জানাযার নামাযে অংশগ্রহণের ফযীলত ও মাসায়েল
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, মৃত্যুর কথা স্মরণ করুন। মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা, ইহকাল তথা জাগতিক জীবন ক্ষণস্থায়ী, পারলৌকিক জীবনই চিরস্থায়ী। প্রত্যেক আত্মা মরণশীল, মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া বা পালাবার সুযোগ নেই। আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রিসালত ও পরকালে বিশ্বাসী মু’মিন নর–নারীদের মৃত্যুর পর কবর জগতে স্থানান্তর হওয়ার পূর্বে তাঁর দেহ থেকে প্রাণ বের হওয়ার পর ধর্মীয় বিধিমতে তাঁকে গোসল করানো ও কাফন পরানোর পর তাঁর কল্যাণ কামনায় মাগফিরাত তথা ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশে ইসলামের এক সুন্দর ব্যবস্থা ও আয়োজন হল “সালাতুল জানাযা”। মুসলিম সমাজের জ্ঞাতার্থে জানাযার ফযীলত ও এতদসংক্রান্ত সংক্ষেপে প্রয়োজনীয় শরয়ী মাসায়েল তুলে ধরার লক্ষ্যে এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
জানাযা শব্দের আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ: জানাযা শব্দটি আরবি ভাষায় দু’ভাবে পঠিত। ১. “জানাযাতুন” এর অর্থ মরদেহ বা মৃত লাশ, ২.“জিনাযাতুন” অর্থ: মরদেহ বহন করার জন্য ব্যবহৃত খাট। (আল কামুস)
শরয়ী অর্থ: ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুসলিম নর–নারী মৃত্যুর পর তার মরদেহের উপস্থিতিতে মাগফিরাতের উদ্দেশ্য জীবিতগণ যে নামায আদায় করেন তাকে জানাযার নামায বলে।
পবিত্র কুরআনের আলোকে সালাতুল জানাযা: পবিত্র কুরআনে কাফিরদের জানাযা পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি তার জন্য কখনো জানাযার নামায পড়বেন না। এবং তার কবরের পার্শ্বেও দাঁড়াবেন না। কারণ তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছিল, তারা পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৮৪)
উপরোক্ত আয়াত থেকে জানাযার নামাযের প্রমাণ পাওয়া যায়। কেননা আয়াতে কাফিরদের জানাযা পড়তে নিষেধ করা হয়েছে, এর দ্বারা প্রতীয়মান হলো মু’মিনদের জানাযা পড়া যায়। আয়াতে আরো প্রমাণিত হলো কাফিরের কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ, মু’মিনদের কবর যিয়ারত স্বীকৃত ও শরয়ীভাবে অনুমোদিত। (সূত্র: তাফসীর, নূরুল ইরফান, কৃত: হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ারখান নঈমী (র.) সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর, পৃ: ৫২১, তাফসীরে কুরতুবী)
হাদীস শরীফের আলোকে জানাযার নামাযে অংশ গ্রহণের ফযীলত: মুসলমানের জানাযায় অংশগ্রহণ এক পুণ্যময় আমল, এতে অপরিসীম সওয়াবের সুসংবাদ রয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জানাযার সালাত আদায় করল তার জন্য এক কীরাত পরিমাণ সওয়াব, আর যে ব্যক্তি মৃতের সাথে থাকল তাকে কবরে রাখা পর্যন্ত তার জন্য দু’কীরাত পরিমাণ সওয়াব রয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম কীরাত কী? তিনি বললেন উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ। (মুসলিম, ৩য় খন্ড, পৃ: ২৬৪)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যদি কোনো মুসলিম মৃত্যু বরণ করে, অত:পর তার মরদেহ সামনে (সালাতুল জানাযা আদায়ের জন্য) চল্লিশজন এমন ব্যক্তি দাঁড়ায় যারা আল্লাহর সাথে কোনো শির্ক এ লিপ্ত নয়, তাহলে তার বিষয়ে তাঁদের সুপারিশ আল্লাহ কবুল করবেন। (মুসলিম)
জানাযা দ্রুত সম্পন্ন করা: সালাতুল জানাযা আদায়ে বিলম্ব করা সমীচীন নয়। কারো জন্য অপেক্ষা করা বা গোসল করানো ও কাফন পরানো কার্যক্রমে বিলম্ব করা, এতদসংক্রান্ত কাজ সম্পাদনে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সময়ক্ষেপন করে জানাযা নামায বিলম্বে আদায় করতে কোনো কল্যাণ নেই। জানাযার মরদেহ সামনে রেখে দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখা মোটেই কাম্য নয়। তা দূর দুরান্ত থেকে আগত জানাযায় অংশগ্রহণকারী মুসল্লীদের জন্য বিরক্তির কারণ ও বটে।
