কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে ইবাদত প্রসঙ্গ
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করুন। মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান মহাগ্রন্থ আল কুরআনের আলোকে নফসকে পরিমার্জিত ও আত্নশুদ্ধির জন্য নিজ অন্তরাত্নাকে কলুষমুক্ত করে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করুন। ইসলামের প্রধান ইবাদতগুলোর মধ্যে সালাত, যাকাত, সওম ও হজ্ব পালনে সচেষ্ট ও যত্নবান হোন।
ইবাদতের আভিধানিক অর্থ:
ইবাদাতুন শব্দটি আরবি “আবদুন” থেকে নির্গত এর অর্থ নিচুতা ও দূর্বলতা প্রকাশ করা। আরবি ভাষায় সাধারণ রাস্তাকে ত্বরীকে “মআব্বাদ” বলে কেননা তা প্রত্যেকের পদতলে আসে। (তাফসীর ইবনে কাসীর) অথবা “উবূদাতুন” শব্দ থেকে নির্গত এর অর্থ আবদ হওয়া, (আল্লাহর বান্দা হওয়া) (রহুল বায়ান) শব্দটি দাসত্ব এর অর্থে ব্যবহৃত। আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা, মালিক বা প্রভূ, আমরা তাঁর দাস। দাসের কাজ হলো মুনীবের আজ্ঞাবহ হওয়া। মুনীবের বিধিনিষেধ যথাযথভাবে পালন করাই দাসত্ব। মহান আল্লাহর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই তার ইবাদত।
পবিত্র কুরআনের আলোকে ইবাদত: আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে যত নবী রাসূল (আলাইহিমুস সালাম) প্রেরণ করেছেন প্রত্যেকে নিজ উম্মতদেরকে আল্লাহর ইবাদত তথা তারই দাসত্বের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি আপনার পূর্বে এমন কোন রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে আমি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো। (২১, সূরা: আম্বিয়া:২৫)
আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব জাতিকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিজেই ব্যক্ত করেছেন, “আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন এবং মানুষকে এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।” (আল কুরআন, ৫১, ৫৬)
মানুষ ইবাদত বন্দেগী সমাজ সেবা, সামাজিক ন্যায় বিচার, সাম্য মৈত্রী ভ্রাতৃত্ব কল্যাণকর কাজে নিজকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। ইসলামে ইবাদতের ধারনা পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পাদিত প্রতিটি কাজই ইবাদত। পৃথিবীতে এমন কোন জনপদ ও জনগোষ্ঠী নেই যাদের কাছে আল্লাহ তা’আলা নবী রাসূল পাঠাননি, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে বেঁচে থাক। (আল কুরআন, সূরা নাহল:১৬)
আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান বাস্তবায়ন করা ইবাদতের সার কথা: মানুষ আল্লাহর নির্দেশিত ও তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত ও সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত, পথে নামায রোজা হজ্ব যাকাত আদায় করবে, পিতা মাতার আনুগত্য উত্তমরূপে সন্তানের প্রতি পালন, পবিত্র ও হালাল পন্থায় অর্থ উপার্জন, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ সততা ন্যায় পরায়নতা, সত্যবাদিতা বিশ্বস্ততা উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন, আদর্শ পরিবার গঠন, পাপাচার ব্যাভীচার মিথ্যাচার, শঠতা কপটতা প্রতারণা ও দূর্নীতিমুক্ত জীবন পরিচালনা করাই ইবাদতের সার কথা।
নামায সর্বোত্তম ইবাদত: ঈমানের পর প্রথম ফরজ হলো নামায প্রতিষ্ঠা করা। কেবল পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই নয়, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামায ছাড়াও অন্যান্য নামায সবগুলো ইবাদত। জুমার নামায, দু’ঈদের নামায, তাহাজ্জুদের নামায, জানাযার নামায, বিতরের নামায, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের নামায, তারাবীর নামায প্রতিটি নামাযই ইবাদত হিসেবে গন্য। মু’মিন নর–নারী ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ নামাযকে সঠিক ভাবে আদায় করবে। এই উত্তম ইবাদত বান্দার জন্য সাফল্য বয়ে আনবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত সংক্রান্ত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে ব্যক্তি সঠিকভাবে সালাত হিফাযত করবে তার এই সালাত কিয়ামতের দিন তার জন্য (নূর) আলো দলিল ও মুক্তির কারণ হবে এবং যে তার সঠিক হিফাজত করবেনা তার জন্য সালাত কিয়ামতের দিন আলো, দলিল কিংবা মুক্তির কারণ হবেনা। আর ঐ ব্যক্তি হাশরের দিন কারুন ফেরাউন, হামান ও উবাহ ইবনে খালফ কাফিরদের সাথে উঠবে। ( আহমদ, ৬৫৭৬) ইবনে হিব্বান, ১৪৬৭)
কুরআন তিলাওয়াত উত্তম ইবাদত: পবিত্র কুরআন হলো নূর। গোমরাহী থেকে মুক্তি লাভের মহৌষধ হলো পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত। যে ব্যক্তি কোরআন শরীফ শিখেছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে রয়েছে অসংখ্য ফযীলত। প্রতিটি হরফের বিনিময়ে রয়েছে দশটি সওয়াব। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোরআনের একটি অক্ষর পাঠ করলো তার জন্য এর বিনিময়ে সওয়াব রয়েছে। একটি নেকীর সওয়াব দশগুণ। নবীজি এরশাদ করেন, আমি বলছিনা যে, “আলিফ লাম মীম” একটি অক্ষর। বরং আলিফ একটি অক্ষর লা–ম একটি অক্ষর এবং মী–ম একটি অক্ষর। (তিরমিযী)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর দরুদ শরীফ পাঠ ইবাদতের মধ্যে গন্য:
