নোয়াখালীর মাইজদীর বাসিন্দা মারুফ হোসেনের বাবা চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকায় একটি ভবনে পাহারাদারের কাজ করেন। সংসারের খরচ একা কুলিয়ে উঠতে পারেন না। তাই ঘরের বড় ছেলে হিসেবে মাত্র ১২ বছর বয়সেই রোজগারের পথে নেমে পড়েন মারুফ। মামার সঙ্গে সহকারীর কাজ করতে করতে হয়ে ওঠেন কভার্ড ভ্যানচালক।
কভার্ডভ্যানের স্টিয়ারিং ধরে ভালোই চলছিল মারুফের জীবন। দুই বোনের বিয়ে দিয়ে গত বছর নিজেও বিয়ে করেন। কিন্তু ‘জীবনের স্টিয়ারিং’ ঠিকমতো ধরতে না ধরতেই হারিয়ে ফেললেন একটি হাত। গত ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণে আরও অনেকের মতো আহত হয়ে এখন হাত হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন মারুফ। গতকাল রোববার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নং ওয়ার্ডে (অর্থপেডিক সার্জারি) কথা হয় চিকিৎসাধীন মারুফের সঙ্গে। খবর বিডিনিউজের।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এই যুবক জানান, আগের দিন (৩ জুন, শুক্রবার) বিকালে আশুলিয়ার নরসিংহপুরের একটি পোশাক কারখানার কাপড় নিয়ে বিএম কন্টেনার ডিপোতে পৌঁছান তিনি। সিরিয়াল না পাওয়ায় অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে মার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম ভাত খেতে। আগুন দেখে দাঁড়িয়েছিলাম। ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই বিস্ফোরণ হয়।
ঘটনার এক সপ্তাহ পরেও যখন মারুফ বলছিলেন, তখন তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল আতঙ্ক। বারবার চোখ বন্ধ করে ফেলছিলেন সেদিনের কথা বলতে গিয়ে। তিনি বলেন, বিস্ফোরণের পর দেখলাম, আমার ডান হাতের আঙ্গুল নেই, হাতটি অল্প করে আটকে আছে। বাম হাত দিয়ে ডান হাতটি ধরে যখন ডিপো থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন অসহ্য যন্ত্রণা, চোখ জ্বালা করছিল। কিছুই দেখতে পারছিলাম না।
মারুফ জানান, রাস্তায় বের হয়ে তিনি ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি দেখতে পেয়েছিলেন। সেখানে থাকা এক কর্মী তাকেসহ আরও সাত-আট জনকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে দেন।
আমাদের গায়ে থাকা গ্যাসের কারণে গাড়িতে আগুন লেগে যাচ্ছিল। যার কারণে কালুশাহ বাইপাস এলাকায় আসার পর মাইক্রেবাসটির চালক আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ রাস্তায় বসে থাকার পর পুলিশ এসে আমাদের একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়।
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত মারুফের ছোট বোনের স্বামী রুবেল হোসেন জানান, অ্যাম্বুলেন্সের চালকের মাধ্যমে মারুফ তার বাবা শাহাবউদ্দিনকে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমার শ্বশুর ঘটনা শুনে হাসপাতালে এসে বিভিন্ন স্থানে খুঁজেও মারুফ ভাইকে না পেয়ে আমাকে ফোন করে। আমি এসে শ্বশুরকে সঙ্গে নিয়ে যেসব ওয়ার্ডে দুর্ঘটনাস্থল থেকে আসা আহতদের ভর্তি করানো হচ্ছিল, সেসব স্থানে খুঁজছিলাম। কোথাও না পেয়ে গিয়েছিলাম অপারেশন থিয়েটারের সামনে। সেখানে পরিচিত এক চিকিৎসককে দেখে মারুফের নাম বলেছিলাম। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন মেঝেতে রাখা রোগীদের মধ্যে দেখতে। গায়ে মুখে রক্ত, কালো দাগ থাকায় চেনা যাচ্ছিল না মারুফকে। হঠাৎ কাতরানোর শব্দ শুনে আমি জানতে চাইলাম, মারুফ ভাই? তখন সে বলে উঠল- ‘রুবেল ভাই, আমি মারুফ’।
হাসপাতালের ওয়ার্ডে মারুফের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন তার শয্যার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সন্তানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তার মা মারজান বেগম। তিনি ডটকমকে বলেন, তিন ছেলে, পাঁচ মেয়ের সংসারে সবার বড় মারুফ। বাবাকে সহায়তা করতে সে আমার ভাইয়ের সঙ্গে কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভারি শিখতে গেছিল। আগে আমার ভাইয়ের লগে থাকলেও কয়েক বছর আগে থেকে সে গাড়ি চালান শুরু করছে। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমি ভাত খেয়ে শুইতে গেছি, তখন মারুফ ফোন দিছিল। আমি তারে জিগাইলাম, বাবা ভাত খাইছ কি না, খায়নি বলায় তারে বলছিলাম ফোন কেটে ভাত খেয়ে নিতে। এরপর সে গাড়ি থেকে নেমে ভাত খেতে যাচ্ছিল। মারুফ আমারে কইছে আমি যদি আর এক মিনিট কথা কইতাম সে গাড়ি থেকে নামত না। এ দুর্ঘটনায় পড়ত না সে।