মহিমান্বিত মাস শাবান ও লায়লাতুল বরাতের ফযীলত
আরবি শব্দ শাবান এর পাঁচটি অক্ষর তাৎপর্যবহ: আরবি চন্দ্র মাসের ৮ম মাস শা’বান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। শা’বান শব্দের মধ্যে এর মাহাত্ন্য ও গুরুত্ব নিহিত রয়েছে। এতে রয়েছে আরবি বর্ণমালার পাঁচটি বর্ণ, প্রতিটি বর্ণ ফযীলতপূর্ণ অর্থের দিকে ইঙ্গিতবহ। পাঁচটি বর্ণ যথাক্রমে ১. শিন, ২. আইন, ৩. বা, ৪. আলিফ, ৫. নূন। শীন অক্ষর শরফুন এর দিকে ইঙ্গিত বহন করে। শরফুন অর্থ সম্মান মর্যাদা। “আইন” দ্বারা উলূব্বুন অর্থ উচ্চমর্যাদা “বা” দ্বারা “বিবরুন” এর অর্থ নেক আমল। আলিফ দ্বারা “উলফাতুন” এর অর্থ ভালোবাসা এবং নূন দ্বারা “নূরুন” অর্থ হেদায়তের আলোকবার্তিকা, যারা শাবান মাসে তাকওয়া পরহেজগারী অবলম্বন করে তাঁরা আল্লাহর নৈকট্য ধন্য প্রিয় বান্দার অন্তর্ভুক্ত।
পবিত্র কুরআনের আলোকে লায়লাতুল মুবারাকা: লায়লাতুল মুবারাকা তথা বরকতময় রজনীর গুরুত্ব পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। বরকত মন্ডিত রজনীর নেক আমল সমূহ প্রসিদ্ধ তাফসীর সমূহের বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত। এ পুণ্যময় রজনীর ফযীলত সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হা–মীম, শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেকটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় ফায়সালা করা হয়।” (আল কুরআন, ৪৪ সূরা, আদ–দুখান, আয়াত: ১–৪)
আয়াতে করীমার আলোকে তাফসীরকারদের বর্ণনা: হযরত ইকরামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুসহ একদল তাফসীরকারকের মতে “লায়লাতুল মুবারাকা” দ্বারা শাবানের ১৫ তারিখের রাতই উদ্দেশ্য। এ রাতের চারটি নাম রয়েছে, ১. লায়লাতুর রহমত (রহমতের রাত), ২.লায়লাতুল মুবারাকা (বরকতের রজনী), ৩. লায়লাতুস ছক (প্রতিদানের রাত), ৪. লায়লাতুল বারাআত (মুক্তির রাত)। এ রজনীতে অসংখ্য মু’মিন নর–নারী পাপী বান্দাদের ক্ষমা করা হয়, এ বিষয়ে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (তাফসীরে রুহুল মা’আনী, খন্ড:২৫, পৃ: ১১০)
হযরত ইকরামা ও একদল তাফসীরকারদের বর্ণনায় আরো উল্লেখ রয়েছে যেমন খাজনা ও যাকাত আদায়কারী, খাজনা ও যাকাত প্রাপ্তির পর খাজনাদাতা ও যাকাত দাতাকে সনদ বা রশীদ দিয়ে থাকে, অনুরূপ এ রাতে যারা ইবাদত বন্দেগীতে রাত যাপন করে তারা মুক্তির সনদ প্রাপ্ত হন। এ জন্যই এ রজনীকে লায়লাতুল বারাআত বা লাইলাতুচ ছেক নামে অভিহিত হরা হয়। (তাফসীরে আলুসী, খন্ড:১৮, পৃ: ৪২৩)
পাঁচ রজনীতে দুআ ফেরত হয়না: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, পাঁচ রজনীতে দুআ ফেরত হয়না জু’মার রাত্রির দুআ, রজব’র প্রথম রাতের দুআ, শা’বানের অর্ধ মাসের রাত্রির দুআ, দুই ঈদের দুই রাতের দুআ। (মুছান্নাফে আব্দির রাজ্জাক, বাব আন নিসফু মিন শাবান, খন্ড: ৪, পৃ: ৩১৭)
লায়লাতুল বরাতে বার রাকাআত নফল নামায: বরকতময় রজনীতে নফল নামাযের ফযীলত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, এ রজনীতে নফল নামায কুরআন তিলাওয়াত, কুরআনের তাফসীর অধ্যায়ন, দরসে কুরআন মাহফিল করা, তাওবাহ এস্তেগফার করা, অধিক পরিমান দরুদ শরীফ পাঠ করা, এতিম মিসকীন ফকীর দরিদ্র শ্রেণির লোকদেরকে দান–সাদকা করা ইত্যাদি আমলের বৈধতা ইসলামী শরীয়তে স্বীকৃত। বারাকাত কিতাবে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, বারাকাত কিতাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ১৫ শাবান রজনীতে বার রাকআত নামায পড়বে প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ১১ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে তার জীবনের পাপসমূহ বিলুপ্ত করে দেয়া হবে। তাঁর হায়াত বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। (নুজহাতুল মাজালীস, খন্ড: ১, পৃ: ১৪৭)
