জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট করেছি

চিকিৎসকের জবানবন্দি ।। রিপোর্ট বদলাতে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেয়া হয়

| সোমবার , ২৫ আগস্ট, ২০২৫ at ৪:৩০ পূর্বাহ্ণ

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের সঠিক পোস্টমর্টেম রিপোর্ট করেছি বলে সাক্ষী দিলেন চিকিৎসক। শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেয়া সাক্ষীর জবানবন্দিতে আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে নিজের সংগ্রামের বর্ণনা দেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলাম। বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল১ এ গতকাল দেয়া সাক্ষীর জবানবন্দিতে চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম বলেন, আমি রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলাম। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আমি শহীদ আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত করি। আবু সাঈদের শরীরে অনেকগুলো পিলেট পাওয়া যায়। পিলেট বিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ জনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উল্লেখ করি। তবে মতামতসহ আমার করা রিপোর্ট তাজহাট থানার তদন্ত কর্মকর্তাকে দিতে গেলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট গ্রহণ না করে নতুন করে রিপোর্ট লিখতে বলে। এভাবে তিনবার আমার রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। খবর বাসসের।

জবানবন্দিতে চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই রংপুর মেডিক্যালের ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে রংপুর সিটি এসবির এসপি সিদ্দিক, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মারুফ, রংপুর মেডিক্যালের স্বাচিপ সভাপতি ড. চন্দন আমাকে তাদের মত করে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে চাপ দেন। এসময় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা রুমের বাইরে অবস্থান করছিলেন। ওনারা প্রথম থেকেই আমাকে বলেন যে, আবু সাঈদের মাথা ইনজুরি আছে সেটা ফোকাস করতে হবে। তারা আমাকে তাদের মত করে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে চাপ দেন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। তারা আমাকে আবু সাঈদের বুলেট/পিলেট ইনজুরির পরিবর্তে হেড ইনজুরি ও নিউরোজেনিক শক লিখতে বলেন। তারা আমাকে বলেন তাদের মতো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না দিলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। আমার বিষয়ে নাকি গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে।

আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলাতে একপর্যায়ে নানা প্রলোভন দেয়া হয় উল্লেখ করে চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম জবানবন্দিতে বলেন, তারা আমাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেন। আমি বলি আমার পাসপোর্ট নেই। তখন তারা আমাকে স্ত্রী সন্তানের নিয়ে দুই সপ্তাহ কক্সবাজারে ঘুরে আসার অফার দেয়। সবকিছুর ব্যবস্থা তারা করবেন বলে জানান। তবে আমি তাদের কথায় রাজি হইনি। আমি ভাইস প্রিন্সিপাল স্যারকে বলি, স্যার আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য টিভিতে লাইভ সমপ্রচার হয়েছে এবং তা সারা বিশ্ব দেখেছে। আমি যদি এই হত্যাকে হেড ইনজুরি বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেই তাহলে সারা বিশ্বের মানুষ ড. সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে।

রংপুর মেডিক্যালের স্বাচিপ সভাপতি ড. চন্দন তাকে পেশাগত প্রলোভন দেন উল্লেখ করে চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম বলেন, . চন্দন আমাকে বলেন নেত্রী তোমার ব্যাপারে কনসার্ন। তোমার ব্যাপার আমরা দেখব। পুলিশ যেভাবে চায় সেভাবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দাও। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমি আমার জায়গা থেকে সরে যাইনি। সর্বশেষ দেয়া পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আমি আবু সাঈদের শরীরে পিলেট ইনজুরির বর্ণনা দেই। তবে রিপোর্টে ‘গান শর্ট’ শব্দটা লিখিনি। এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী ও দুটি সন্তান আছে। তখনকার ঐ সরকার থাকলে এখন আমার কি হতো? আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য রিপোর্ট প্রদান করেছি। আমি আবু সাঈদ হত্যার নির্দেশ দাতাসহ জড়িতদের বিচার ও শাস্তি চাই।

গতকাল ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম। একসময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে জেরায় ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এদিকে এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আলমামুন গতকাল সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। তার পক্ষে আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আলমামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল১। এখন পর্যন্ত এই মামলায় ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে।

এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুমখুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।

গত বছরের জুলাইআগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ, দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা শিশুদের ‘ঝরেপড়ার’ তথ্য দিল ইউনিসেফ
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপির আগ্রাসী মনোভাব সংস্কার না করলে গণপ্রতিরোধ : হাসনাত