দরুদ শরীফ পাঠ এমন বরকতময় ইবাদত। বান্দার গুনাহ সমুদ্রের ফেনার পরিমাণ হলেও দরুদ শরীফের বরকতে গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। দরুদ শরীফের ফযীলত বর্ণনাতীত, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ শরীফ পাঠ করে আল্লাহ তা’আলা তার উপর দশটি রহমত বর্ষন করেন, দশটি গুনাহ ক্ষমা করেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। (মিশকাত শরীফ, পৃ:৮৭)
প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য যে কোন বৈধ কাজই ইবাদত: ইবাদতকারীর নিয়্যত বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বান্দাকে এমর্মে শিক্ষা দিয়েছেন, এরশাদ করেছেন, (ইয়্যাকা নাবুদু) অর্থ্যাৎ আমরা তোমারই ইবাদত করি। নামাযরত অবস্থায় কারো সাথে বাক্যালাপ জায়িয নেই। যদি কেউ এ ধরনের বাক্যালাপ করে তাঁর নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। সূরা: ফাতেহা তিলাওয়াতের সময় (ইয়্যাকা না’বাদু) আর “আত্ তাহিয়্যাতু” এর মধ্যে “আসসালামু আলাইকা আয়্যুহানন্নাবীয়্য” হে নবী আপনার উপর দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক এতে প্রতীয়মান হয় যে নামাযে যেভাবে আল্লাহকে হাযির নাযির জানতে হবে যে ভাবে প্রভূর সন্তুষ্টির নিয়্যত করবে তেমনি তার মাহবুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টির নিয়্যত করবে। সাহাবায়ে কেরাম নামায অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান দেখিয়ে ছিলেন। এতে ইবাদতে ত্রুটি সৃষ্টি হয়নি, বরং ইবাদতে পূর্ণতা সৃষ্টি হয়েছে। (তাফসীর নাঈমী, ১ম খন্ড, সূরা: ফাতেহা, সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর)
ইবাদতের তাৎপর্য: আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কৃত সব কাজই ইবাদত। মানব জাতি তাঁর প্রভূর সন্তুষ্টির জন্য নিজ সন্তানদের প্রতিপালন করে তাও ইবাদত। এতে সওয়াব অর্জিত হয়। আল্লাহ তা’আলা “নাবুদু” শব্দকে বহুবচন ব্যবহার করার তাৎপর্য হলো আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন হে আল্লাহ আমি আপনার দরবারে একা উপস্থিত হইনি, আপনার সমস্ত বান্দাদের সাথেই আছি। যেখানে আম্বিয়ায়ে কেরাম সাহাবায়ে কেরাম, আউলিয়ায়ে কেরাম প্রত্যেকেই রয়েছেন আমি যদিও পাপী গুনাহগার আমার ইবাদত কবুল হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা তুমি তাঁদের ওসীলায় আমার ইবাদত কবুল করো। পুণ্যবান বান্দাদের ওসীলায় গুণাহগার বান্দার ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। আমার মতো একাকী ইবাদত করে আপনার অনেক মকবুল বান্দা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমিও ইবাদতে নিজকে তাঁদের সাথে শামিল করছি মাত্র। অসংখ্য অগণিত বান্দা ইবাদত করে চলে গেছেন এখনো হাজার হাজার বান্দারা ইবাদত করে যাচ্ছেন, ফেরেস্তারাও আল্লাহর ইবাদত করছেন বান্দা যদি একাকী ইবাদত করে যদিও দেখতে একাকী মনে হচ্ছে বাস্তবে তিনি অনেকের সাথেই ইবাদত করছেন অথবা জামাত বদ্ধ হয়ে ইবাদত করছেন। আয়াতে আরো প্রতীয়মান হয় যে, জামাআত সহকারে নামায পড়া একান্ত জরুরী। প্রতিটি ইবাদত মুসলমানদের মিলনস্থল আর এটা জামা’আত ব্যতীত অসম্পূর্ণ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজে সন্তুষ্ট তা–ই ইবাদত: রাসূলুল্লাহর সন্তুষ্টি আল্লাহর সন্তুষ্টি। যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল। রাসূলের প্রতি ভালোবাসাই খোদা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। খায়বর যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিদ্রা তথা আরামের জন্য হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নামায বিসর্জন দেয়া ইবাদত ছিলো। নামায পড়ার মধ্যে যদি তাঁর রেজামন্দি থাকে নামায পড়াই হলো ইবাদত। সূর্যোদয়ের সময় নামায পড়া নিষেধ। কারণ এ সময় নামায পড়ার মধ্যে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সন্তুষ্টি নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের মাধ্যমে যে আদেশ নিষেধ দিয়েছেন তা অনুসরণ করার নামই ইবাদত। (তাফসীর নাঈমী, ১ম খন্ড)
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে যাবতীয় প্রকাশ্য ও গোপনীয় কথা ও কাজের নাম ইবাদত, যা আল্লাহ পছন্দ করেন। নিষ্ঠাপূর্ণ সৎকাজ যা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করা হয় তা ইবাদত হিসেবে গন্য করা হয়। এ জন্য বান্দাকে পুরস্কৃত করা হয়। ইবাদতের উপকারিতা কল্যাণ ও ফলাফল বান্দার জন্য নির্ধারিত। বান্দা ইবাদত করুক বা না করুক তাতে আল্লাহর কোনো লাভ ক্ষতি নেই। আল্লাহ বান্দাকে ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন বান্দার স্বার্থের জন্য ও কল্যাণের জন্যই। হে আল্লাহ আমাদেরকে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন কল্যাণের জন্য আপনারই ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।