আগামী ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ উপলক্ষে জাহাজভাঙা শিল্পের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জগুলো বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে, বিশেষত গ্রিন শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড সম্পর্কে। প্রাচীন এবং ট্র্যাডিশনাল শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে গ্রিন শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও শিল্পের মধ্যে শোভন কাজের বাস্তবায়ন তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাহাজভাঙা শিল্প মেরিটাইম শিল্পের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা পুরাতন ও অব্যবহারযোগ্য জাহাজ ভেঙে পুনর্ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, প্রাচীন পদ্ধতিতে জাহাজভাঙার কার্যক্রম প্রায়ই পরিবেশ এবং শ্রমিকদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। সুতরাং বলা বাহুল্য, প্রাচীন এবং ট্র্যাডিশনাল শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড সমূহ জাহাজভাঙা শিল্পকে টেকসই ও ন্যায়সংগতভাবে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের প্রধান অন্তরায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ–বিলস এর তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিগত ৯ বছরে মোট ১২২ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ জন শ্রমিক মারা যায়। তবে ২০২৪ সালে এই অবস্থার কিছু উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ইতিমধ্যে চলতি বছরের ৫ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে এবং এই ৫ মাসে ছোটখাটো কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও নিহত হয়েছে একজন শ্রমিক। বিগত ২ বছরে দুর্ঘটনায় নিহতের হার ছিল ৭ জন করে, যা পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় নিম্নমুখী। এর ফলে এটি প্রতীয়মান করে যে, শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ বিশেষত মালিক ও শ্রমিকের সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং সকল ইয়ার্ডকে যত দ্রুত সম্ভব গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে রূপান্তর করে জাহাজভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনার হার পূর্বের তুলনায় অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
সামপ্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তোলার সমন্বিত প্রচেষ্টা চলছে। গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলিতে ইয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে পরিবেশ দূষণ কমাতে এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত চারটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং আরো একাধিক ইয়ার্ড গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ট্র্যাডিশনাল এবং সাধারণ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে রূপান্তর নিঃসন্দেহে টেকসই উন্নয়নের দিকে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই ইয়ার্ডগুলি কাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি করেছে, যার ফলে এই সকল ইয়ার্ডে পরিবেশ দূষণ এবং কর্মস্থলে দুর্ঘটনার হার পূর্বের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে শ্রমিকদের অধিকার ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখনো ব্যাপক কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
টেকসই উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শোভন কাজের বাস্তবায়ন। গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কাঠামোগত এবং নিরাপত্তার উন্নতি সত্ত্বেও শ্রমিকদের অধিকার, কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান এবং দুর্ঘটনায় আহত–নিহতদের আন্তর্জাতিক মানের সাথে সংগতিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ এবং জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের বিষয়। জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য বহুমুখী পদক্ষেপের প্রয়োজন। সবার আগে শ্রমিকদের জন্য শ্রম আইনের বাস্তবায়ন ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবার প্রচলন ও উন্নয়নের বিষয়কে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। সর্বোপরি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রমমান অনুযায়ী শ্রমিকদের সকল অধিকার সুরক্ষিত আছে তা নিশ্চিতকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
রাস্ট্র, মালিকপক্ষ, এই সেক্টরে সক্রিয় বিভিন্ন এনজিও কিংবা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের জাহাজভাঙা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে মনোনিবেশ করতে হবে। প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধি করা গেলে তাদের আরও ভাল বেতনের চাকরি এবং উন্নত ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়। এটি তাদের জীবন–জীবিকা উন্নত করতে এবং শিল্পের টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, একজন দক্ষ শ্রমিক নিজেই নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সাথে সাথে শিল্পকেও টেকসই করতে সহায়তা করে।
শ্রমিকদের জীবন–জীবিকার উন্নতির পাশাপাশি জাহাজভাঙার সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব মোকাবেলা করারও প্রয়োজন রয়েছে। যদিও গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো পরিবেশ দূষণ কমাতে পূর্বের তুলনায় অগ্রগতি করছে, তথাপি পরিবেশের উপর শিল্পের সামগ্রিক প্রভাব কমানোর জন্য আরও কিছু করা দরকার। এর মধ্যে রয়েছে যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ বান্ধব জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ অনুশীলনের বাস্তবায়ন।
তাছাড়া, জাহাজভাঙা শিল্পে সক্রিয় সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং সুদৃঢ় আন্তঃসম্পর্ক থাকা প্রয়োজন।এই লক্ষ্যে শ্রমিক, স্থানীয় সমপ্রদায়, সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান তথা শিল্প মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সকল অংশীজনের চিন্তা চেতনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে এক হয়ে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে অংশীজনদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক কিংবা বহুপাক্ষিক সংলাপের আয়োজন করা যেতে পারে। বৃহত্তর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা জাহাজভাঙা শিল্পকে আরও টেকসই ও দায়িত্বশীল পদ্ধতিতে পরিচালিত করতে পারি।
আসুন, পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই জাহাজভাঙার অনুশীলনের দিকে উত্তরণের যে সূচনা হয়েছে, তা যেন কেবলমাত্র ইয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্যে সীমিত না রেখে আরও বেশি ন্যায়সংগতভাবে শ্রমিকের সকল আইনগত অধিকার–তথা সকল শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র–পরিচয়পত্র প্রদান, সকল ধরনের সবেতন ছুটির চর্চা, শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রম ঘণ্টা ও বিশ্রাম, শ্রমিকের চাকুরি অবসানের পর আইন সম্মত ক্ষতিপূরণ, শ্রমের ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তি, শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, শ্রমিকের সংগঠিত হওয়া ও দরকষাকষি করার অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করি।
লেখক : সমন্বয়কারী, জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও
নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্র, বিলস–ডিটিডিএ প্রকল্প