বিড়ম্বনার অন্য নাম যানজট। যা এখন চট্টগ্রামবাসীকে ভোগাচ্ছে তীব্রভাবে। দেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিচ্ছে এ ভয়ঙ্কর সমস্যা। যানজটের কারণে যে সময়ক্ষেপণ ঘটছে- অর্থনীতির বিচারে তার ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ। এ সমস্যা উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেশের রফতানি বাণিজ্যকে অনিশ্চিত করে তুলছে। বিদেশীরা বাংলাদেশের রাজধানীকে অস্বস্তির দৃষ্টিতে দেখে যানজটের কারণে। রাজধানীর পর চট্টগ্রামে তার ভয়াবহতা লক্ষ্যণীয়। বলা যেতে পারে, যেসব কারণে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ বিঘ্নিত হচ্ছে যানজট তার অন্যতম। প্রায় ৭০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম মহানগরী অন্যতম মেগাসিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠার বড় অন্তরায় যানজট।
দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থেকে অনেক সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
যানজটের কারণে মুমূর্ষু রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে সমস্যা হয়। বস্তুত যানজটের কারণে চট্টগ্রামবাসীর সামগ্রিক জীবনধারাই পাল্টে গেছে। একসময় এ শহরে ৩০ মিনিটের দূরত্ব অতিক্রম করতে অনেক সময় চলে যায়। এখন অবস্থা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতেও কত সময় লাগবে আগের থেকে অনেক বেশি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া মানুষ এখন আর কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদানের কথা চিন্তাও করে না। এই বিচ্ছিন্নতা যে সমাজে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন।
গত ১৯ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে ‘দুঃসহ গরম, তীব্র যানজট/ রমজানে নাগরিক জীবনে চাপ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘প্রচণ্ড গরম, সাথে তীব্র যানজট-স্থবির নগরীতে হাঁসফাঁস করছে মানুষ। অসহনীয় দুর্ভোগে পথ চলা দায়। মোড়ে মোড়ে পুলিশ আছে। কিন্তু যানজট সামলানোর চেয়ে মোটরসাইকেল আটকের দিকে নজর বেশি থাকায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজটে স্থবির থাকে নগরী। সাথে পাল্লা গরমের তীব্রতা বাড়ায় মানুষের ভোগান্তি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সামপ্রতিক সময়ে নগরীর যানজট পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। মোড়ে মোড়ে তৈরি হয়েছে যানজট। ব্যস্ততম মোড়ের পাশাপাশি স্কুল-কলেজ এবং শপিং মলগুলোকে কেন্দ্র করেও তৈরি হয়েছে যানজট। এক-দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে এক ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। প্রচুর পুলিশ রাস্তার মোড়ে মোড়ে দায়িত্ব পালন করলেও গাড়ি চলাচল নির্ঝঞ্ঝাট হচ্ছে না। বেলা বাড়ার সাথে সাথে স্থবির হয়ে পড়ে নগরী। ইফতারের আগে পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে। তীব্র যানজটের মাঝে বাড়তি আপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে অসহনীয় গরম।’
ট্রাফিক আইন না মানা, পরিকল্পনার অভাব, ফুটপাত দখল, প্রাইভেটকারের সংখ্যা বিদ্যুৎ গতিতে বৃদ্ধি পাওয়াও যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে সামপ্রতিক সময়ে যানজটের কারণ হিসেবে ভাঙাচোরা রাস্তা এবং কারণে-অকারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িকেও দায়ী করা হচ্ছে। যেখানে- সেখানে পার্কিং, ফুটপাত দখল করে দোকান বসানো ইত্যাকার সমস্যা তো বহু পুরনো। কিছুতেই নগরীর যানজট সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। যানজট পরিস্থিতি দিনই দিনই জটিল হচ্ছে।
যানজট নিরসনে বাংলাদশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফ্লাইওভার, ওভার ব্রীজ নির্মাণ করে রাস্তার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। পরিকল্পনা করা হচ্ছে মেট্রোরেল ও উড়াল সেতু নির্মাণের। অধিকাংশ রাস্তাগুলোকে পাকা সড়কে রূপান্তর করা হচ্ছে। অনুন্নত ভাঙা ও খানাখন্দেপূর্ণ সড়কগুলোকে মেরামত করা হচ্ছে। তবে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে নগর পরিকল্পনাবিদগণ বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এ সুপারিশগুলোর মধ্যে কাউন্টারভিত্তিক বাস ও হিউম্যান হলার চালু, হকার উচ্ছেদ, রেজিস্ট্রেশনবিহীন রিকশা, সিএনজি ট্যাক্সি ও টমটম উচ্ছেদ, নামীদামি কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থী, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ডাক্তার আর রোগীদের প্রাইভেট কার পার্কিংয়ে কড়াকড়ি উল্লেখযোগ্য। এসব সমস্যার সমাধানের পাশাপশি রাস্তাঘাটকে যানজট মুক্ত করতে আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তারমধ্যে রয়েছে : ছোট রাস্তাগুলোকে যথাসম্ভব দীর্ঘ ও প্রশস্ত করতে হবে, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ করতে হবে, লাইসেন্স বিহীন যানবাহন বা অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে, ট্রাফিক আইন আরো কার্যকরী ও ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করতে হবে, রাস্তাগুলোকে বহু লেন বিশিষ্ট করে ধীর গতির ও দ্রুত গতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি।
যানজট জনজীবনে শুধু অস্বস্তি আর দুর্ভোগের কারণ নয় বরং তা অর্থনৈতিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। তাই আধুনিক গতিময় জীবনকে আরো গতিশীল করতে যানজটমুক্ত জীবনের কোনো বিকল্প নেই।