রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সূর্যালোক, প্রথম রবি বললে ভুল বলা হয় না। যার প্রতিটি সৃষ্টি মানুষকে ভালবেসে মানুষের কথা বলে যায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সাধারণ মানুষের সাথে হৃদয় দিয়ে মিশেছেন, মানুষকে মন উজাড় করে ভালবেসেছেন। তিনি শুধু একজন কবি নন, একজন শ্রেষ্ঠ গল্পকার, উপন্যাসিক, দার্শনিক, গীতিকার, সুরকার, একজন কালজয়ী সাহিত্য স্রষ্টা ।
তাঁর লিখায় ফুটে উঠে মানুষের জীবনের বিস্তর বাস্তবতা। প্রেম, বিরহ, মিলন, বিচ্ছেদ, প্রকৃতি, সময়, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, শোষণ, রাজনীতি, দর্শন কি নেই তাঁর রচনায়? মানুষের মনের অনুভব ও প্রকৃতির এমন কল্পনাতিত সুর আর কেউ কখনো রচনা করতে পারেনি। ভাবে দার্শনিক, ভাষায় জাদুকর, সুরে যেন আত্মার গীতিকার। জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি অনুষঙ্গ ঠাকুরের সাহিত্য কর্মে স্থান পেয়েছে অত্যন্ত চমৎকার এবং সাবলীলভাবে ।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলার মানুষের হৃদয়ের সহজাত সহচর। উনবিংশ শতকের সমাজ বাস্তবতা, মানুষের চাওয়া–পাওয়া, জীবনের নানান চড়াই–উৎরাই কে তিনি সহজ ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করেছেন। ছুটি গল্পের ফটিক এর বাড়ি ফেরার আকুলতা, কাবুলিওয়ালা গল্পে কন্যাসম মিনির জন্য প্রবাসী রহমতের নিখাদ মমতা, কিংবা পোষ্টমাস্টার গল্পে পোস্টমাস্টারের জন্য গ্রাম্য বালিকা রতনের অবুঝ ভালবাসার মাধ্যমে তিনি আমাদের সমাজের নিদারুণ কঠিন বাস্তবতাকে চিত্রায়িত করেছেন।
রবীন্দ্রসাহিত্য জুড়ে দেখা যায় কবি মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সমানুভব, মানবতাবাদী চেতনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর দুই বিঘা জমি কবিতায় তিনি শোষক জমিদার এবং নির্যাতিত উপেনের উপমা টেনে এই সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী বৈষম্য এবং দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচারকে যথাযথভাবে বর্ণনা করেছেন। নিজে জমিদার হয়েও সমাজের গরীব শ্রেণির অসহায়ত্ব কিভাবে কবিকে নাড়া দিয়েছিল তা তাঁর এই সৃষ্টিতে স্পষ্ট।
১২৬৮ সালের ২৫শে বৈশাখ কোলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে কবি জন্মগ্রহণ করেন। পশ্চিম বাংলায় জন্মগ্রহণ করলে ও এপার বাংলার মানুষকেও প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলেন। পূর্ববাংলার নদী, ফসলের মাঠ, বাথান, সবুজ প্রকৃতি ও মানুষগুলো তাঁর সৃষ্টিতে নিঃশব্দে জেগে আছে। বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে ঠাকুরের ছিল এক গভীর এবং প্রাণোৎসারিত সম্পর্ক। শুধু পশ্চিম বাংলায় নয় পৈতৃক জমিদারির প্রয়োজনে কবি বসবাস করেছেন পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশেও।
কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবিঠাকুর জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য প্রায়ই আসতেন। জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে হৃদয় দিয়ে মিশেছেন , তাদের কাছাকাছি থেকে তাদের জীবনের নানান দুঃখ, কষ্ট, সুখানুভবকে প্রাণ দিয়ে অনুভব করেছেন। রবি ঠাকুরের সাহিত্য, দর্শন, সমাজ ভাবনা ও সংস্কারে সেসব চিত্রায়িত হয়েছে।
১৮৯০ সালে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৈতৃক জমিদারির দেখভালের জন্য প্রথম সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আসেন। শাহজাদপুরে কাটানো দিনগুলো কতোটা বর্ণিল ছিল তা তাঁর লিখা চিঠি পত্রে ফুটে উঠে। শাহজাদপুরের মানুষ , তাদের জনজীবন, প্রকৃতি, ফসলের মাঠ, চারদিকের সবুজ কবিকে আকুল করতো এবং তিনি তাঁর এক চিঠিতে লিখেছিলেন সাজাদপুরে আসলে তাঁর যেমন লিখার আগ্রহ আসে তেমন আর কোথাও গেলে হয় না।
শাহজাদপুর ছিল ঠাকুরের সাহিত্যজীবনের একটি আবেগময় ঠিকানা। এখানে বসে কবি তাঁর সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা সহ বিখ্যাত সব সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন। সাজাদপুরে ( কবি শাহজাদপুরকে সাজাদপুর বলেই বিভিন্ন রচনায় লিখেছেন) তিনি কম থাকতেন তবে তাঁর নিজের কাছারি বাড়িতেই তিনি উঠতেন। একটি লিখা পড়ে জানতে পারলাম, করতোয়া নদী দিয়ে তার নিজস্ব বোট পদ্মা এবং চিত্রায় করে খোনকারের জোলা দিয়ে কবি শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে আসতেন।
বেশিরভাগ সময় তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে থাকলেও সাজাদপুরে বসে তিনি রচনা করেছেন অসাধারণ সব সাহিত্য কর্ম। কবির কাছারি বাড়ির বকুল তলায় বসে লিখতেন তবে এখন সেই স্মৃতি বিজড়িত বকুল গাছটি আর নেই। আমরা অনেকেই কি জানি, আমাদের অতি প্রিয় গান ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে .. কবি সাজাদপুরে বসে লিখেছেন? আমাদের প্রাণ আকুল করা গান– তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা তুমি আমার সাধের সাধনা, মম শূন্য গগন বিহারী …কবি এখানে বসে লিখেছেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাজাদপুরে বসেই রচনা করেছেন তাঁর বিখ্যাত গল্প – ছুটি, পোস্টমাস্টার, সমাপ্তি, ক্ষুধিত পাষাণ ইত্যাদি।
এক লিখায় পড়লাম ১৮৯৭ সালে কবির সাজাদপুরের জমিদারি ভাগ হয়ে তাঁর কাকার হাতে চলে গেলে তিনি শাহজাদপুর আসা ছেড়ে দেন।
শাহজাদপুরে কবি রেখে গেছেন তাঁর পদচিহ্ন, রেখে গেছেন সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর ভালোবাসার স্বাক্ষর। শাহজাদপুরে গোয়ালাদের হাতে উৎপাদিত দুধ–দই, ঘোষদের মিষ্টি , ঘি এসব খুব মানসম্মত হওয়ায় কবিগুরু খুব পছন্দ করতেন এবং জোড়াসাঁকোতেও পাঠাতেন। একদিন এক ঘোষ জানালেন চারণভূমির অভাবে গরু পালন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তখন মানুষের এই দুর্দশার কথা চিন্তা করে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশাল চারণভূমি শাহজাদপুরের কৃষকদের লাখেরাজ হিসেবে দান করে দেন যা পরবর্তীতে বাথান হিসেবে লোকমুখে পরিচিতি লাভ করে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রেশম বাড়িতে অবস্থিত এই বাথান জমিদার শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাজাদপুরের শিকড়ের মানুষগুলোর সাথে সংযুক্ত করে রেখেছে আজীবনের জন্য।
জায়গাটা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত পাথার হিসেবে। পাথার হলো এক বিশাল তৃণভূমি যেখানে বাথান জেগে উঠে। বর্ষায় এই সুবিশাল এলাকা পানিতে ডুবে যায়। থৈ থৈ করা পানি তিন থেকে চার মাস স্থায়ী হয়। মাইলের পর মাইল পানি ছাড়া কিছু দেখা যায় না বলে এই জায়গাকে বলা হয় পাথার যেমন আমরা বইপত্রে পড়েছি বা কথায় কথায় বলি অকূল পাথার। সেই কূল উপচানো পানিতে চলাচলের একমাত্র উপায় হয় তখন বোট বা নৌকা। বর্ষা চলে গেলে যখন পানি নেমে যায় তখন ধলাই নদীর তীর ঘেঁষে এই পাথারেই জেগে উঠে দেড় হাজার কিংবা বারোশ একরের বাথান। শাহজাদপুরের এই বাথান বাংলাদেশের বৃহৎ গোচারণভূমি সম্ভবত। শীতামন, আহ্লাদী, রূপসী, কবিতা, শ্যামলী, ময়না ইত্যাদি আরো বিভিন্ন নামে শত শত গরু এখানে পালিত হয়।
দুই বিঘা জমির শোষক জমিদারের মত অসহায় প্রজার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে না নিয়ে বরং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্দশা মোচনে বিশাল ভূমি দান করেছিলেন মানবতাবাদী চেতনার জমিদার আমাদের বিশ্বকবি রবি ঠাকুর ।
১৮৮৯ সালে পারিবারিক জমিদারির দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন এবং ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত মাঝেই মাঝেই দীর্ঘদিন কবি এখানে বসবাস করেছেন। এই শিলাইদহ ছিল কবির সাহিত্য রচনার উর্বরভূমি। সোনার তরীর বেশিরভাগ কবিতা এখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন। খেয়া, বলাকা, চোখের বালি ছাড়াও অনেক কালজয়ী সাহিত্য এখানে জন্ম নেয়। নিজের জীবনের দার্শনিক সত্য গুলো এইখানেই যেন কবি উপলব্ধি করেছিলেন তীব্রভাবে।
নওগাঁর পতিসরও এই মহামনবের পদধূলি প্রাপ্ত। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখা শোনার জন্য কবি ১৮৯১ সালে প্রথম পতিসরে আসেন। এখানে এসে তিনি এখানকার মাটি ও সহজ সরল মানুষদের ভালবাসতে শুরু করেন। জনসাধারণ তাঁকে ভক্তি ও সম্মান করত। গরীব মানুষগুলোর আর্থিক দীনতা কবিকে ভাবাত। পতিসরের সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য তিনি দাতব্য চিকিৎসালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কৃষকদের জন্য তাঁর নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে ব্যাংক পর্যন্ত স্থাপন করে দেন। প্রথমে মন বসাতে না পারলেও পরবর্তীতে পতিসরের সবুজ প্রকৃতির শব্দহীন নীরবতা কবিকে আকুল করেছিল। এখানে বসেই তিনি রচনা করেছেন চিত্রা, সন্ধ্যা, গোরা, ঘরে–বাইরে সহ অন্যান্য সাহিত্যসমূহ। রবিঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প প্রতিহিংসা ও ঠাকুরদা এই পতিসরেই রচিত হয়েছিল। আমাদের সকলের প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত – আমি কান পেতে রই কবি পতিসরে বসে লিখেছেন। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবার পতিসরে আসেন । পতিসরে ঠাকুরের কুঠিবাড়ি তাঁর স্মৃতির স্বাক্ষর হয়ে আছে। ১৬৪ তম জন্মদিনে বিশ্বকবিকে জানাই শ্রদ্ধাবনত প্রণতি।
লেখক : কবি–গল্পকার–প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।