ইসলামে নফল রোযার ফযীলত ও মাসায়েল
নফল রোযার ফযীলত: মানব জাতির সৃষ্টির লক্ষ্য উদ্দেশ্য আল্লাহ তা’আলার ইবাদত ছাড়া অন্য কিছুই নহে। ইবাদত বলতে সৃষ্টিকর্তার একান্ত অনুগত হয়ে সর্বান্তকরণে তাঁর আনুগত্য ও দাসত্ব করা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, কেবল আমার ইবাদতের জন্যই আমি জ্বিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছি।( আল কুরআন, ৫১:৫৬)
একমাত্র আল্লাহরই সন্তুষ্টির জন্য বান্দার কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, দান সাদকা সৎকাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ প্রতিটি ইবাদত। কিছু ইবাদত প্রত্যেক মুসলিম নর–নারীর জন্য অপরিহার্য যা শরীয়ত কর্তৃক যার উপর অপির্ত তাকে অবশ্যই পালন ও আদায় করতে হয়, যেমন পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামায, দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম সাধনা করা, সামর্থ্যবান জীবনে একবার হজ্বব্রত পালন করা, নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হলে যাকাত আদায় করা ইত্যাদি। বিনা ওজরে অলসতা বা অবহেলা বশত ফরজ ইবাদত আদায় না করলে ফরজ পরিত্যাগের কারণে গুণাহগার হবে। শাস্তির যোগ্য অপরাধীর অন্তর্ভুক্ত হবে।
নফল ইবাদত: নফল অর্থ: অতিরিক্ত, ঐচ্ছিক, যেটা বাধ্যতামূলক নয়। যে সব আমল করলে সওয়াব পাওয়া যায়, না করলে গুনাহ হয় না। আল্লাহর অনুগত বান্দারা ফরজ আদায়ের পাশাপাশি আল্লাহর নৈকট্য ও প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য নফল ও মুস্তাহাব আমল করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীস দ্বারা নফল ইবাদতের ফযীলত প্রমাণিত। যে ইবাদত যে কাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন সময়ে করেছেন। তবে এ আমল পালন করার জন্য কঠোরতা আরোপ করেননি। যারা আদায় করবে ফযীলত অর্জন করবে, যারা আদায় করবেনা তারা সওয়াব ও ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে।
হাদীস শরীফের আলোকে নফল রোযার ফযীলত: আল্লাহর রহমত অফুরন্ত নিয়ামত বরকত ও সন্তুষ্টি প্রাপ্তির জন্য নফল রোযার ফযীলত অপরিসীম, নফল ইবাদতের গুরুত্ব ও উপকারিতা এতো অর্থবহ ও ফলপ্রসূ যে কিয়ামত দিবসে বান্দার ফরজ ইবাদতের ত্রুটি বিচ্যূতি ও ঘাটতি পূরণের জন্য বান্দার নফল ইবাদতের প্রতি দৃষ্টিপাত করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ফিরিস্তাদের প্রতি নির্দেশ করা হবে।
শাওয়ালের ছয় রোযার ফযীলত: ইসলামী বর্ষের দশম নাম শাওয়াল মাস। এ মাসে ছয়টি নফল রোযা রাখার ফযীলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে, হযরত আবু আইউব আল আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে এবং তারপর শাওয়াল মাসের ছয় দিন সিয়াম পালন করবে সে পূর্ণ বছর সিয়াম পালনের সওয়াব অর্জন করবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৮১৫)
ঈদুল ফিতর ঈদুল আযহা ও আইয়ামে তাশরীক এর দিনসমূহে রোযা রাখা হারাম: হাদীস শরীফে পাঁচ দিন রোযা পালনে নিষেধ করা হয়েছে, এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু সাঈদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর এর দিনে এবং কুরবানির দিন সিয়াম পালনে নিষেধ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)
মাসআলা: ঈদের দিন রোযা রাখা এবং আইয়্যামে তাশরীক অর্থ্যৎ জিলহজ্বের এগার, বার ও তের তারিখে রোযা রাখা হারাম। (আলমগীরি, দুররুল মোখতার, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫ম, পৃ: ১২৬)
মাসআলা: শাওয়ালের ছয় রোযা ঈদের পরের দিন থেকে শাওয়াল মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত যে কোনো ছয় দিন রোযা রাখা যাবে। অথবা লাগাতার ছয়দিনও রাখা জায়েজ আছে। (রদ্দুল মোহতার, খন্ড: ২, পৃ: ৪৩৫)