মু’মিন ও গুনাহগার বান্দার মৃত্যু সমান নয়: আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনে অনুগত বান্দারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে জীবনযাপন অতিবাহিত করে। শরীয়ত বিরোধী কোনো প্রকার অন্যায় অপরাধ ও অপকর্মে তাঁরা লিপ্ত হয় না। পক্ষান্তরে গুনাহগার পাপী তাপী বান্দারা মিথ্যাচার পাপাচার ব্যাভিচার কুরআন সুন্নাহ বিরোধী শরীয়ত পরিপন্থি অনৈসলামিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে তাঁরা বেপরওয়া হয়ে যায়। আল্লাহর ভয় ও পরকালীন শাস্তি বিষয়ে তাদের কোন অনুশোচনা নেই। তাদের মৃত্যু আর মু’মিনের মৃত্যু এক নয়। একজন সৎ, নেককার আদর্শবান, দেশ প্রেমিক মানুষের মৃত্যুতে মানুষ গভীরভাবে শোকাহত হয়। তাঁর মহৎ কর্ম ও অবদান উত্তম আদর্শ চর্চার কথা মানুষ উত্তমভাবে স্মরণ করে, পক্ষান্তরে একজন অসৎ চরিত্রহীন দুর্নীতি পরায়ন জালিম অত্যাচারী মানুষের মৃত্যুতে মানুষ স্বস্তি বোধ করে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আনন্দ বোধ করে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত কাতাদা ইবনে রিবঈ আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাশ দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে যাওয়া হলো তিনি তা দেখে বললেন, সে শান্তিপ্রাপ্ত অথবা তার থেকে শান্তি প্রাপ্ত। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো হে আল্লাহর রাসূল! মুস্তারিহ ও মুস্তারাহ মিনহু এর অর্থ কী? তিনি বললেন, মু’মিন বান্দার মৃত্যুর পর দুনিয়ার কষ্ট ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে আল্লাহর রহমতের দিকে পৌছে শান্তি প্রাপ্ত হয়। আর গুনাহগার বান্দার মৃত্যুর পর তার আচার আচরণ থেকে সকল মানুষ শহর বন্দর, গাছ পালা ও প্রানীকূল শান্তি প্রাপ্ত হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৫১২, মুসলিম, হাদীস: ৯৫০)
মরদেহ দেখলে দাঁড়িয়ে যাওয়া:
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যখন কোনো জানাযা মরদেহ যেতে দেখবে দাঁড়িয়ে যাবে। আর যদি সে তাঁর সহযাত্রী হয় তাহলে সে ততক্ষণ বসবেনা যতক্ষণ তা নামিয়ে না রাখা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩১০, মুসলিম, হাদীস: ৯৫৯)
জানাযা সংক্রান্ত শরয়ী মাসায়েল: জানাযা নামায ফরজে কিফায়া। একজনও যদি আদায় করে সবাই দায়মুক্ত হবে। অন্যথায় যাদের কাছে সংবাদ পৌছেছে নামায পড়েনি, তারা গুনাহগার হবে। জানাযা ফরজ হওয়াকে যে অস্বীকার করবে সে কাফের। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ১১৯)
জানাযা নামায শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী: ১. মৃত ব্যক্তি মুসলমান হওয়া, ২. মৃত ব্যক্তির শরীর ও কাফন পবিত্র হওয়া, মৃত ব্যক্তিকে যেন গোসল দেয়া হয়। কাফন পরিধানের পূর্বে শরীর থেকে নাপাকী বের হলে তা ধৌত করবে। (দুরুল মোখতার, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড:পৃ–১৯৩)
৩. মরদেহ মুসল্লীদের সম্মূখে উপস্থিত থাকা। অর্থাৎ মৃতের পূর্ণদেহ বা অধিকাংশ বা মাথার অধিকাংশসহ উপস্থিত থাকা, সুতরাং অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা হবেনা। ৪. মরদেহ মাটির উপর রাখা। অর্থাৎ মাইয়্যেতের খাট মাটির উপর থাকা আবশ্যক। ৫. শবদেহের সতর আবৃত থাকা, অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির দেহের যে অংশ ঢেকে রাখা ফরজ তা ঢেকে রাখা। ৬. আল্লামা শামী (র.)’র বর্ণনামতে জানাযা পড়ানোর জন্য ইমাম প্রাপ্ত বয়স্ক বালিগ হওয়া আবশ্যক।
