নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করার জন্য কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করল, আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। তাদের নিকট তো আমার রসুলগণ স্পষ্ট প্রমাণ এনেছিল, কিন্তু এরপরও অনেকে পৃথিবীতে সীমালংঘনকারীই রয়ে গেল। -আল-কোরআন ৫ঃ ৩২।
“যাঁরা গণহত্যা চালিয়েছে তাঁরা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তাদের ক্ষমা করলে ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে না।” -জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান-১৯৭২ সালে ছয়ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে।
কিন্তু বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্ষমতা লিপ্্সু শাসকদের রক্ত চক্ষু বারবার সভ্যতাকে পদদলিত, ক্ষতবিক্ষত করেছে। রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়ে জনতার আগুয়ান শক্তিকে রুখে দেয়ার বর্বরতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ক্ষমতা পাগল শাসক শ্রেণি। এই রকম অজস্র ইতিহাসের এতদকালের নৃশংসতম উদাহরণ ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ। ১৯১৯ সালের তেরই এপ্রিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের গদি সুরক্ষার জন্য চরম পথ বেছে নেয়। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আর.ই.এইচ ডায়ারের নেতৃত্বে বৃটিশ বর্বর বাহিনী সেদিন শান্তিপূর্ণ সমাবেশে, পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় গণহত্যা চালায়। এতে ১৬৫০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয় মাত্র দশ মিনিটে। এই হত্যাকাণ্ডের এত জগন্যতম দিক ছিল যে সমস্ত জনতাকে ময়দানে কোন বাধা ছাড়াই ঢুকতে দেয়া হয়। তারপর প্রবেশ পথসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় যাতে কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে না পারে। সেদিন কোলের শিশু থেকে ছেলে যুবা বৃদ্ধ অনেকের বুকই বুলেটে ঝাঁঝড়া হয়ে যায়। এক হিসেব অনুসারে এতে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় এক হাজার জন লোক যাঁরা ছিলেন নিরস্ত্র এবং আহতদের সংখ্যা ছিল ২০০০ জন। এ হত্যকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বময় প্রতিবাদের ঝড় উঠে। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে ৩০ মে নাইট খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন। ইতিহাসে “জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড” বর্বরতার নৃশংসতার উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে আজো।
সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে এরপর। ঊনসত্তর বছরে বিশ্বময় ঘটেছে অনেক উলটপালট। দেশে দেশে রাজনীতি, রাজনৈতিক অধিকার, শাসন পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। বাঙালি স্বাধীনতার জন্য রক্তের সাগর পাড়ি দিয়েছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ ঘটে পাকি হায়েনাদের সুপরিকল্পিত গণহত্যা। স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে এই রক্তের মূল্যে। বাংলাদেশের সংবিধানে আছে তার স্বীকৃতি। সংবিধানের “১৯ তে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র। যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।” অথচ এ গণতন্ত্রের জন্যই ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি স্বাধীনতার সূতিকাগার চট্টগ্রামের মাটিতেই ঘটে গেলো এক নৃশংসতম গণহত্যা। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সাথে যাঁর রয়েছে সাদৃশ্য। দুটোর মিল হচ্ছে রাজনৈতিক সমাবেশে শাসক শ্রেণির রোষ, অজস্র রক্তপাত, বেপরোয়া গুলীবর্ষণ ইত্যাদিতে।
২৪ জানুয়ারি পনের দল নেত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ বিমানযোগে চট্টগ্রামে আসেন। লালদীঘির সমাবেশকে সফল করতে প্রচার, প্রস্তুতি ছিল আগে থেকেই। জনসভার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক আজাদীসহ স্থানীয় পত্রিকাসমূহে। প্রশাসন এ সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। এই কথা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় সভার দিন। শেখ হাসিনার আগমনকে কেন্দ্র করে পতেঙ্গা বিমান বন্দরে জনতার ঢল নামে। খোলা ট্রাকে ছিলেন শেখ হাসিনাসহ জাতীয় ও চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ। পতেঙ্গা বিমান বন্দর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক মোড় মাত্র পঁচিশ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে পাঁচঘণ্টারও বেশী। পথে পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ষোলটি বড় আকারের সমাবেশে বক্তৃতা করেন। কোথাও পুলিশ বা প্রশাসন বাধা প্রদান করেনি। নেত্রী এসব সমাবেশ শেষ করে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি ভবনে আইনজীবীদের মতবিনিময় সভায় যোগ দেয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন। নেত্রীর