হযরত ওসমান জিন্নূরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মর্যাদা
হযরত ওসমান (রা.)’র পরিচিতি: নাম: ওসমান, উপনাম:আবু আমর, আবু আবদিল্লাহ, পিতা: আফফান, মাতা: আরওয়া বিনতু কুরাইয। উপাধি : জিন্নুরাইন, জামিউল কুরআন। কুরাইশ গোত্রের আবদে মানাফ এর সাথে গিয়ে বংশধারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়েছে।
ইসলাম গ্রহণ: ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দেজন্ম গ্রহণ করেন। বয়সে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ছয় বছর ছোট। তিনি বলেন, “আমি ইসলামের প্রথম চারজনের মধ্যে চতুর্থ। তিনি হযরত আবু বকর, হযরত আলী ও হযরত যায়িদ বিন হারিসের পরে ইসলাম গ্রহণকারী চতুর্থ ব্যক্তি।” হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ২৪ হিজরিতে খলীফা মনোনীত হয়ে খিলাফতের আসন অলংকৃত করেন। ১২ বছর ইসলামী খিলাফত পরিচালনা করেন। (সূত্র: মিরআতুল মানাজীহ, ১ম খন্ড, কৃত: মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.))
জিন্নুরাইন উপাধি লাভ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কন্যা রুকাইয়া (রা.) কে তাঁর সাথে বিবাহ দেন, বদরের যুদ্ধে বিজয়ের দিনে হযরত রুকাইয়া (রা.) ইন্তেকাল করেন এর পর নবীজি স্বীয় কন্যা উম্মে কুলসুম (রা.) কে তাঁর নিকট শাদী দেন। হযরত ওসমান (রা.) নবীজির দু’ কন্যা শাদী করার কারণে তিনি ইসলামে জিন্নুরাইন তথা দুই নূরের অধিকারী উপাধিতে ভূষিত হন। কিছু দিন পর উম্মে কুলসুম ইন্তেকাল করলে নবীজি হযরত ওসমান (রা.)কে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার যদি চল্লিশজন কন্যাও থাকত তবে হে ওসমান আমি একের পর এক তাদের প্রত্যেককে তোমার নিকট বিবাহ দিতাম।( ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী, তারীখুল খোলাফা, পৃ: ১০৪)
বাইআতে রিদওয়ানে নবীজি নিজের হাতকে হযরত ওসমানের হাত বললেন: হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ৬ষ্ঠ হিজরিতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওসমান (রা.) কে মক্কাবাসীদের নিকট সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর বাইয়াতে রিদওয়ান অনুষ্টিত হয়। যখন সকল সাহাবায়ে কেরাম বাইয়াত রিদওয়ানে অংশ নিয়েছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ডান হাতে দিকে ইঙ্গিত করে বললেন এটি হযরত ওসমানের হাত। ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বললেন এটা হল ওসমানের বাইয়াত। (বুখারী শরীফ, খন্ড: ১, হাদীস নং : ৩৪৩৩)
হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (র.) বলেন, নবীজি নিজের হাত মোবারককে ওসমানের হাত বলা এটা এমন এক বিশেষ ফযীলত যে মর্যাদা অন্যকোন সাহাবীর নসীব হয়নি। (আনোয়ারুল বয়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ৪৫৭)
হযরত ওসমান ধন সম্পদ ইসলামের জন্য উৎসর্গ করলেন: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, সরকারে দোআলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনা মুনাওয়ারা শুভাগমন করলেন। মদীনা মুনাওয়ারা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরবর্তী “ওয়াদিয়ে আকীক” নামক উপত্যাকার এক প্রান্তে একটি বাগান ছিল বাগানের নিকট অবস্থিত বীরে রুমা একটি কূপের মালিক ছিল এক ইয়াহুদী। মদীনার মুসলমানরা পানির তীব্র সংকট ভোগ করছিল। পানির অভাব দূর করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা ও আগ্রহ প্রকাশ করায় হযরত ওসমান (রা.) বিশ হাজার দিরহামের বিনিময়ে কূপটি ক্রয় করে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিলেন। ইসলামের ইতিহাসে কূপটি “বীরে ওসমান” বা “বীরে রুমা” নামে প্রসিদ্ধ। (আনোয়ারুল বায়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ৪৫৮), তাফসীরে খাযিন এবং মাআলিমুত তানযীল এ বর্ণিত আছে, তাবুক যুদ্ধে হযরত ওসমান (রা.) এক হাজার উট ও যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং একহাজার নগদ দিনার নবীজির সামনে অকাতরে উৎসর্গ করেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) চারহাজার দিরহাম উৎসর্গ করেন, এ দু’জন সৌভাগ্যবান সাহাবীর দানশীলতা ও বদান্যতার প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যারা স্বীয় ধন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে এরপর ব্যয় করার পর সে অনুদানের কথা প্রকাশ করেনা এবং কষ্ট দেয়না তাদেরই জন্য তাদের পালন কর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদের কোন আশঙ্কা নেই তারা চিন্তিতও হবেনা। (সূরা: ২:বাকারা, পারা: ৩, আয়াত: ২৬২)
