কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঈমান প্রসঙ্গ
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করুন, ঈমানের পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক আমল করুন। ঈমান ও আমলের মাধ্যমে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সন্তুষ্টি অর্জন করুন।
ঈমান অর্থ: ঈমান শব্দের মূলধাতু “আমন” এর অর্থ নিরাপত্তা, আস্থা, বিশ্বাস। আরবী পরিভাষায় এর অর্থ হলো আল্লাহ তা’আলা রাসূূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর যা নাযিল করেছেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবকিছুর উপর বিশ্বাস স্থাপন করাকে ঈমান বলে। ঈমানের বিপরীত শব্দ “কুফর” যার অর্থ প্রত্যাখ্যান করা, অস্বীকার করা, অবাধ্যতার পথ বেচে নেওয়া ইত্যাদি।
আল কুরআনের আলোকে যাঁদের ঈমান রয়েছে তাঁরা সফলকাম: আল্লাহর নির্দেশিত পথে যারা পরিচালিত, ইসলামী জীবন বিধানে যারা বিশ্বাসী তাঁরাই সফল কাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে সালাত কায়েম করে, আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে এবং আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে ও আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তাতে যারা বিশ্বাস করে এবং পরকালে যারা দৃঢ় বিশ্বাসী তারাই তাদের প্রতিপালকের নির্দেশিত পথে রয়েছে এবং তারাই সফলকাম। (২–সূরা, বাকারা: ৩–৫)
যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাঁদের জন্য রয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা: বান্দার সকল প্রকার নেক আমলের ভিত্তি হচ্ছে ঈমান। বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলে ফাউন্ডেশন মজবুত করতে হয়। ফাউন্ডেশন দুর্বল হলে ভবন ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠে। যে কোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়ার আশংকা রয়েছে। ঈমানের সপ্ত মূলনীতি দূঢ়ভাবে ধারণ করতে হবে। ১. আল্লাহর উপর বিশ্বাস, ২. ফেরেস্তারাজির উপর বিশ্বাস, ৩. আসমানী কিতাব সমূহের উপর, ৪. আল্লাহর প্রেরিত রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস, ৫. মৃত্যু পরবর্তী পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, ৬. তাকদীরের ভালো মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, ৭. মৃত্যু পরবর্তী পুনরায় জীবন লাভের প্রতি বিশ্বাস। (আল ফিকহুল আকবর)
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা। তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে তাদের প্রতিদান, চিরকাল বসবাসের জান্নাত। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে। (৯৮–সূরা, বাইয়্যেনাহ: ৭–৮)
তাওহীদ ও রিসালাত ঈমানের মাপকাঠি: তাওহীদ ও রিসালাতের স্বীকৃতির মাধ্যমে ঈমানের পূর্ণতা। তাওহীদ হলো দাবী, রিসালত হলো দলীল। দলীল বিহীন দাবী করা অবান্তর। রিসালতের উপর পূর্ণ বিশ্বাস ব্যতিরেকে তৌহিদে বিশ্বাস অপূর্ণতার নামান্তর। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত উবাদা ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি এরূপ সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যাতীত কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল তার জন্য আল্লাহ জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন। (মুসলিম, খন্ড:১ম, পৃ:১১১)
হাদীস শরীফের আলোকে ঈমানের পরিচয়: হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট আরয করলো ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঈমান কি? নবীজি এরশাদ করলেন, যখন তোমার সৎকর্ম তোমাকে আনন্দিত করবে এবং স্বীয় মন্দকাজ পীড়া দেবে তাহলে তুমি কামিল মুমীন। (আহমদ) উল্লেখ্য যে কামিল মু’মিন তিনি যার অন্তর গুনাহ ও সওয়াবের মধ্যে পাথর্ক্য করতে পারে। যেমন মানুষের আত্না মাছি হজম করেনা বমি করে ফেলে, অনুরূপ মুমীনের আত্না গুনাহ বরদাশত করতে পারেনা। (মিরআতুল মানাজীহ ১ম খন্ড: পৃ:৬২)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, হযরত আমর ইবনে আবাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর দরবারে আরয করলাম ইসলাম কী? নবীজি এরশাদ করলেন, উত্তম কথা বলা ও খানা খাওয়ানো। আমি আরয করলাম ঈমান কি? এরশাদ করলেন ধৈর্য ও দানশীলতা। বর্ণনাকারী বললেন, আমি আরয করলাম, কোন ইসলাম উত্তম? নবীজি এরশাদ করলেন, যার জিহবা ও হাত থেকে মুসলমানগন নিরাপদ থাকে। তিনি বললেন, আমি আরয করলাম, কোন ঈমান উত্তম? নবীজি এরশাদ করলেন, উত্তম চরিত্র। আমি আবার আরয করলাম, কোন ধরনের নামায উত্তম, নবীজি এরশাদ করেন, দীর্ঘ ক্বিয়াম বিশিষ্ট নামায। বললেন আমি আরয করলাম, কোন ধরনের হিজরত উত্তম। নবীজি এরশাদ করলেন, তোমার রবের যা অপছন্দ তা তুমি বর্জন করবে। আমি আরয করলাম, কোন জিহাদ উত্তম? নবীজি এরশাদ করলেন, যার ঘোড়ার পা কেটে দেওয়া হবে এবং সেটার রক্ত প্রবাহিত করে দেওয়া হবে, তিনি বললেন আমি আরয করলাম কোন সময়টি উত্তম। নবীজি এরশাদ করলেন, শেষ রাতের মধ্যম অংশ। (আহমদ)