মোটর শোভাযাত্রার আগে পিছে জনতার ঢল। কোতোয়ালী মোড় থেকে লালদীঘি ময়দান এলাকায় ছিল তখন পুলিশের কড়া নজরদারি। কোতোয়ালী মোড়ে ছিল কাঁটা তারের ব্যারিকেড। কিন্তু শোভাযাত্রা কোতোয়ালী মোড়ে পৌঁছুলে পুলিশ কাঁটাতারের ব্যারিকেড নিজেরাই তুলে নেয়। জনস্রোত এগিয়ে যায়। অগ্রভাগ যখন মুসলিম হাই স্কুলের সামনে তখনই হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠে পুলিশ। এক নারকীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলী বর্ষণের মাঝেই শেখ হাসিনা গর্জে উঠেন। নেত্রীকে বলতে শুনা যায় “এই পুলিশ কি করছ, কাকে গুলী করছ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে তোমরা গুলী করনা।” অজস্র গুলীতে লুটিয়ে পড়েন অনেকে। ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। শেখ হাসিনাকে বহন করা ট্রাকের হেলপার আবদুল মান্নানও গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। আইনজীবী ভবন থেকে এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলের নেতৃত্বে আইনজীবীরা মিছিল নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়ে আসেন। তাঁরা ট্রাকটিকে ঘিরে মানবপ্রাচীর গড়ে তোলেন এবং আইনজীবী ভবনে নিয়ে যান। সেদিন চট্টগ্রামের ত্রিশটি স্পটে ৭০০ রাউন্ডেরও বেশি গুলী হয়। ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায় ১১ জন। পরবর্তীতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। বেদনাদায়ক ও নির্মম ব্যাপার হচ্ছে সেই দিনের ঘটনায় নিহতদের লাশ পুলিশ আত্মীয় স্বজনদের হাতে তুলে দেয়নি। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন পুলিশ লাশগুলো হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বলুয়ারদিঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলেছে। সেদিন বলুয়ারদিঘির পাড় সংলগ্ন এলাকায় ছিল পুলিশের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে দেশ। বিশ্ব মানবতা ধিক্কার জানায়। চট্টগ্রাম গণহত্যা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে করে বেগবান। জাতীয় নেতৃবৃন্দ এ হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সাথে তুলনা করেন। এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিবিসির সাথে সাক্ষাতকারে সেদিন বলেছিলেন ‘তৃতীয় বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা হয়েই থাকে।’
চট্টগ্রাম হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। হত্যাকাণ্ডের ধরনেরই স্পষ্ট ছিল এর টার্গেটে ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। মামলায় শেখ হাসিনা হত্যাপ্রচেষ্টার কথা সাক্ষে এবং রায়েও উল্লেখ করা হয়েছে। তিন দশক ধরে চলমান ছিল চট্টগ্রাম হত্যকাণ্ড মামলা। ১৯৯২ সালের পাঁচই মার্চ এডভোকেট শহীদুল হুদা মামলা দায়ের করলেও মামলাটি চাপা পড়ে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। মামলার চার্জশীট হয় ৯৯ সালে। প্রায় ২১ বছর মামলায় ৫৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। অবশেষে গত বছরের ২০ জানুয়ারি বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ ইসমাইল হোসেন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মাননীয় বিচারকের রায়ে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ উঠে এসেছে। শেখ হাসিনার হত্যা প্রচেষ্টার কথাও উল্লেখ আছে।
২৪ জানুয়ারি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের রক্তঝরা দিন। গণ অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালিত হয় দিনটি। ঐতিহাসিক এই দিনটিতেই ঘটে স্মরণকালের এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু জাতীয়ভাবে এই দিন অর্থাৎ “চট্টগ্রাম গণহত্যা” বা শেখ হাসিনার হত্যা প্রচেষ্টার রক্তঝরা দিনটি উপেক্ষিত। প্রথম দিকে দিনটি আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো জাতীয়ভাবে পালন করেছে। ক্রমেই বিস্মৃতির চোরাবালিতে হারিয়েছে দিনটি। চট্টগ্রাম হত্যাকাণ্ডের জাতীয় রাজনীতির হলেও তা এখন গুরুত্ব হারিয়েছে। শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ ২৪ জানুয়ারিতে প্রাণ হারানো মানুষগুলোর অসহায় পরিবারের খোঁজ রাখেননি। চট্টগ্রাম রাজনীতির অগ্রভাগের ধারা হিসেবে চিহ্নিত হলেও বঞ্চনা, উপেক্ষার যে শাসক নীতি আছে তাঁর প্রভাব এক্ষেত্রে পড়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলের কর্মসূচিতে প্রাণ হারিয়েছে মিছিলের মানুষগুলো। গণতন্ত্রের মুক্তিই ছিল তাদের প্রত্যাশা। অথচ গণতন্ত্রের আবহাওয়ার পরশ থেকে এরা বঞ্চিত। ২৪ জানুয়ারির ত্যাগকে রাজনীতিতে চিরজাগরুক রাখার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের ওপরই বর্তায়। অথচ জাতীয় নেতৃত্ব চট্টগ্রাম গণহত্যার দিনটি ভুলতে বসেছেন। গণতন্ত্রেই শহীদরা অমর, গণতন্ত্র চর্চার মাঝেই ওরা বেঁচে থাকবেন কাল থেকে মহাকালে।
লেখক : সাংবাদিক, পেশাজীবী সংগঠক, চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী