বঙ্গোপসাগর সন্নিহিত আনুমানিক ২৫ বর্গকিলোমিটার চর নিয়ে গঠিত মহেশখালী দ্বীপের দুটি উপদ্বীপ মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়ন। ইউনিয়ন দুটির পশ্চিম পাশে রয়েছে প্রায় ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। তার মধ্যে প্রায় ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙা অবস্থায় পড়ে রয়েছে এক দশক ধরে। ভাঙন কবলিত ওই অংশ দিয়ে আশপাশের লোকালয় ও ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়া ঠেকাতে সর্বশেষ চার বছর আগে বসানো হয়েছিল জিও টিউব। তবে চলতি বছরের গত ২৯ ও ৩০ মে নিম্নচাপের প্রভাবে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে জিও টিউব বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বেড়িবাঁধের ওই ভাঙা অংশ দিয়ে লোকালয় ও ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে ধলঘাটা ইউনিয়নের পশ্চিমে মহুরি ঘোনা ও সরইতলা এলাকায় বন্দর চ্যানেলে ড্রেজিং করে প্রকল্পের ডেস্ক ভরাট কাজ করছে ওয়েস্টার্ন গ্রুপ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তারা বেড়িবাঁধের পাশ থেকে বালি উত্তোলন করে বিক্রির কারণে বাঁধ ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকায় মুহুরী ঘোনা ও সরইতলা এলাকায় মানুষের বসবাস ও আমন চাষ চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। ইতিমধ্যে ধলঘাটাবাসী একাধিকবার মানববন্ধনও করেছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের হাত থেকে বেড়িবাঁধ রক্ষার জন্য।
এ বিষয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের শেষ প্রান্তে ধলঘাটা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ–পশ্চিম অংশে হামিদখালী সরইতলা এলাকায় ওয়েস্টার্ন গ্রুপ প্রায় ৩০ ফিট লম্বা এবং ২৫ ফিট উচ্চতার একটি বালির বাঁধ তৈরি করেছে। অথচ এই অঞ্চল পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসকের আওতাধীন বালিয়াড়ি চরের অন্তর্ভুক্ত। এখানে বালু উত্তোলন করতে হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন। তবে ওয়েস্টার্ন গ্রুপ কোনো অনুমতি নেয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য ধলঘাটার জীবনরক্ষী বেড়িবাঁধ ভেঙে ফেললে হাজারো পরিবার ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ধলঘাটার পশ্চিম অংশে বেড়িবাঁধ না থাকলে সাগরের পানিতে একাধিক গ্রাম তলিয়ে যাবে। বিশেষ করে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত বিশাল পাইপের কারণে ইতোমধ্যে বেড়িবাঁধের অনেক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে ওয়েস্টার্ন গ্রুপের চিফ এঙিকিউটিভ অফিসার রাশেদুল হক মিঠু দাবি করেছেন, পাইপের কারণে বেড়িবাঁধ নষ্ট হলে সেগুলো মাটিতে নামিয়ে ফেলা হবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশে বসানো জিও টিউব সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। সাগরের পানি ঢেউয়ের সঙ্গে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ উপচে পাশের ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ছে। স্থানীয়রা জানান, বেড়িবাঁধের জিও টিউব বিলীন হওয়ার দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আমন চাষিরা চাষাবাদ করতে পারবেন কি না তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মানুষ তাদের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কার করার দাবি জানান তারা।
মাতারবাড়ী ইউনিয়নে দায়িত্বরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নুরুল হোছাইন মোহাম্মদ তৈয়ব বলেন, ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে ষাইটপাড়াসহ আশপাশের চারটি গ্রামে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে এসব এলাকার অন্তত ৮০ একর জমিতে আমন চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ বলেন, জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কঙবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি নিম্নচাপের প্রভাবে মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় অন্তত ১ হাজার ৬০০ মিটারের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপাতত বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানি টেকানোর জন্য ভাঙা বেড়িবাঁধের ওপর জিও টিউব বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কঙবাজারের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জামাল মুর্শিদ বলেন, মাতারবাড়ী ও ধলঘাট ইউনিয়নে স্থায়ী বেড়িবাঁধের জন্য প্রায় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় চারপাশে ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার সুপার ডাইকের আদলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ ও ৭টি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া খনন করা হবে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার কোহেলিয়া নদী। গত এপ্রিলে প্রকল্প প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।