বর্ণিত হাদীস শরীফে মুমিনের কতিপয় স্বভাব বৈশিষ্ট্য ও গুনাবলী আলোকপাত হয়েছে যা ঈমানের পরিচয় বহন করে। মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করা, উত্তম ব্যবহার করা, মন্দ স্বভাব থেকে বিরত থাকা, বিনম্র আচরণ করা, মেহেমানদারী ও আতিথেয়তা করা বিভিন্ন পর্যায়ে ধৈর্যের পরাকাষ্টা প্রদর্শন করা, ইবাদতে সবর, গুনাহ থেকে সবর, বিপদে আপদে অভাবে অনটনে ধৈর্য অবলম্বন করা, কঠিন মুসীবতের সময় ক্রান্তিকালে ধৈর্যচ্যূত না হওয়া, দানশীলতার গুণে গুণান্বিত হওয়া, জ্ঞান দান করা উত্তম দানশীলতা, সম্পদের দানশীলতা, ধর্মীয় আদব আখলাক শিক্ষাদন করা, নৈতিক শিক্ষাদন সবই এ হাদীসের অন্তর্র্ভুক্ত। উত্তম চরিত্র ধারণ করা, সর্বোত্তম চরিত্রের সুমহান আদর্শ। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মহান আদর্শ ব্যক্তি জীবন পারিবারিক জীবন সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে চর্চা ও অনুশীলন করা। নামাযের মধ্যে নিষ্ঠা, একাগ্রতা বিনয় অবলম্বন করা, হিজরত করা, প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরআতুল মানাজীহ ১ম খন্ডে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখিত হিজরতের ব্যাখ্যায় কয়েক প্রকার হিজরতের বর্ণনা দিয়েছেন। ১. মক্কা মুকাররমাহ থেকে হাবশার দিকে হিজরত, ২. মক্কা মুকাররমাহ থেকে মদীনা মুনাওয়ারাহর দিকে হিজরত, ৩. অমুসলিম রাষ্ট্র থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের দিকে হিজরত, ৪. মূর্খতার জগত থেকে ইলমী জগতে হিজরত, ৫. গুনাহ থেকে নেককাজের দিকে হিজরত, ৬. কুফর থেকে ইসলামের দিকে হিজরত। (মিরকাত, মিরাআতুল মানাজীহ ১ম খন্ড)
ঈমানের কতিপয় নিদর্শন: প্রতিটি বস্তুর কিছু নিদর্শন রয়েছে, ঈমানের ও কিছু চিহ্ন বা নিদর্শন রয়েছে যা মুমীনের পরিচয় বহন করে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “পাঁচটি বিষয় ঈমানের অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে এসবের কোনোটি নেই, তার ঈমান নেই, ১. আল্লাহর আদেশের সামনে আত্নসমর্পন করা, ২. আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকা, ৩. আল্লাহর কর্তৃত্বের কাছে সবকিছু ন্যস্ত করা, ৪. আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা, ৫. মুসীবতে পড়া মাত্রই ধৈর্য ধারণ করা। (বাযযার, হাদীস: ৫৩৮০)
পাঁচটি বিষয়ের উপর ঈমান জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেয়: প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবনু মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিষ্ঠার সঙ্গে সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই আর আমি আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করে, রোযা রাখে, যাকাত দেয় এবং (কাবা) ঘরের হজ্ব করে। আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেন। (তাবরানি আওসাত ১/৪০৮/১৪৯৬)
ঈমান ও আমল: আল্লাহর দরবারে ঈমানের গ্রহণযোগ্যতা লাভের জন্য আমলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমল ছাড়া ঈমান গ্রহণযোগ্য হবেনা। আর ঈমান ছাড়া আমল গৃহীত হবেনা। (তাবরানী কবীর হাদীস: ১৩৯১৮)
মু’মিনের অসংখ্য বৈশিষ্ট্য হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান রাখে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতা এড়িয়ে চলে আর তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে। আর যে আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান রাখে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতা এড়িয়ে চলে আর তার মেহমানকে সম্মান করে, আর যে আল্লাহর অবাধ্যতা এড়িয়ে চলে সে যেন সত্য কথা বলে নতুবা যেন চুপ থাকে। (আহমদ, হাদীস: ২০২৮৫)
হে আল্লাহ, আমাদেরকে ঈমানের উপর দৃঢ়তা দান করুন, ঈমান আক্বিদা ও আমল সুরক্ষায় তাওফিক নসীব করুন, আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।