কুরআন হাদীসের আলোকে মুনাফিকের পরিচয়
মুনাফিক এর পরিচয়:
মুনাফিক শব্দটি “নফকুন” শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ মাটিতে গর্ত করা। অথবা সুড়ঙ্গ পথ যাতে লুকিয়ে থাকা যায়। দ্বিমুখী স্বভাবের লোককে মুনাফিক বলা হয়। শরীয়তের পরিভাষায়: ভেতরে কুফরীকে লুকিয়ে রেখে গোপন রেখে বাহ্যিকভাবে ইসলামকে প্রকাশ করা। মুসলমানের সম্মুখে এক প্রকার কথা বলে কাফিরদের সম্মুখে ভিন্নরূপ কথা বলে। মুনাফিকের অন্যতম পরিচয় হলো, তারা ইসলামের প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্য দেখাবে অন্তরে ইসলামের প্রতি ঘৃণা লালন করে। মুনাফিকরা ইসলামের প্রধান শত্রু। ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে তারা কাফিরদের চেয়েও ভয়ানক ও মারাত্নক। মুনাফিকরা মুখে ইসলাম ও ঈমানের দাবী করে, প্রকৃত পক্ষে তারা অন্তরে ইসলামকে ঘৃণা করে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি বিশ্বাস লালন করেনা। নবীজির প্রতি তাজীম, আদব ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেনা।
আল কুরআনের আলোকে মুনাফিকের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য:
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সর্ববৃহৎ সূরা আল বাক্বারায় ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের শটতা কপটতা ও বৈশিষ্ট্য আলোকপাত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সূরায় মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় আরো ৩৮টি আয়াতে তাদের চক্রান্ত, ভন্ডামী দ্বিমুখী নীতি ও ভ্রান্ত আক্বিদা বিশ্বাসের কথা আলোকপাত হয়েছে।
মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী: মুনাফিকরা মুখে ইসলামের প্রকাশ করে অন্তরে আল্লাহও তদীয় রাসূলের প্রতি অবিশ্বাস লালন করে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, যখন আপনার কাছে মুনাফিকরা আসে তখন বলে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে অবশ্যই আপনি তাঁর রাসূল আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। (সূরা: মুনাফিকুন, ৬৩:১)
মুনাফিকরা দ্বিমুখী চরিত্র ও স্বভাবের অধিকারী। ইসলামের ইতিহাসে দ্বিমুখী চরিত্র ও চক্রান্তের কারনেই ইসলাম সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ইসলাম ও মুসলামনদের বিরুদ্ধে মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবন উবাহ ইবনে সালুল এর নানাবিধ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারনে তিনি ও তাঁর উত্তরসূরীরা অভিশপ্ত ও কলংকিত হয়ে আছে। মুনাফিকদের দ্বিমুখী চরিত্র প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, যখন তরা মু’মিনগনের সংস্পর্শে আসে তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি আর যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি, আমরা শুধু তাদের সাথে ঠাট্টা তামাশা করে থাকি। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৪)
মুনাফিকদের স্থান চিরস্থায়ী জাহান্নাম:
মুনাফিকরা চরম মিথ্যাবাদী অবিশ্বাসী কপট, প্রতারক, তাদের বাসস্থান চিরস্থায়ী জাহান্নাম। জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত অগ্নি শিখায় তারা অনন্তকাল যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ মুনাফিক নারী ও কাফিরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাতে তারা চিরস্থায়ী থাকবে, এটি তাদের জন্য যথেষ্ট। তার আল্লাহ তাদের লানত করেন এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি। (সূরা: তাওবা: ৯:৬৮)
হাদীস শরীফের আলোকে মুনাফিকের চরিত্র:
মুনাফিকরা বাহ্যিকভাবে ইসলামের বেশভূষা ধারণ করে নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে প্রকাশ করলেও তাদের ব্যবহারিক জীবনের চাল চলন, আচার আচরন লেনদেন, কথাবার্তা, আক্বিদা বিশ্বাসে তাদের মুনাফিকী চরিত্র প্রকাশ পায়। তাদের পরিচয়ের সুস্পষ্ট আলামত ও লক্ষণ হাদীস শরীফে বিঘোষিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি ১. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, ২. যখন ওয়াদা করে ভঙ্গ করে, ৩. যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তা আত্নসাৎ করে বিশ্বাসঘাতকতা করে। (বুখারী ১/৩৩)
মুনাফিকের দৃষ্টান্ত:
মুনাফিকদের মধ্যে স্থিতিশীলতা নেই, নীতি আদর্শের প্রতি তার আস্থা নেই। মুনাফিক সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাভোগী, ন্যায় নীতির প্রতি অটলতা অবিচলতা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। সেই ভালোমন্দের মধ্যে পার্থক্য বিধান করেনা, সত্য ও অসত্য উভয় পক্ষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অভ্যস্থ। সত্যকে সত্য মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে জানতে ও মানতে মুনাফিক অভ্যস্ত নহে। তার দ্বিমূখী চরিত্র সম্পর্কে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, মুনাফিকের দৃষ্টান্ত হলো দুটি ছাগলের মাঝে একটি বানডাকা বকরীর মতো যে একবার এই পালের দিকে ছুটে যায় আরেক বার অন্য পালের দিকে দৌড়ায়। (মুসলিম শরীফ, হাদীস: ২৭৮৪)
মুনাফিক, দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও সৎ চরিত্র থেকে বঞ্চিত হবে:
মুনাফিক ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী হলেও দ্বীনের সঠিক প্রজ্ঞা ও উত্তম চরিত্র থেকে বঞ্চিত হবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, এমন দুটি গুণ আছে যা মুনাফিকের মধ্যে একত্র হতে পারেনা। ১. উত্তম স্বভাব, ২. দ্বীনের সঠিক জ্ঞান। (তিরমিযী, হাদীস: ২৬৮৪)
মু’মিন ও মুনাফিকের নিয়্যতে পার্থক্য:
মু’মিন ও মুনাফিক একই ধরনের কাজ করলেও উভয়ের নিয়্যতে পার্থক্য রয়েছে। মু’মিনের প্রতিটি কর্মে বা কার্য সম্পাদনে নিয়্যত থাকে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সন্তুষ্টি অর্জন করা, পক্ষান্তরে মুনাফিকের নিয়্যতে থাকে পার্থিব স্বার্থ, অহমিকা, লৌকিকতা, দাম্ভিকতা, শটতা কপটতা ইত্যাদি। হযরত সাহল ইবনু সাদ সাইদি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “মু’মিনের নিয়ত (মনের ইচ্ছা) তার কাজের চেয়ে উত্তম। প্রত্যেকে নিজ নিজ নিয়ত অনুযায়ী কাজ করে। মুমিন যখন কোনো কাজ করে তখন তাঁর অন্তরে এক ধরনের নূর (জ্যোতি) প্রজ্বলিত হয়। (তাবরানি কাবীর, হাদীস: ৫৯৪২)
মুনাফিকের নয়টি আলামত: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিাল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মুনাফিকদের কিছু আলামত রয়েছে যা দিয়ে তাদের চিনা যায়।
১. এদের অভিবাদনে থাকে অভিশাপ, ২. তাদের খাবারের উৎস হলো লুটপাট, ৩. যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ এদের কাছে খিয়ানতের বিষয়, ৪. এরা মসজিদের কাছে আসলে ঘৃণার মনোভাব নিয়েই আসে, ৫. নামাযে এলেও পিছনে থাকার মানসিকতা নিয়ে আসে, ৬. এরা অহংকারী, ৭. এরা না অন্যদের ভালোবাসে না অন্যদের ভালোবাসা পায়, ৮. এদের রাত কাটে নিষ্প্রাণ কাঠের মতো (নিদ্রায়), ৯. দিন কাটে আনন্দ ফূর্তি ও হইহুল্লোড়ের মধ্যে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৭৯২৬)
হে আল্লাহ আমাদের কে মু’মিন বান্দা হিসেবে কবুল করুন, মুনাফিকের সংশ্রব ও চরিত্র থেকে হিফাজত করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।