তাফসীরে খাযায়িনুল ইরফানে সদরুল আফাযিল সৈয়দ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী (র.) বর্ণনা করেন এ আয়াত করীমা হযরত ওসমান ও হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের শানে অবতীর্ণ। হযরত আবদুর রহমান ইবনে খোবাব (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি এরশাদ করেছেন, “এ আমলের পর ওসমান যে আমলই করুক তার কোন ক্ষতি হবে না, এ ভাবে কথাটি দু’বার বলেছেন। তিনি তাঁর সমুদয় ধন সম্পদ আল্লাহ ও রাসূলের জন্য উৎসর্গ করে এতো অধিক প্রিয় ভাজন হয়েছিলেন, তিনি যদি অন্য কোন নফল ইবাদত নাও করেন, তাঁর শ্রেষ্ঠ মর্যাদার জন্য এ অবদানই যথেষ্ট। (সূত্র: তিরমিযী শরীফ, ২য় খন্ড, পৃ: ২১১, মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৬১, আনোয়ারুল বায়ান: ৩য় খন্ড, পৃ: ৪৫৯)
ইসলামে হযরত ওসমান (রা.)’র মর্যাদা: জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ওসমান (রা)’র মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস শরীফ এরশাদ হয়েছে, হযরত ইবনে ওমর বর্ণনা করেন আমরা রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশায় বলতাম। “প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের মধ্যে তাঁর পরে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান হযরত আবু বকর অত:পর হযরত ওমর তারপর ওসমান (রা.)।” (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৫৫)
হযরত ওসমান জান্নাতে নবীজির সাথী হবেন: হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “প্রত্যেক নবীর একজন সাথী রয়েছে আর জান্নাতে আমার সাথী হবেন ওসমান।” (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৯১, তিরমিযী শরীফ: ১ম খন্ড: পৃ: ২১০, ইবনে মাযাহ, পৃ: ১১) তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ১৪৬টি হাদীস বর্ণনা করেন। (সূত্র: উসুদুল গাবা, ৩য় খন্ড, পৃ:২১৫)
হযরত ওসমানের শক্র নবীজির শক্র: হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মৃত ব্যক্তির জানাযা পড়লেন না। সাহাবায়ে কেরাম নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো আপনাকে কারো নামাযে জানাযা ত্যাগ করতে দেখিনি।” নবীজি এরশাদ করেন, “নিশ্চয় এ লোকটি হযরত ওসমানের সাথে বিদ্ধেষ করতেন।” (তিরমিযী শরীফ, ২য় খন্ড, পৃ:২১২)
কিয়ামত দিবসে হযরত ওসমান সত্তর হাজার গুনাহগারদের সুপারিশ করবেন: আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওসমান এর শাহাদাতের ভবিষদ্বাণী করেছেন, এরশাদ করেছেন, তিনি যখন শহীদ হবেন, আসমানের ফেরেস্তারা তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করবেন। কিয়ামতের দিবসে তিনি এমন সত্তর হাজার গুনাহগার বান্দাকে জান্নাতের সুপারিশ করবেন। যাদের উপর জাহান্নাম ওয়াজিব হয়েছিল। (নুরুল আবছার,পৃ: ২৪৩, আনোয়ারুল বয়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ৪৬৩)
হযরত ওসমান (রা.) ’র হত্যাকারীদের করুণ পরিণতি: হযরত ইবনে আবু হুবাইব থেকে বর্ণিত, হযরত ওসমান (রা)’র উপর আক্রমণ ও হত্যাকান্ডে যারা জড়িত ছিল সকলে বিভিন্ন প্রকার জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। অধিকাংশ পাগল হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। (আস সাওয়ায়েকুল মুহরিকা, কারামাতে সাহাবা, পৃ: ৫৪)
অবদান: ইসলামী সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ, সফল অভিযান, দেশ বিজয়, সংস্কার কর্ম, ইসলামের প্রচার প্রসার, ইত্যাদি গৌরবময় কর্ম সম্পদনে হযরত ওসমান (রা.)’র খিলাফত কাল ছিল এক সোনালী অধ্যায়। ২৬ হিজরিতে মক্কায় হেরম শরীফ সংলগ্ন জায়গা ক্রয় করে তিনি মক্কা মোকাররমার মসজিদে হেরম সম্প্রসারিত করেন। ২৭ হিজরিতে আফ্রিকার পার্বত্য অঞ্চল ও দূর্গম এলাকা গুলোতে অভিযান চালিয়ে ইসলামী সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এ বিজয় অভিযানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে জনপ্রতি তিনহাজার দিনার গণিমতের সম্পদ অর্জন করেছে। ২৯ হিজরিতে মসজিদে নববী শরীফ সম্প্রসারণ কারুকার্য খচিত মূল্যবান পাথর দ্বারা দেওয়াল ও স্তম্ভগুলো পুন: নির্মাণ করেন। মসজিদে নববীর ছাদ সেগুন কাঠ দ্বারা সুসজ্জিত করেন। ১৬০ গজ দৈর্ঘ্য ও ১৫০ গজ প্রস্ত হিসেবে মসজিদে নববীর আয়তন বিস্তৃত করেন। (তারিখুল খোলাফা, পৃ: ১০৬)
শাহাদাত: ৩৫ হিজরির ১৮ জিলহজ্ব জুমাবার রোজা অবস্থায় আসত্তয়াদ তাজয়ীবি মিশরীর হাতে কোরআন মজীদ পাঠরত অবস্থায় শহীদ হন, হযরত যুবাইর ইবন মুতঈম (রা.) তাঁর জানাযার ইমামতি করেন জান্নাতুল বাকী শরীফে তাঁকে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের বরকত দান করুন। তাঁর প্রিয় নবীর সম্মানিত সাহাবাগনের আদর্শ নসীব করুন। নিশ্চয় তিনি মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।