আজ বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। মৃত্তিকার সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার উপর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ কে প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে মনোনীত করেন। উল্লেখ্য যে, থাইল্যান্ডের রাজা আদুলিয়াদেজ ভূমিবল মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব, তার ভাবনা ও আন্তরিকতা এবং এই সম্পদের প্রতি আবেগ সারা বিশ্বে মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করায়, তারই জন্মদিনের স্মরণে প্রতিবছর ৫ই ডিসেম্বর এই দিবসটি পালিত হয়। ২০২৪ সালের এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘মাটির যত্ন: পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা’।
মৃত্তিকা বা মাটি একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদের শক্তি প্রতিটি জীবনের শক্তি নির্ধারণ করে এবং প্রতিটি জীব তা পেয়ে থাকে তার খাদ্যের মাধ্যমে। খাদ্য হলো একটি শক্তিশালী ওষুধ। এ প্রসঙ্গে একটি প্রাচীন বৈদিক প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘যখন খাদ্য ঠিক থাকে, তখন ওষুধের প্রয়োজন হয় না; খাদ্য ঠিক না থাকলে, ওষুধ সেবনে কোন লাভ হয় না’। স্বাস্থ্যকর মাটি উদ্ভিদকে পুষ্টি সরবরাহ করে, যা আমাদেরকে খাওয়ায়, পানিকে ফিল্টার করে আমাদের পানের যোগ্য করে দেয়, বন্যা থেকে রক্ষা করে, লক্ষ কোটি জীবের বাসস্থান হিসেবে কাজ করে এবং আমাদেরকে এন্টিবায়োটিক সরবরাহ করে। অবস্থাভেদে এই মাটি জীবিত এবং মৃত উভয় অবস্থায়ই থাকে। তাই, মহান আল্লাহ তাআলা আল কুরআনে (২:১৬৪, ৭:৫৭, ৩৬:৩৩, ৩৯:২১) উল্লেখ করেছেন যে, ‘আমি মেঘমালা থেকে পানি বর্ষণ করে মৃত ভূমিকে জীবিত করি এবং তা থেকে ফসল বাহির করে আনি’।
উল্লেখ্য যে, আমাদের পায়ের নিচে এক টেবিল চামচ আবাদি জমির মাটিতে বসবাসরত অনুজীবের সংখ্যা পৃথিবীর লোক সংখ্যার চেয়েও বেশি, যারা আল্লাহ তাআলার অন্যান্য সৃষ্টির মতোই অনুগত এবং আল্লাহ তালাকে সেজদা করে। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে (১৩:১৫, ১৬:৪৯, ২২:১৮), ‘যত সৃষ্টি আসমানসমূহে এবং জমিনে আছে, তারা সবাই আল্লাহতালাকে সেজদা করছে, সেজদা করছে চন্দ্র, সূর্য, তারকারাজি, পর্বতসমূহ, বৃক্ষরাজি, জমিনের উপর বিচরণশীল সব জীবজন্তু, এমনকি তাদের ছায়াগুলোও সকাল–সন্ধ্যায় তাদের মালিককে সেজদা করে’। অন্যদিকে এই অনুজীবগুলো পচনশীল সব বস্তুকে ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে এবং মাটিকে দূষণমুক্ত করে তোলে, যা দিয়ে ‘তায়াম্মুম’ পবিত্র হয়ে নামাজ পড়ারও বিধান রয়েছে (আল কোরআন, ৫:৬)।
মাটির চারটি (খনিজ, জৈব, পানি ও বায়ু) উপাদানের মধ্যে জৈব পদার্থ ও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। মাটিতে দীর্ঘ সময় পানি ধরে রাখার অন্যতম মাধ্যম হলো জৈব পদার্থ। অণুজীবগুলো জৈব পদার্থ ও পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না এবং গাছের পুষ্টি উপাদানগুলোও গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসে না। তাই শুষ্ক জমিতে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেও কোনো লাভ নেই।
বর্তমানে আমাদের আবাদি জমির (৮৮,২৯,২৬৬ হেক্টর) প্রায় ৭৫% তার উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। শুধু অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সারের ব্যবহার ও জৈব পদার্থের ঘাটতি এর মূল কারণ। কোনো কোনো অঞ্চলের জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ শতাংশেরও নিচে, যা ৫ শতাংশে থাকা দরকার। একদিকে জৈব পদার্থের ঘাটতি ও অন্যদিকে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারে মাটির অম্লত্বও বেড়ে চলেছে। প্রায় ৪৬ শতাংশ জমির অম্লত্বের (ঢ়ঐ) মান <৪.৫ থেকে ৫.৫ এর মধ্যে যার পরিমাণ ৬ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে থাকা দরকার। এ ধরনের প্রভাব চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাটিতে বেশি।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ মৃত্তিকা রাখার নিমিত্তে করণীয় যত্ন সমূহ:
১। মৃত্তিকার নমুনা পরীক্ষা করা : মৃত্তিকার নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে তার ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যগুলো জানা যায়, যার উপর ভিত্তি করে শস্য নির্বাচন ও সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ যায়। আমাদের কৃষকগণ এ ব্যাপারে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সহযোগিতা নিতে পারেন, যারা নামমাত্র মূল্যে অতি দ্রুত সময়ে মৃত্তিকা পরীক্ষা করে সঠিক পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
২। জৈব সার যোগ করা : জৈব সার বা জৈব পদার্থ হলো মাটির প্রাণ। জৈব পদার্থ মাটির গুণাগুণ উন্নয়নের অন্যতম উপায়। এটি মাটির গঠন উন্নত করে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, উপকারী জীবাণুর কার্যক্রম বৃদ্ধি করে এবং উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজন প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করতে সাহায্য করে। বর্তমানে আমাদের দেশের মাটিকে সুস্থ রাখার একমাত্র উপায় হলো জৈব সার যোগ করা, যা আমরা পশুর গোবর ও গৃহস্থালির পচনশীল ময়লা আবর্জনা থেকে পেতে পারি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার শাখার তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ২ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার পশু রয়েছে। দৈনিক ১০ কেজি হিসেবে উক্ত পশু সমূহ থেকে বছরে গোবর আসে প্রায় ৯ কোটি ১২.৫ লাখ টন যা থেকে কেঁচো, ব্লাক সোলজার ফ্লাই বা ট্রাইকো কম্পোস্ট ইত্যাদির মাধ্যমে কমপক্ষে ৪ কোটি ৬০ লাখ টন জৈব সার উৎপন্ন হবে। যা দেশের সকল আবাদি জমিতে হেক্টর প্রতি ৫ টন হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তাছাড়া, জৈব সারের আরেকটি প্রধান উৎস হলো শহর বন্দর ও গ্রামের সব রকমের পচনশীল আবর্জনা, যেগুলো আমাদের কাছে জঞ্জাল এবং পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। বর্তমানে নগর এলাকার পচনশীল আবর্জনার পরিমাণ দৈনিক প্রায় ১৭ হাজার মেট্রিক টন। কালো সৈনিক পোকার (Black soldier fly larva: Hermetia) মাধ্যমে এই সমস্ত আবর্জনাকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। বিভিন্ন তথ্য এবং আমাদের গবেষণামতে, এই পোকার বেবী লার্ভা মিশ্রিত আবর্জনা ২ সপ্তাহের মধ্যে খেয়ে পূর্ণাঙ্গ লাভায় পরিণত হয় এবং এর সাথে জৈব সারও উৎপাদন হয়। সাধারণত ৬ কেজি মিশ্রিত আবর্জনা থেকে ১ কেজি লার্ভা ও ১ কেজি জৈব সার পাওয়া যায়। এই লার্ভাতে প্রোটিনের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি থাকায় (প্রায় ৫০% এর উপরে) হাঁস–মুরগি, মাছ, পশু–পাখি, বিড়াল–কুকুরের আকর্ষণীয় উত্তম খাবার হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বাংলাদেশেও এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ১ কেজি লার্ভার মূল্য ৫০ টাকা এবং জৈব সারের মূল্য ১৫ টাকা। উক্ত হিসাবে দৈনিক ১৭ হাজার টন আবর্জনা থেকে বছরে আয় আসবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। অনুরূপভাবে গবাদি পশুর গোবর ব্যবস্থাপনা থেকে বছরে উপার্জন হবে কমপক্ষে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। উক্ত ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ব্যবহৃত ভারি ধাতু মিশ্রিত মৎস্য ও পশু খাদ্য এবং রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমিয়ে আসবে। তাছাড়া, ভর্তুকি বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হবে, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান, রক্ষা পাবে আমাদের পরিবেশ এবং সুস্থ থাকবে আমাদের মাটি।
৩। পরিবেশবান্ধব ব্লক ইটের ব্যবহার :
বাংলাদেশের প্রায় ৮ হাজার ইটভাটা আছে। তারা বছরে প্রায় ১৩ কোটি টন মাটি ব্যবহার করে ৩,৫০০ কোটি ইট তৈরি করে। উক্ত মাটি আমাদের ৬৫ হাজার হেক্টর জমির উপরে স্তরের মাটির সমান। ইট তৈরির উত্তম উপাদান হলো আবাদি জমির মাটি। ইটভাটার কারণে পার্বত্য এলাকার পাহাড়গুলোও এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। আবাদি জমির মাটি রক্ষার্থে ইটভাটার মালিক এবং ব্যবহারকারীদেরকে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইটের সুবিধা, তার উৎপাদন ও ব্যবহারে আকৃষ্ট করতে হবে। ব্লক ইট তৈরিতে আবাদি জমির মাটির প্রয়োজন হয় না।
৪। প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিতকরণ
প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে ক্ষয় হতে ৪০০ থেকে ৫ হাজার বছর লাগে। উক্ত বর্জ্য উৎপাদনে চীন প্রথম এবং বাংলাদেশ ১০ম স্থানে রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য উদ্ভিদের পুষ্টি, পানিগ্রহণ ও অনুজীবের কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করে এবং উদ্ভিদের শেখড় গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। পলিব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের সরবরাহ, ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সিদ্ধান্ত সমূহকে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা। তার জন্য সর্বপ্রথম করণীয় হলো প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প পণ্য জনগণের কাছে সহজলভ্য করে দেওয়া, অন্যথায় কোন উদ্যোগই আলোর মুখ দেখবে না। তাছাড়া আইন মানার ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাও অনেক সময় উদাসীন থাকি। যেমন– সরকারি, বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক প্রচারণায় বেদারসে প্লাস্টিকের ব্যানার ও ফেস্টুন ব্যবহার করে যাচ্ছি, এগুলো কিন্তু‘ আমাদের পরিবেশকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে।
আমাদের মাটিকে সুস্থ রাখার স্বার্থে উল্লেখিত যত্ন সমূহ বাস্তবায়ন লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, ও সিটি কর্পোরেশনগুলোকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ মৃত্তিকা রেখে যেতে সক্ষম হব।
লেখক : প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।