জানাযার রুকন দুটি: ১. চারবার তাকবীর “আল্লাহু আকবার” বলা। ২. কিয়াম বা দাঁড়ানো। জানাযার সুন্নাতে মুআক্কাদা তিনটি: ১. সানা পাঠ করা, জানাযার নামাযের নিয়্যত করে কান পর্যন্ত হাত উঠায়ে আল্লাহু আকবর বলে হাত নামিয়ে যথারীতি নাভীর নীচে হাত বেঁধে নিবে। এবং ছানা পড়বে। ছানা নিম্নরূপ “সুবহানাকাআল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়াতাআলা জাদ্দুকা ওয়াজাল্লা ছানাউকা ওয়ালাইলাহা গাইরুকা”। ২. হাত না উঠায়ে আল্লাহু আকবর বলবে এবং দরুদ শরীফ পড়বে এবং সে দরুদ শরীফ পড়াটা উত্তম যে দরুদ নামাযে পড়া হয়। দরুদ শরীফ নিম্নরুপ: “আল্লাহুমা সাল্লিআলা সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা সাইয়্যেদানা ইব্রাহী–মা ওয়া’আলা আলে সাইয়্যেদিনা ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক “আলা সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিন কামা বা–রাকতা আলা সাইয়্যেদানা ইব্রাহী–মা ওয়া’আলা আলে সাইয়্যেদিনা ইব্রাহী–মা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।
৩. মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করা: হাত না উঠায়ে আল্লাহু আকবর বলে তৃতীয় তাকবীরের পর নিজের ও মৃত ব্যক্তির জন্য হাদীসে বর্ণিত নিম্নের দুআটি পড়া উত্তম। “আল্লাহুম্মাগফির লিহাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গা–ইবিনা ওয়া সাগীরিনা ও কারীরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনসানা আল্লাহুম্মা মান আহ্ইয়াইতাহু মিন্না ফা আহয়িহী আলাল ইসলাম ওয়ামান তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু আলা ঈমান বিরাহমাতিকা আরহামার রা–হিমীন এর পর “আল্লাহু আকবার” তথা শেষ তাকবীর বলবে। অত:পর সালাম ফেরাবে। (জাওহেরা নায়্যারা, আলমগীরি, দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ১৯৫)
জানাযার কাতার সংখ্যা: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত মালিক ইবন হুবায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কেউ মৃত্যুবরণ করলে এবং মুসলমানদের তিন কাতার লোক তার জানাযা আদায় করলে আল্লাহ তাঁর জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দেন। বর্ণনাকারী বলেন, এ কারণে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু জানাযা লোক সংখ্যা কম হলে তাদেরকে তিন কাতারে বিভক্ত করতেন। (আবু দাউদ, হাদীস: ৩১৬৬)
জানাযায় সব মিলে যদি সাতজন হয়। তাহলে একজন ইমাম হবেন, এরপর প্রথম কাতারে তিন জন, দ্বিতীয় কাতারে দুইজন, তৃতীয় কাতারে একজন দাড়াবেন। (গুনিয়াতুল মুতামাল্লি, পৃ: ৫৮৮)
মাসআলা: মাগরীবের নামাযের সময় জানাযা আসলে তাহলে ফরজ ও দুরাকাত সুন্নাত পড়ার পর জানাযা পড়বে, অনুরূপ অন্যান্য ফরজ নামাযের সময় জানাযা আসলো ফরজ ও সুন্নাত পড়ার পর জানাযা পড়বে। (আলমগীরি, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, ২০৯)
মাসআলা: ঈদের নামাযের সময় জানাযা আসলো তাহলে প্রথমে ঈদের নামায পড়ে নিবে অত:পর জানাযা পড়বে তারপর ঈদের খুতবা পড়বে। (দুরুল মোখতার, জাওহেরা, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড: ২০৯)
মাসআলা: মুসলমানের শিশু বা মুসলিম মহিলার শিশু জীবিত জন্মগ্রহণ করল অর্থাৎ জন্ম হওয়ার সময় জীবিত ছিল তারপর মারা গেল তাহলে তাঁকে গোসল ও কাফন দিতে হবে এবং ওর জানাযা পড়বে। আর যদি মৃত জন্ম হয় কেবল গোসল করাবে, কাপড় জড়াবে দাফন করবে, ওর জন্য সুন্নাত তরীকা অনুযায়ী গোসল ও কাফনের প্রয়োজন নেই, ওর জানাযা নামাযও পড়তে হবেনা। (দুরুল মোখতার, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ২১০)
আল্লাহ তা’আলা আমাদের মৃতদেরকে জান্নাতবাসী করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।