প্রতি চান্দ্র মাসে ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোযা পালন করা। হযারত আবু যারগিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আমরা প্রত্যেক মাসের তিনটি শুভ্র দিন সিয়াম পালন করব চান্দ্র মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখ। (নাসাঈ শরীফ, ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার, খন্ড: ১ম, পৃ. ৪৭৬)
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখার ফযীলত: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, বান্দার আমল প্রতি সোমাবার ও বৃহস্পিতিবার আল্লাহর নিকট পেশ করা হয় তাই আমি পছন্দ করি যে, আমি রোযাদার অবস্থায় যেন আমার আমল পেশ করা হয়। (তিরমিযী, হাদীস: ৭৪৭)
মাসআলা: রোযার নিয়ত করা। রমজানের রোযা, নির্দিষ্ট মান্নাতের রোযা এবং নফল রোযা সমূহের নিয়্যত করার সময় হলো সূর্যাস্ত থেকে দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে নিয়্যত করে নিলে রোযা হয়ে যাবে। দ্বি প্রহর নিয়্যতের সময় নয় বরং এর পূর্বেই নিয়ত করা জরুরী। আর যে সময় সূর্য শরযী অর্ধ দিবসের রেখা পর্যন্ত পৌঁছেছে তখন নিয়্যত করলে রোযা হবে না। (দুররুল মোহতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫, পৃ: ১২৭)
মহররম মাসে আশুরার রোযার ফযীলত: ইসলামী বর্ষের প্রথম মাস মহররম এর আশুরার রোযা হচ্ছে রমযানের রোযার পর্ব সর্বোত্তম রোযা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন রমজানের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররম বা আশুরার সিয়াম। আর ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাত্রিকালীন (তাহাজ্জুদের) সালাত। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৮১২)
মাসআলা: ১০ মহররমের সাথে ৯ মহুররম বা ১১ মহররম ২টি রোযা রাখা নফল। (বাহারে শরীয়ত: খন্ড: ৫, পৃ: ১২৬)
জিলহজ্বের নবম তারিখ আরাফাত দিবসের নফল রোযা: বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর পবিত্র দিন জিলহজ্বের নবম তারিখে আরাফাত দিবসে রোযা রাখার ফযীলত অপরিসীম এ দিনের গুরুত্ব, তাৎপর্য সম্পর্কে নবীজি এরশাদ করেছেন, “আমি আল্লাহর নিকট আরাফাত দিবসের রোযা সম্পর্কে আশা রাখি যে এর বিনিময়ে তিনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরে সগীরা গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৮০৩)
শাবান মাসের রোযার ফযীলত: শাবান মাস ফযীলতপূর্ণ মাস। এ মাসে রয়েছে শবে বরাত পুণ্যময় রজনী। হাদীস শরীফে এ রজনীতে ইবাদত বন্দেগী ও দিনে রোযা পালন করার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রজনীতে ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করো, দিনে সিয়াম পালন করো। (ইবনে মাযাহ, পৃ: ৯৯, আনায়ারুল বয়ান, খন্ড: ২, পৃ: ৫২৪)
শাবান মাসের নফল রোযার ফযীলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা, রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো এমন ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখতেন যে আমরা বলতাম তিন হয়ত আর রোযা ছাড়বেন না। আবার কখনো কখনো সওম থেকে বিরত থাকতেন এমনকি আমরা বলতাম তিনি আর সিয়াম পালন করবেন না। আর আমি কখনো দেখিনি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে পুরা মাস সিয়াম পালন করেছেন আর আমি তাঁকে শাবান মাসের চেয়ে বেশি সিয়াম পালন করতে অন্য কোনো মাসে দেখিনি। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৯৬৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৭৭৭)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে নফল রোযার ফযীলত অর্জন ও অধিক পরিমাণ নেক আমল করার তাওফিক দান করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওসীলায় আমাদের ইবাদত কবুল করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),
বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।