জায়তুননেসা জেবুর ‘আয়রে সোনা লক্ষ্মী সোনা’

সুসেন কান্তি দাশ | মঙ্গলবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

বই, সেতো সকল অন্ধকার দূর করে সুরের আলো ছড়িয়ে দেয় সবখানে। সেই বইটি যদি হয় ছন্দের, তবে দ্বন্দ্ব ভোলার আনন্দে ভরে ওঠে মন। সুখের ছোঁয়ায় দুঃখ তাড়ানিয়া গানের মতো তা হয়ে ওঠে অনন্যঅসাধারণ। আজ তেমনি একটি পাঠক হৃদয় জয় করা একটি নতুন বই জায়তুননেসা জেবুর ‘আয়রে সোনা লক্ষ্মী সোনা’ ছন্দ ছড়ার বই নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাই।

এই বইতে ছন্দ তাললয় মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠেছে। গ্রন্থের লেখক অতি যত্ন করে ছড়াগুলি লিখেছেন। বইতে বিশটি ছড়া সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশেষ করে ছোটরা এই বইয়ের প্রতি অধিক আকর্ষিত হয়েছে। বলতে গেলে ছোটদের স্বপ্নরাজ্যের কথাগুলো ছড়াকার ছন্দের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ফেলে আসা দিনের কথাই বলি। যখন জীবন যাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন আসেনি। তখন শিশু কিশোররা অবসরে রূপকথার গল্প ছড়ায় মেতে উঠতো।কখনোবা দাদা দাদীর কোলে শুয়ে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর গল্প শুনতো। মায়েরা দোলনা ঠেলে ছন্দ ছড়ার তালে তালে ঘুম পাড়াতোএই যেমন খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে.. বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসেসময়ের স্রোতে ভেসে সেই সুর আজো কানে ভেসে আসে। তার সাথে যখন দূর হতে কেউ সুর করে জায়তুননেসার ছড়া ‘আয়রে সোনা লক্ষ্মী সোনা, /ঘরে এবার আয়/ সন্ধ্যে হলো পড়তে বসো / ডাকে ফুফু মায় .. পাঠ করতে শোনা যায়, তখন এক অফুরন্ত প্রাণের আবেশে মন ছেয়ে যায়।

জায়তুননেসা জেবু পাঠক প্রিয় একজন ছড়াকার। তার ছড়ায় মিশে থাকে স্বদেশপ্রেম, বাংলা ভাষার সৃষ্টিশীলতা, প্রকৃতির সৌন্দর্যতা আর সৃষ্টির আনন্দ। ‘আয়রে সোনা লক্ষ্মী সোনা’ গ্রন্থের প্রথম ছড়া ‘মাগো আমার মা’। এ ছড়ায় তিনি লিখেছেন ‘জননীগো তোমার কোলে, জুড়ায় আমার প্রাণ, তুমিই আমার স্বর্গ মাগো, তুমিই চিরস্থানমায়ের ভাষা’ ছড়ায় লিখেছেন মাতৃভাষা বাংলা আমার, মাতৃভাষা বাংলা, এই ভাষাতেই কথা বলে মুঠেমজুর কামলাবলতে গেলে মামায়ের ভাষাকে সবার উপরে ঠাঁই দিয়েছেন। খোদা তালার প্রতি সবার রয়েছে বিশ্বাস, ছড়াকার ও তার ব্যতিক্রম নন।।’ তোমারই গান গাই ছড়ায় তিনি লিখেছেন ‘আল্লাহ তুমি অন্তর্যামী, অন্তর করো সাফ, আমি পাপী আমি তাপী আমায় করো মাফ

শীত মানে পিঠার আমেজ, শীত মানে নতুন দিনের আবাহন। শীতকালে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে ছুটির আনন্দে মাতোয়ারা হওয়া। ‘শিশিরের টুপটাপ’ ছড়ায় ছড়াকার তেমনি আনন্দের মাত্রা যোগ করেছেন। শীতকালে শীতপিঠা খেতে পড়ে ধুম, লেপ কাঁথা কম্বলে ভারি মজা ঘুমবরষার আনন্দে উদ্বলিত হয় সকলের মন ‘জল থইথই’ ছড়ায় জয়তুননেসা জবু লিখেছেন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে,/ একনাগাড়ে কদিন ধরে। পাহাড় হতে নামছে ঢল /পাইনা খুঁজে মাটির তল।

ছেলেবেলার পুতুল বিয়ের মজা কতই না মজাদার। কলা পাতার বাঁশি বাজিয়ে, থালয় ফুল সাজিয়ে মনের ছলে কতেই না আনন্দের সমারোহ করে এসেছি। ‘পুতুল বিয়ে’ ছড়ার মাধ্যমে আবার যেনো তার নিজের কথা ফিরে আসে। তিনি লিখেছেন টুনটুনিটা ঢোল বাজিয়ে/ মাতায় সারা পাড়া/ পুতুল বিয়ে দেবে খুকু/ ভারী নজর কাড়া / রসের হাঁড়ি টইটম্বুর / সবাই মিলে খাবে/ পুতুল বিয়ে দিয়ে শেষে/ যে যার বাড়ি যাবে..

ইদ মানে আনন্দ, ইদ মানে কোলাকুলি, ইদ মানে ভুলে থাকা ভেদাভেদ। ‘ইদ এসেছে’ ছড়ায় ছড়াকার লিখেছেনইদ এসেছে ইদ এসেছে খুশির সীমা নাই / ইদের আমপজ পড়ে মনে, দারুণ শান্তি পাই.. পথে চলতে চলতে অনেকে গেয়ে ওঠে আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছিবাঁশি কই আগের মতো বাজেনাআহা কতো রঙিন মেলায় আমাদের ফেলে আসা রঙিন দিন থমকে আছে। তার গতিধারায় গতি আনার চেষ্টা করেছেন ছড়াকার। তিনি লিখেছেন লাল দঘিতে চলছে মেলা সবাই মিলে যাবো / নানা রকম কিনবো জিনিস মন্ডা মিঠাই খাবো।

একুশ মানে বুকের ঘরে বাংলা ভাষার ঝংকার। পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি, যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করে অমরত্ব লাভ করেছেন। একুশ এলেই ছড়ায় ছড়াকার লিখেছেন একুশ এলেই গাছে গাছে পলাশ ফোটে,/ একুশ এলেই ভাইয়ের খোঁজে মনটা ছোটে।

বলতে হয় জয়তুননেসা জেবুর ‘আয়রে সোনা লক্ষ্মী সোনা’ বইটি অবারিত আনন্দের ঝর্ণা হয়ে, নতুন দিনের কথা নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। লেখকের প্রতিটি ছড়া জাগরণের কথা বলে, সত্যের কথা বলে, সুন্দরের কথা বলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বই ছোটদের এগিয়ে যাবার প্রেরণা যুগিয়ে যায়। এই বইটি প্রকাশ করেছেন শৈলী প্রকাশন, বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন উত্তম সেন, বইয়ের ভেতরের ছবি এঁকেছেন, নাটু বিকাশ বড়ুয়া। দুইশত বিশ টাকা মূল্যের বইটির প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৫। এই বই সকলের মানসপটে একটি আশার রঙধনু গড়ে যাবে, এই আশা রাখি।

লেখক : আইনজীবী, শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগৌরব ও আত্মত্যাগের মহান বিজয়ের মাস
পরবর্তী নিবন্ধনতুন এক বাংলাদেশের অপেক্ষায় আছি