কুরআন ও হাদীস শরীফের আলোকে হজ্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আর্থিক ও শারীরিক দিক থেকে প্রত্যেক সামর্থবান মুসলমান নর–নারীর উপর জীবনে একবার হজ্ব ফরজ করেছেন। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হজ্বের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হজ্ব আত্মিক পরিশুদ্ধির এক উত্তম ইবাদত। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি একক অদ্বিতীয় তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি আমাদের মহান অভিভাবক, শাফায়াতের কান্ডারী, মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও প্রিয় রাসূল। তাঁর উপর দরুদ সালাম বর্ষিত হোক। তাঁর পবিত্র বংশধরগন সম্মানিত সাহাবাগণ ও তাঁর পদাঙ্ক অনুসারী সত্যান্বেষী মু’মিন নর–নারীদের প্রতি অসংখ্য করুণাধারা বর্ষিত হোক।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন হজ্ব ইসলামের মৌলিক ইবাদত ও অন্যতম স্তম্ভ। হজ্ব শব্দের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা প্রণেতা আল্লামা ইবন হাজর আসকালানী (র.) বলেন, নির্দিষ্ট কিছু আমল সম্পাদনসহ পবিত্র কাবাগৃহের উদ্দেশ্যে গমন করার ইচ্ছাকে হজ্ব বলে। অনেক হাদীস বিশারদদের বর্ণনা মতে নির্দিষ্ট আমলসহ নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে গমন করাকে হজ্ব বলে। হজ্বের প্রধান লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো বায়তুল্লাহ শরীফের যিয়ারত করা।
পবিত্র কুরআনের আলোকে হজ্ব:
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অসংখ্য আয়াতে করীমায় হজ্বের ঘোষণা, হজ্বের বিধি বিধান, হজ্বের সময় করণীয় বর্জনীয় বিষয়াদি সম্পর্কে মহান আল্লাহর পবিত্র বানী বিঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এবং মানুষের নিকট হজ্ব সম্পাদনের ঘোষণা শুনিয়ে দাও। তাহলে তারা তোমার নিকট ছুটে আসবে পদব্রজে ও সর্ব প্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিটে করে তারা আসবে দূর দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা: হজ্ব, ২২:২৭)
হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে বলেছিলেন হে আল্লাহ! জনমানব শূন্য এ মরুপ্রান্তরে বিশ্ব মানব মন্ডলীর কাছে তোমার এ ঘোষণা আমি কেমন করে পৌছাবো? আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ করলেন, আমার এ ঘোষণা প্রচার করা ও উচ্ছারণ করা তোমার কাজ, আর এ ঘোষণা পৃথিবীর সকল মানুষের কর্ণ কুহরে পৌছানো আমার কাজ। মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে হযরত ইব্রাহীম (আ.) একটি উচ্চস্থানে আরোহন করে হজ্বের ঘোষণা উচ্চারণ করেন। মহান আল্লাহ জল–স্থল অন্তরীক্ষে আলমে দুনিয়া ও রুহের জগতে পৃথিবীর দিগ দিগন্তে সর্বত্র এ বানী পৌছিয়ে দেন। সে দিন পিতৃঔরশ ও মাতৃ গর্ভের শিশুও সে আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। যারা আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একবার লাব্বাইক বলেছিল তারা জীবনে একবার হজ্বব্রত পালন করার সৌভাগ্য অর্জন করবে, যারা একাধিকবার লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছেন তারা একাধিকবার হজ্ব পালন করার সৌভাগ্য অর্জন করবে।
হাদীস শরীফের আলোকে হজ্বের গুরুত্ব:
হজ্ব এমন এক পূণ্যময় ইবাদত যা মানুষকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে এবং নিস্পাপ ব্যক্তিতে পরিণত করে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্য হজ্ব করল এবং স্ত্রী সম্ভোগ ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল সে এমনভাবে নিষ্পাপ হয়ে হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করল যেন তার মাতা তাকে সদ্য প্রসব করেছে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৫২১)
হজ্ব জীবনে একবার ফরজ:
শারীরিক সুস্থতা ও আর্থিক সক্ষমতার শর্তে সামর্থবান প্রত্যেক মুসলমান প্রাপ্ত বয়স্ক নর–নারীর উপর জীবনে একবার হজ্ব করা ফরজ। একবারের অধিক করা নফল হিসেবে গণ্য হবে। একবার হজ্ব ফরজ হওয়া বিষয়ে হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে, এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন এরশাদ করলেন, হে মানব মন্ডলী! আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর হজ্ব ফরজ করেছেন তোমরা হজ্ব সম্পাদন কর। জনৈক ব্যক্তি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ্ব কি প্রতিবছরই ফরজ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন, এমন প্রশ্নটি তিনবার জিজ্ঞেস করল, অত:পর নবীজি বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম তা অবশ্যই ওয়াজিব হয়ে যেতো, আর ওয়াজিব হয়ে গেলে তোমরা তা পালন করতে সক্ষম হতে না। কাজেই আমি তোমাদেরকে যে অবস্থায় রেখেছি আমাকে সে অবস্থায় ছেড়ে দাও। কেননা তোমাদের পূববর্তী লোকেরা অধিক প্রশ্ন করার এবং তাদের নবীদের সাথে মতবিরোধ করার কারণেই তারা ধ্বংশ হয়েছে। অতএব আমি যখন তোমাদের কোনো বিষয়ে নির্দেশ দেই তা সাধ্যমত কর। আর যে বিষয়ে নিষেধ করি তা ত্যাগ কর। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৩৩২১)
হজ্ব না করার ভয়াবহ পরিণতি:
হজ্ব ফরজ হওয়া ও হজ্ব করার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যারা হজ্ব করা থেকে বিরত থাকল, হজ্ব আদায়ে অলসতা অবহেলা ও গুরুত্ব দিলনা তার জন্য কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। তার শেষ পরিণতির ব্যাপারে আশংকা রয়েছে, এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তিকে বাধাগ্রস্থ করে রাখেনি কোন সুস্পষ্ট সমস্যা কিংবা কোন জটিল রোগ ব্যাধি কিংবা কোন অত্যাচারী শাসক এদতসত্ত্বেও সে হজ্ব করেনি সে ইয়াহুদী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করুক কিংবা খ্রিস্টান অবস্থায় আমার কোন দায়িত্ব নেই। (বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, খন্ড:৪, পৃ: ৩৩৪, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস: ৩৯৮৯)
হজ্ব গুনাহকে ধৌত করে ফেলে:
আল্লাহর ভয় অন্তরে রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়্যতে কুরআন সুন্নাহর বিধিমতে জীবন যাপন করার মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে যে ব্যক্তি হজ্ব ব্রত পালন করে সে গুণাহর আবর্জনা থেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জারাদ সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা হজ্ব করো কেননা হজ্ব গুণাহগুলোকে ধুয়ে ফেলে যেভাবে বিশুদ্ধ সাবান ময়লা পরিষ্কার করে নেয়। (ইমাম তাবরানী, আল আওসাত, হাদীস: ১৬৫১)
হজ্ব ফরজ হওয়ার শর্তাবলী:
১. মুসলমান হওয়া, ২. জ্ঞানবান হওয়া, ৩. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া, ৪. স্বাধীন হওয়া, ৫. আর্থিকভাবে সক্ষম হওয়া, ৬. হজ্ব ফরজ হওয়ার ইলম থাকা, ৭. হজ্বের সময় হওয়া। (শামী ২য় খন্ড)
হজ্ব ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী:
১. শারীরিক সুস্থতা, ২. রাস্তাঘাট নিরাপদ হওয়া, ৩. কারাবন্দি না হওয়া, ৪. মহিলাদের সঙ্গে মুহরিম (যাদের বিয়ে করা হারাম) ব্যক্তি সঙ্গে থাকা, ৫. মহিলাদের ইদ্দত পালনের অবস্থা হতে মুক্ত হওয়া।
হজ্বের ফরজ তিনটি:
১. হজ্বের নিয়তে ইহরাম পরিধান করা, ২. আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা। অর্থাৎ ৯ যিলহজ্ব সূর্য হেলে যাওয়ার পর থেকে ১০ যিলহজ্ব সুবহি সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময় এক মূহুর্তের জন্য হলেও আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। ৩. তাওয়াফে যিয়ারত বা ফরজ তাওয়াফ করা। ১০ যিলহজ্ব কোরবানী করার পর হতে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময় এ তাওয়াফ করা যায়। বি:দ্র: এ ফরজ তিনটির কোন একটিও বাদ পড়লে হজ্ব সহীহ হবেনা। দম বা কোরবানী দ্বারাও এর ক্ষতিপূরণ আদায় হবেনা।
হজ্বের ওয়াজিব ৬টি:
১.সাফা–মারওয়া সায়ী করা, ২. ৯ যিলহজ্ব দিবাগত রাত্রে মুযদালিফায় অবস্থান করা, ৩.জমরায় কঙ্কর নিক্ষেপ (রমী) করা, ৪. কোরবানী করা, ৫. মাথার চুল মুন্ডানো অথবা ছাটানো, ৬. তাওয়াফে বিদা বা বিদায়ী তাওয়াফ করা।
হজ্বের প্রকারভেদ:
হজ্ব তিন প্রকার। যথা:১. ইফরাদ, ২. ক্বিরান, ৩. তামাত্তু। ১. হজ্বে ইফরাদ: মীকাত থেকে কেবলমাত্র হজ্বের ইহরাম পরিধান করাকে ইফরাদ বলা হয়। ২. হজ্বে ক্বিরান: মীকাত থেকে একই সাথে হজ্ব ও উমরার নিয়্যতে ইহরাম পরিধান করে প্রথমে উমরা আদায় করার পর ইহরাম না খুলে ঐ ইহরাম দ্বারাই হজ্ব আদায় করাকে হজ্বে ক্বিরান বলে। ক্বিরান হজ্ব আফজল বা উত্তম। ৩. হজ্বে তামাত্তু: মীকাত থেকে প্রথমে উমরার নিয়্যতে ইহরাম বেঁধে মক্কা শরীফে উমরা সম্পাদন করে ইহরাম খুলে ফেলা। পরে ৮ই যিলহজ্ব মিনায় যাওয়ার আগে হজ্বের নিয়্যতে পুন: ইহরাম পরিধান করা। বাংলাদেশী হজ্ব যাত্রীরা এ প্রকারের হজ্ব করে থাকেন।
ইহরাম: ইহরাম অর্থ হারাম বা নিষিদ্ধ করা, হজ্ব ও উমরা পালনেচ্ছু ব্যক্তিগণ যখন ইহরাম বেঁধে হজ্ব অথবা উমরা পালন করার দৃঢ় নিয়্যতে তালবিয়া পাঠ করেন তখন তাদের উপর কতিপয় হালাল এবং মুবাহ কাজও ইহরাম পরিধানের কারণে হারাম হয়ে যায়। এ কারনেই একে ইহরাম বলা হয়।
ইহরামের পূর্বে করণীয়:
ইহরাম পরিধান ব্যাতীত হজ্ব ও উমরা আদায় করা যাবেনা। বাংলাদেশী হাজীগণ চট্টগ্রাম বা ঢাকা বিমান বন্দরেই ইহরাম পরিধান করে থাকেন। ইহরাম পরিধানের পূর্বে উত্তমরূপে গোসল করা সুন্নাত। পুরুষগণ সেলাইবিহীন একখানা সাদা কাপড় পরিধান করবে এবং একখানা চাদর গায়ে জড়াবে। কাপড় সাদা হওয়া মুস্তাহাব এবং নতুন হওয়া ভাল। মহিলাগন সেলাই করা কাপড় পরিধান করবেন, হাত–পায়ে মোজা ও মাথায় রুমাল বাঁধবেন মুখমন্ডল খোলা রাখতে হবে।
ইহরাম অবস্থায় যা নিষিদ্ধ:
১. পুরুষগণ মাথা, মুখ, হাত ও পা ডেকে রাখা।, ২. মহিলাগন মুখ ঢেকে রাখা, ৩. স্ত্রী সহবাস করা বা কামোদ্দীপনার সাথে স্পর্শ করা, ৪. সাবান দ্বারা মাথা, চুল, দাঁড়ি ধৌত করা, ৫. সুগন্ধি ব্যবহার করা, নখ, চুল কাটা, শরীরের পশম কাটা বা মুন্ডানো, ৬. চুল ও দাঁড়িতে হিজাব লাগানো, ৭. ঝগড়া বিবাদ, অশ্লীলতা, মিথ্যাচার, গীবত ও গালমন্দ করা, ৮. কোন প্রাণী শিকার করা বা শিকারীকে সহযোগিতা করা, ৯. কোন প্রকার গাছ পালা কর্তন করা।
হে আল্লাহ! কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক বিধি–বিধান অনুসরণ করে আমাদেরকে হজ্বে বায়তুল্লাহ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।