজ নিজ কিতাবে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।
হযরত জাবির ইবনে সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে বললেন, কী ব্যাপার আমি তোমাদেরকে বারবার হাত উঠাতে দেখেছি? তোমাদের হাতগুলো মনে হচ্ছে যেন সদা অর্স্থির চঞ্চল ঘোড়ার লেজের ন্যায়। এখন থেকে তোমরা সালাতের মধ্যে শান্ত থাকবে। ( মুসলিম, আস সহীহ, বাবুল আমরি বিস সুকূন ফীস সালাত, ২:৪২১, হাদিস: ৬৫১, আবু দাউদ, আস সুনান, বাবু ফীস সালাম, ৩:১৮৫, হাদিস: ৮৪৮)
তাকে এ কাজ থেকে বারন এবং বললেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রথমে দু’হাত উঠাতেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ২য় খন্ড, পৃ:২৫৫, বজলুল মজহুদ ২য় খন্ড, পৃ: ৮, ফতহুল মুসলিম ২য় খন্ড, পৃ:১৪)
হাকিম ও বায়হাকী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সাত স্থানে হাত উঠানো হবে, নামায শুরু করার সময়, ক্বাবার দিকে মুখ করার সময়, সাফা ও মারওয়ার পাহাড়ে দুই মাওকাফে তথা মিনা ও মুসদালিফায় এবং দু’জামারার সামনে। (আবু জাফর তাহাভী, শরহু মা’আনিয়াল আসার, বাবু রফ‘ঈল ইদাদাইন, ২:১৭৬, তাবরানী, মু‘জামুল কবীর, ১১:৩৮৫, আবু শায়বা, আল মুসান্নাফ, ৩:৪৩৬, উমদাতুলকারী ৫ম খন্ড, পৃ: ২৭৩)
রফ–এ ইয়াদাইন বা রুকুর সময় দু’হাত উঠানো প্রসঙ্গে ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইমাম আওযাই রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র একটি বিতর্ক: একদিন পবিত্র মক্কা মুুয়াযযামার “দারুল হানাতীন” নামক স্থানে ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইমাম আওযাই রাহমাতুল্লাহি আলায়হি দু’জনের সাক্ষাৎকালে রফ–এ ইয়াদাইন প্রসঙ্গে কিছু ইলমী বিতর্ক হয়। বর্ণিত বিতর্কটি তুলে ধরা হলো। তাকবীরে তাহারীমা ছাড়া দু’হাত না উঠানো প্রসঙ্গে ইমাম আওযাঈ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে লক্ষ্য করে বলেন, আপনারা রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় উভয় হাত উত্তোলন করেন না কেন? ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, কেননা এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে কোন সহীহ হাদীস নেই। ইমাম আওযাঈ বললেন, এ কেমন কথা, আমাকে যুহরী বর্ণনা করেছেন এবং যুহরী সালেম হতে সালেম তাঁর পিতা আবদুল্লাহ বিন ওমর হতে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামায শুরু কালে হস্তদ্বয় উঠাতেন, আর যখন রুকুতে যেতেন এবং যখন রুকু থেকে উঠতেন তখন দুহাত উঠাতেন। উত্তরে উমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, হাম্মাদ আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবরাহীম নাখঈ হতে, ইবরাহীম আলকামা ও আযওয়াদ হতে এবং তারা উভয়ে আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কেবলমাত্র নামায শুরু করার সময় দু’হাত উঠাতেন আর কখনো হাত উঠাতেন না। ইমাম আওয়াই রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমি তো যুহরী হতে যুহরী সালিম হতে সালিম আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে সনদসূত্রে আপনার নিকট হাদীস বর্ণনা করেছি। আর আপনি বলেছেন হাম্মাদ ও ইবরাহীম সূত্রে আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করেছেন। (হাম্মাদের সাথে যুহরীর এবং ইবরাহীমের সাথে সালিমের সম্পর্ক কি?) ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হাম্মাদ যুহরীর চেয়ে বড় ফকীহ, ইবরাহীম সালিমের চেয়ে বড় ফকীহ্ এবং আলকামাও ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা’র ন্যায় একজন সাহাবা। আর আসওয়াদ অতিশয় মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। অপর বর্ণনায় এসেছে, ইবরাহীম সালিম থেকে শ্রেষ্ঠ ফকীহ্, যদি ইবনে ওমর সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন না করতেন, তবে আমি বলতাম, আলকামা আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে ফিকহ্ শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ, আর ইবনে মাসউদ আবদুল্লাহ্ তার উপর কে? অত:পর ইমাম আওযাই রাহমাতুল্লাহি আলায়হি চুপ হয়ে গেলেন, উক্ত বিতর্ক থেকে প্রতীয়মান হলো ইমাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর অনুসৃত শর্ত মোতাবেক বর্ণনাকারীদের মধ্যে যে অধিকতর ফিকীহবিদ নীতিমালার ভিত্তিতে তাঁকে অর্থাৎ ইবনে মাসউদের হাদীসকে প্রাধাণ্য দিয়েছেন, ইমাম আওযাই ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর প্রাধান্য অস্বীকার করতে পারেননি বলেই নীরবতা পালন করেছেন।
মুসলিম জাহানের মহান ইমাম ইমামুল আইম্মা হযরত ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইজতিহাদ কে গভীরভাবে জানুন। কুরআন সুন্নাহ এজমা ও কিয়াসের আলোকে ন্যায় নিষ্ঠা ও ইনসাফ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ও মেনে চলার পথ অনুসরণ করুন। মাযহাবের সম্মানিত আইম্মায়ে কেরামের বিরুদ্ধে কুৎসা বর্ণনা পরিহার করুন। মুসলিম উম্মার শান্তি শৃঙ্খলা, ঐক্য সমৃদ্ধি ও সংহতি সৃষ্টিতে ইসলামের প্রকৃত সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা (বিশ্বাস) মেনে চলুন।
সার্বিক আলোচনা বিবেচনা করে বলা যায়, হাত উঠানোর পক্ষে ও বিপক্ষে হাদীসের প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু দুইটির উপর আমল করা সম্ভব নয়। বরং যে কোন একটির উপর আমল করতে হবে। তা করতে হলে দেখতে হবে হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন আমলটি আগে করেছেন এবং কোনটি পরে করেছেন। তা প্রমাণিত হলে পরের কাজটির উপর আমল করতে হবে। এসব কারণের ভিত্তিতেই দু’হাত উত্তোলনের হাদীসের উপর আমল করা যাবে না। কেবল তাকবিরে তাহরিমার সময় দুই হাত উঠানো যাবে। (হযরত আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী (১৯৪–২৫৬) কিতাবুস সালাত, খন্ড–১ম, পৃ: ২৫৮,২৫৯)
যেসব রেওয়ায়েতে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে বা পরে ‘রফ’ই ইয়াদাইন’ তথা দুই হাত উত্তোলনের উল্লেখ আছে তা ছিল পূর্বের বিধান। পরবর্তীতে তা রহিত করা হয়েছে। (মুফতি জালাল উদ্দীন আমজাদি, আনোয়ারুল হাদীস, পৃ: ১৯৬)
আল্লাহ তা’আলা আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।