বরাতের রজনীতে কবর যিয়ারত করা পুণ্যময় আমল: কবর যিয়ারত করা সুন্নাত। এতে দুনিয়ার প্রতি অনাগ্রহ ও মৃত্যেুর কথা স্মরণ হয়। এ রজনীতে রওজা শরীফের যিয়ারত করা, সাহাবায়ে কেরাম, শোহাদায়ে কেরাম, বুজুর্গানে দ্বীন, আউলিয়ায়ে কেরাম, আসাতেজায়ে কেরাম, পিতা–মাতা ও প্রিয়জনদের কবর যিয়ারত করা উত্তম পুণ্যময় আমল। বরাতের রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক জান্নাতুল বাক্বী কবরস্থানে যিয়ারত করা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে আমি নবীজিকে হারিয়ে ফেললাম অনুসন্ধানে বের হলাম নবীজিকে জান্নাতুল বাকিতে দেখতে পেলাম, নবীজি আমাকে বললেন ওহে আয়েশা, তুমি কি আশংকা করছিলে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর অবিচার করবেন? আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন তখন নবীজি বললেন, মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রজনীতে দুনিয়ার আকাশে তাঁর শান অনুযায়ী অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের মেষ পালের পশমের সমপরিমাণ সংখ্যক উম্মতকে ক্ষমা করেন। (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
রাত্রি জাগরণ ও দিনে রোজা পালন: বরাতের রজনীতে বিনিদ্র রজনী ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা, অধিক পরিমাণ নফল নামায পড়া সালাতুত তাসবীহ আদায় করা, যিকর আযকার করা, লায়লাতুল বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা করা সওয়াবের আমল। আমিরুল মু’মেনীন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন শাবানের মধ্য রজনী হবে তখন তোমরা রাত্রি জাগরণ কর এবং দিনের বেলায় রোজা পালন কর। নিশ্চয় মহান আল্লাহ পাক সে রজনীতে সূর্যাস্তের পরে প্রথম আসমানে তাঁর শান অনুযায়ী অবর্তীণ হন, এবং বলতে থাকেন কোনো ক্ষমা প্রার্থী কি নেই? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কোনো জীবিকা প্রার্থী কি নেই, আমি তাকে জীবিকা দান করবো, কোনো বিপদগ্রস্ত কি নেই? আমি মুক্ত করে দিব, এ রকম আরো যারা যারা প্রার্থী আছে আমার নিকট প্রার্থনা করলে আমি তাঁদের মনের আশা পূর্ণ করব। এভাবে ভোর উদয় হওয়া পর্যন্ত মহান আল্লাহর আহবান অব্যাহত থাকে। (তাফসীরে আলুসী, খন্ড: ১৮, পৃ: ৪২৪)
ছয় রাকআত নফল নামাযের সওয়াব: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি মাগরীবের পর ছয় রাকআত নামায পড়বে এরপর কোনো প্রকার মন্দ কথা বলবেনা, আল্লাহ তা’আলা তাঁকে বারো বছরের সমপরিমাণ ইবাদতের সওয়াব দান করবেন। (তিরমিযী, খন্ড: ১, পৃ: ১৯৮)
শবে বরাতে রাত জেগে ইবাদত করলে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়: হযরত মুআয ইবনে জাবল রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি পাঁচটি রাতে জাগ্রত থেকে পূর্ণ রাত্রি ইবাদত করবে তাঁর জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। তম্মধ্যে শাবানের পনের তারিখের রজনী একটি। (আততারগীব আত্ তারহীব, খন্ড: ২, পৃ: ৯৮, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৪, পৃ: ১০৫)
শবে বরাতে রুকু সিজদাকারীদের জন্য সুসংবাদ: অলীকুল শিরোমনি হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, এ রজনীতে রুকুকারীদের জন্য সুসংবাদ। এ রজনীতে সিজদাকারীদের জন্য কল্যাণ ও সৌভাগ্যের সুসংবাদ। (গুণীয়াতুত তালেবীন, খন্ড:১, পৃ: ১৬৯, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২, পৃ: ৫২৫)
বরাতের রজনীতে মু’মিনের রুহ নিজ ঘরে আসে: বরাতের রজনীতে মরহুম মরহুমা মু’মিন নর–নারীদের রুহ ঘরের দরজায় এসে উচ্চ আওয়াজে আহবান করে থাকে ওহে গৃহবাসী! ওহে আমার ছেলে সন্তানরা! ওহে আমার নিকটাত্বীয়রা, আজ রাতে কিছু দান সাদকা করে আমাদের উপর অনুগ্রহ করুন। ঘরের বাসিন্দারা মৃতদের জন্য যদি কোন সাদকা না করে তখন মৃত আপনজন দু:খ অনুতপ্ত হয়ে ফিরে যায়। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়্যাহ)
সন্তানের দুআর কারণে পিতার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে নেককার বান্দাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন তখন বান্দা আল্লাহর সমীপে আরজ করবে ইয়া আল্লাহ, আমার এ মর্যাদা কিভাবে নসীব হলো, তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন তোমার সন্তানের দুআর বরকতে। (শরহুস সুদুর, পৃ; ২৭)
শবে বরাতের কতিপয় আমল: অধিক পরিমাণ নফল নামায এ রাতের বরকতময় আমল, অত:পর একশতবার দরুদ শরীফ, একশতবার কলেমা শরীফ, একশতবার এস্তেগফার পাঠ করবেন, একশতবার লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ পড়বেন, অত:পর দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর সমীপে দুআ করবেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের দুআ কবুল করবেন। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২, পৃ: ৫২৬)
বরাতের রজনীতে বৎসরের বাজেট নিরূপণ হয়: হযরত ইকরামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, শাবানের মধ্য রাতে (বরাতের রাতে) সারা বছরের বাজেট, জীবিত ও মৃতদের তালিকা ও হজ্ব পালনকারীদের তালিকা এ রাতে প্রস্তুত করা হয়। উক্ত তালিকা হতে একজনও বাড়ে না ও কমেনা। (তাফসীরে আলুসী, খন্ড: ১৮, পৃ: ৪২৭)
বরাতের রজনীর পবিত্রতা রক্ষা করুন: পবিত্র বরকতময় লায়লাতুল বরাতের পবিত্রতা রক্ষা করুন। ইবাদত বন্দেগীতে রাত অতিবাহিত করুন। কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থি অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকুন। এ রাতে অনেক শিশু কিশোর দলবেধে মধ্যরাত পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরাঘুরি করা আড্ডাবাজি করা, অহেতুক অযথা অনর্থক সময় নষ্ট করা, আতশ বাজি ও ফটকা বাজি করা অর্থ অপচয় করা গুনাহের কাজ। সম্মানিত অভিভাবকগন, নিজ সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য রাখুন! তাদেরকে ইবাদতমুখী করুন। তাঁদের অন্তরে নবীজির প্রতি প্রেম ভালোবাসা সৃষ্টি করুন। ইসলামী শিক্ষার আলোকে তাঁদের জীবন গঠনে সহযোগিতা করুন। ইসলামকে ভালোবাসুন দেশকে ভালোবাসুন দেশের মানুষকে ভালোবাসুন। হে আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের তাওবা কবুল করুন। মহিমান্বিত রজনী লায়লাতুল বরাতের রহমত ও বরকত আমাদেরকে নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।