জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী | শুক্রবার , ১৯ মে, ২০২৩ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

কুরআন সুন্নাহর আলোকে তাওবা ও ইস্তিগফার

আল কুরআনের আলোকে তাওবার নির্দেশনা:

বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর বড়ই দয়া অনুগ্রহ যে, তিনি গুনাহগার পাপী তাপী বান্দাদেরকে গুনাহ থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও মুক্ত রাখার জন্য এমন একটি উপকারী আমল দান করেছেন যার নাম “তাওবা”। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা করো বিশুদ্ধ তাওবা, তাহলে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাত সমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী সমূহ প্রবাহিত। (সূরা: তাহরীম, ৬৬:)

আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎ কর্ম করে পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন, আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা: ফোরকান, ২৫:৭০)

বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তাওবাকারী বান্দাদের কেবল গুনাহসমূহ ক্ষমা করার কথা বলেননি বরং তাদের পাপসমূহ মোচন করার পর এর পরিবর্তে তাদেরকে পূন্য দান করবেন। তাওবাকারী বান্দাদের জন্য চূড়ান্ত সফলতা রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর কাছে তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা: নূর, ২৪:৩১)

হাদীস শরীফের আলোকে তাওবা ইস্তিগফার: তাওবা দ্বারা বান্দা গুনাহমুক্ত হয়ে যায়, হাদীস শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি পাপ থেকে তাওবা করে সে এমন হয়ে যায় যেন তার কোন পাপই নেই। (ইবনে মাযাহ, পৃ: ৩১৩, মিশকাত শরীফ, পৃ: ২০৬)

সূর্য পশ্চিমাকাশে উদিত না হওয়া পর্যন্ত তাওবার দরজা বন্ধ হবেনা: আল্লাহ তা’আলা বান্দার জন্য অধিক দয়াবান ও পরম করুণাময়। বান্দা কৃতপাপের জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে আল্লাহর দরবারে তাওবা করার জন্য বান্দাকে আল্লাহ অবারিত সুযোগ দান করেছেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তাওবার দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হিজরত বন্ধ হবেনা আর সূর্য পশ্চিমাকাশে উদিত না হওয়া পর্যন্ত তাওবার দরজা বন্ধ হবেনা। (আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৭৯)

মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বান্দার তাওবা কবুল হবে: নেককার বান্দার, তাওবা দ্বারা আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন হয়। নেককার ব্যক্তির তাওবা দ্বারা আল্লাহর দরবারে নেককার ব্যক্তির মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পায়। গুনাহগার বান্দার তাওবা দ্বারা কৃতপাপের ক্ষমা হয়, তাওবার মূল উদ্দেশ্য হলো কৃত অপরাধে অনুশোচনা করা ও অনুতপ্ত হওয়া। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:, পৃ: ২৫০)

তাওবার চারটি স্তম্ভ: হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেছেন তাওবার চারটি স্তম্ভ রয়েছে, . মৌখিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা, . অন্তরে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া, . নিজ দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমূহ সকল প্রকার গুনাহ থেকে বিরত রাখা, . ভবিষ্যতে কখনো গুনাহের কর্মে লিপ্ত না হওয়ার বিশুদ্ধ অঙ্গীকার করা। তিনি এটাও বর্ণনা করেন যে, বিশুদ্ধ তাওবা হলো, যে গুনাহ থেকে তাওবা করেছে সে গুনাহের দিকে পুনরায় ফিরে না যাওয়া। (গুনীয়াতুত তালেবীন, পৃ: ২৫৯)

গুনাহ করার পর তাওবা ভঙ্গ করে পুনরায় গুনাহে লিপ্ত হওয়া, পুনরায় আল্লাহর সমীপে তাওবা করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, স্বীয় প্রতিপালকের সাথে ঠাট্টা করার নামান্তর। (গুনীয়াতুত তালেবীন, পৃ: ২৫৯)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈনিক সত্তর বারের অধিক তাওবা ইস্তিগফার করা: সম্মানিত নবীগন নিস্পাপ। সকল প্রকার ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত সগীরা গুনাহ থেকেও তাঁরা মুক্ত, পূত: পবিত্র। সকল প্রকার ত্রুটিবিচ্যূতি থেকে পুত:পবিত্র হওয়া সত্বেও আমাদের আক্বা মওলা দোজাহানের বাদশাহ কামলিওয়ালা নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৈনিক সত্তর থেকে একশতবার তাওবা ইস্তিগফার করতেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি দৈনিক সত্তর বারের অধিক তাওবা করি এবং ইস্তিগফার তথা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। (বুখারী শরীফ, হাদীস: ৬৩০৭, পৃ: ৯৯৩)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হে মানব মন্ডলী, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর। নিশ্চয় আমি আল্লাহর কাছে দৈনিক একশতবার তাওবা করে থাকি। (মুসলিম শরীফ, হাদীস ২৭০২)

নূরনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওসীলায় আদম আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুল হলো: হযরত আদম আলাইহিস সালাম জান্নাত থেকে পৃথিবী পৃষ্টে পদার্পনের পর তিনশত বৎসর যাবৎ আল্লাহর দরবারে ক্রন্দন করেছেন এবং অব্যাহত ভাবে তাওবা করেছেন পরিশেষে আল্লাহর দরবারে এ মর্মে আর্জি পেশ করেছেন, হে প্রতিপালক! তোমার মাহবুব নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসীলায় প্রার্থনা করছি আমাকে ক্ষমা করো। তখনি আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুল করে নিলেন। (রুহুল বয়ান, পৃ: ২২০, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: , পৃ: ২৫৫)

হযরত বিশর হাফীর তাওবা: অসংখ্য কাশাফ কারামাতের অধিকারী সুপ্রসিদ্ধ সূফী সাধক, অলীয়ে কামিল হযরত বিশর হাফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর তাওবা সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ ঘটনাটি প্রণিধানযোগ্য ও শিক্ষণীয়। তাঁর মালিকানদ্বীন শরাবের ফ্যাক্টরি ছিল। তিনি নিজে শরাব প্রস্তুত করতেন ও পান করতেন। একদা শরাবের কারখানা থেকে নিজ ঘরে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে একটুকরো কাগজের সন্ধান পেলেন এতে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” লিপিবদ্ধ ছিল। কাগজের টুকরোটি যথাযথ সম্মানের সাথে তুলে নিলেন নিজ প্রভু “আল্লাহর” নাম মুবারক চুমো খেলেন, কাগজের টুকরোটি সুগন্ধিময় করে উঁচুস্থানে সংরক্ষণ করলেন। আল্লাহর নামের প্রতি তাঁর এ আদব ও তাজিম আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দ হলো করুণাময় দয়ালু আল্লাহ তাঁর অন্তরের জগত পরিবর্তন করে দিল। তিনি যখন ঘর থেকে তাঁর শরাবের কারখানায় নিদিষ্ট শয়নকক্ষে নিদ্রা যাপন করেন। স্বপ্ন যোগে এক বুজুর্গ দরবেশের সাক্ষাৎ হলো দরবেশ লোকটি হযরত বিশর হাফীর শরাবখানার দরজায় কষাঘাত করলেন, বললেন, আমি আল্লাহর প্রেরিত দূত! আল্লাহ তা’আলা বিশরকে সালাম দিয়েছেন এবং বার্তা প্রেরণ করেছেন যে, আমি আমার বিশরকে শরাব পান করতে দেবোনা। হযরত বিশর যখন জাগ্রত হলেন। দরজার সন্নিকটে দরবেশের সাক্ষাৎ হলো দূত বললো ওহে বিশর! আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছি তোমার জন্য আল্লাহর সালাম নিয়ে এসেছি, ঘটনার বিবরণী শুনে হযরত বিশর হাফীর মধ্যে এক বিশেষ অবস্থা “ওয়াজদ” সৃষ্টি হলো তিনি বারবার বলতে আছেন আল্লাহ তা’আলা আমাকে সালাম দিয়েছেন। এ কথা বলতে বলতে ভাবের জগতে নিজকে হারিয়ে ফেলেন, নগ্নপায়ে জঙ্গলের দিকে আশ্রয় নিলেন, বিশুদ্ধ তাওবা করলেন মহান আল্লাহ তাঁকে তাওবার ওসীলায় বেলায়তের নিয়ামত দানে ধন্য করলেন।

তাওবা ইস্তিগফার দ্বারা বিপদাপদ দূরীভূত হয়: হযরত ফাদালাহ ইবনে উবাইদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, বান্দা যখন আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করে তখন সে আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ থেকে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ২৩৯৫৩)

একমাত্র পাপের কারনেই বিপদাপদ অবতীর্ণ হয় আর তাওবার মাধ্যমেই বালা মুসিবত দূরীভূত হয়। হে আল্লাহ আমাদের তাওবাহ ইস্তিগফার কবুল করুন। মিথ্যাচার পাপাচার ও গুনাহের কাজ থেকে আমাদেরকে হিফাজত করুন। কুরআন সুন্নাহ মুতাবিক হেদায়তের উপর আমাদেরকে অবিচল রাখুন। আমীন।

 

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহীহ্‌ ইসলামী সংগঠনসমূহের ঘাটতি
পরবর্তী নিবন্ধডিজিটাল ব্যাংকিং এবং স্মার্ট লেনদেন