সুফিবাদের গভীরতার এক বিশ্বস্ত নাম মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি, যিনি রুমি নামেই সারাবিশ্বে পরিচিত। ফার্সি কবি জালালুদ্দিন রুমি ছিলেন সুফি সাধক এবং কালক্রমে হয়ে ওঠেন সুফি। তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭ সালে আফগানিস্তানের বালখে জন্মগ্রহণ করেন। পরে পরিবারের সাথে বাগদাদ, মক্কা হয়ে পৌঁছে যান তুরস্কের কোনিয়াতে। তাঁর বেশিরভাগ সাহিত্যকর্ম কোনিয়াতেই রচিত। এখানেই তিনি ১৯৭৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রুমির শ্রেষ্ঠ কাজ হলো ‘মসনবী’, যাতে প্রায় ২৭০০০ পংক্তি রয়েছে। তাঁর অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ হলো “দিওয়ান–ই–শামস–ই–তাবরিজি।” এর বাইরেও তিনি আনুমানিক ৩৫০০০ ফার্সি শ্লোক এবং ২০০০ রুবাইয়াৎ লিখেছেন। রুমির সুফি মতবাদ আমেরিকাসহ আজকের পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়। আটশ বছর পরের মানুষ এখনো রুমি নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন।
ইসলামের শুরুর দিকেই সুফিবাদের জন্ম হয়, তবে আধুনিক সুফিবাদের সাথে মূল সুফিবাদের দ্বন্দ্বও স্পষ্ট! মূল সুফিবাদের জন্ম হয় সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের নতুন ধারা হিসেবে, যে ধারা ইসলামের সকল ফরয আইন মেনে তার সাথে নিজেদের ধ্যানধারণা নিয়ে এগিয়ে যায়। সুফিবাদ আসলে সরাসরি মানুষের পরিশুদ্ধতার সাথে জড়িত, আত্ম–সম্পর্কীয় আলোচনা যার মুখ্য বিষয়। আরো সহজভাবে বলতে গেলে সুফিবাদের মূল নিজ প্রাণের সাথে, নিজের জীবাত্মার সাথে, শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড়জগত থেকে মুক্তি পাওয়া।
সুফিবাদের আলোচনায় যে নামটি অবশ্যই উচ্চারিত হবে সেটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির, যিনি ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে রুমি নামেই বেশি পরিচিত। কারো কাছে আবার তিনি মাওলানা রুমি, তবে সর্বোপরি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি হিসেবেই সুপরিচিত। বর্তমান আফগানিস্তানের বালখে জন্ম নেয়া রুমির শৈশব থেকেই সুযোগ হয়েছিল জ্ঞান আর জ্ঞানীদের সাথে মিলেমিশে বড় হওয়ার। মাওলানা রুমির জ্ঞানসাধনা আর তার জীবন বুঝতে গেলে তার পরিবার সম্পর্কে জানা প্রয়োজন ।
তাঁর বাবা বাহাউদ্দিন একজন সুপরিচিত আলেম। সেই সাথে তিনি বালখের একজন ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞও ছিলেন। রুমির অনুসারীদের কাছে তিনি ‘সুলতান আল–উলামা’ নামেই পরিচিত। বাবার হাত ধরেই শৈশবে ধর্মীয় জ্ঞানের পথে পা বাড়ান রুমি। তাঁর চিন্তা–চেতনার মূল স্রোতের শুরু সেখান থেকেই। পরিচিত আলেম সমাজের সাথে চলাফেরা, পড়াশোনার পাশাপাশি বহু মানুষের সাথে আলাপ–আলোচনাও তাঁর চিন্তার গভীরতার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। রুমির মা মুইমিনা খাতুনের পরিবার ছিল সেসময়ে বেশ সম্মানিত। তাঁর পরিবার বহু যুগ ধরেই ইসলামের হানাফি মাযহাবের প্রচারকের ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছিল । জালাল উদ্দিন রুমির শৈশবের ঘটনা খুব একটা জানা যায় না, তবে বেশ কিছু ঘটনায় এটা স্পষ্ট হয় যে তিনি শৈশব থেকেই আলাদা। রুমির বয়স যখন মাত্র ১১ বছর, সে সময় মঙ্গোলরা মধ্য এশিয়ায় আক্রমণ করে। ফলে মাওলানা রুমির বাবা তাঁর কিছু অনুসারীসহ তাদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র রওয়ানা হন। সেসময় রুমি চলার পথে অনেকের সান্নিধ্যে আসেন, যা তার জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে রুমি মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেসময় তাঁর সাথে দেখা হয় পারস্যের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি আত্তারের। পারস্যের এই কবির একটি বিখ্যাত বই আছে ‘আসারনামা’ নামে যেটি ইহজগতের গভীরতা নিয়ে লেখা। পরবর্তীতে এই বই মাওলানা রুমীর চিন্তা–চেতনাকে স্পর্শ করে। আত্তার রুমিকে বইটি উপহার দেন, কারণ তিনি তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন এই বইয়ের মর্ম রুমি বুঝবেন। ১২২৮ সালের দিকে আনাতোলিয়ার শাসক আলাউদ্দিন কায়কোবাদ মাওলানা রুমির বাবা বাহাউদ্দিন এবং তার পরিবারকে আনাতোলিয়ার কোনিয়ায় নিমন্ত্রণ করে আনেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুরোধ করেন, যার ফলশ্রুতিতে রুমির পুরো পরিবার সেখানে থেকে যায়। তাঁর বাবা বাহাউদ্দিন সেখানের একটি মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর তিনি মারা গেলে মাত্র ২৫ বছর বয়সে রুমি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে সবার কাছে মাওলানা ও মৌলভী হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা ছিল বলেই তিনি সেসময় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন। তার বাবার এক ছাত্রের কাছে তিনি টানা নয় বছর পড়াশোনা করেন ইসলামী শরিয়া আর সুফীবাদ নিয়ে। তার লেখায় জীবন নিয়ে যেসব গভীর ভাবনা আমাদের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়, সে অবস্থায় যেতে আসলে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে জ্ঞানের এক বিশাল পথ। সেই সাথে নিজের ভেতর আলো জ্বালিয়ে রাখতে করতে হয়েছে নানারকম জ্ঞানগত পরিশ্রম, কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজই হলো আলো বিলানো। তাইতো রুমি বলতেন– “মোমবাতি হওয়া সহজ কাজ নয়, আলো দেয়ার জন্য প্রথমে নিজেকে পুড়তে হয়
শেখার জন্য তুমি পড়াশোনা করো, কিন্তু বুঝতে হলে তোমার প্রয়োজন ভালবাসা”
(শামস তাবরিজি– জালালুদ্দিন রুমি)
মাওলানা রুমির জন্ম অত্যন্ত সচ্ছল পরিবারে। শামস তাবরিজি ছিলেন সমাজ থেকে একটু আলাদা, যিনি নিজেকে সম্পদ থেকে সবসময় দূরে রেখেছেন। আধ্যাত্মিকতা আর সম্পদের মোহ থেকে মুক্ত থাকার দরুণ তিনি সবসময় কিছু মানুষের কাছে অন্যরকম মর্যাদা পেতেন। লোকমুখে প্রচলিত ছিল, তিনি একজন শিষ্য খুঁজতেন যে কি না তার পরে আধ্যাত্মিকতার কাজটি এগিয়ে নেবে। শামস তাবরিজির সাথে যখন রুমির প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন রুমির বয়স মাত্র ২১ বছর। সেই সময় মাওলানা রুমিকে শিষ্য হিসেবে পছন্দ করেন তাবরিজি, কারণ বয়স কম হলেও তিনি রুমির ভেতর জ্ঞানের গভীরতা খুঁজে পান। যখন মাওলানা রুমির বয়স ৪০ বছর হয়, তখন শামস তাবরিজি আবার রুমিকে খুঁজে নেন। কারণ তিনি মনে করতেন এটাই সেই বয়স যখন রুমি নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন আকাশের বিশালতায়! তাঁর সাথে আলাপ–আলোচনায় রুমি যেন অন্য এক জগতের সন্ধান পান, যেখানে দুনিয়ার অনেক বড় বিষয়গুলো ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে। রুমির সাথে তাবরিজির জ্ঞানের সম্পর্ক মানুষ মেনে নিতে চায়নি! একে তো তাবরিজি সমাজ থেকে পুরোপুরি আলাদা, সমাজের অধিকাংশ নিয়ম–কানুনকে তিনি সবসময়ই একরকম প্রত্যাখ্যানই করেন। তার উপর রুমির পরিবার সমাজে সুপরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত। যদিও তাবরিজি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত এক বাদশা, তবে অধিকাংশ মানুষ সেই হিসেবে কোনোদিন তাকে বিচার করতে যায়নি। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই এগিয়ে যান রুমি। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, ঠিক তখন রুমি করে বসলেন এক অদ্ভুত কাজ! তিনি তার সৎ মেয়ে কিমিয়ার সাথে তাবরিজির বিয়ে দিয়ে দেন। এতে করে সেই সমাজে তাবরিজির একটা শিকড় জন্মে, যা প্রত্যাখ্যান করে কেউ আর তাকে ছুঁড়ে ফেলার সাহস করে না। তবে তাবরিজির সাথে রুমির এই জ্ঞানসাধনা বেশি দিন টেকেনি। তার সাথে কিমিয়ার বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই কিমিয়া মারা যায়। ফলে তার শিকড় আবারও আলগা হয়ে যায়।
তাবরিজির হারিয়ে যাওয়া বা মৃত্যুর অনেক দিন পর মাওলানা রুমি তাঁকে ফিরে পাওয়ার আশায় বিভোর ছিলেন। তারপর যখন বুঝতে পারলেন জ্ঞানের সাগরের সাথে তার আর দেখা হচ্ছে না, তখন তিনি তাবরিজির মৃত্যুর ঘোষণা দিলেন। তাকে হারিয়ে ফেলার শোকে রুমি লিখলেন ‘দেওয়ান–ই শামস–ই তাবরিজি’। এখান থেকেই যেন এক অন্যরকম রুমির আবির্ভাব ঘটে। নতুন রুমি সবার কাছে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। সুফিবাদের কথা এমনভাবে বলতে থাকেন যে দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিষয় তখন কেউ দেখেনি। শামস তাবরিজিকে অমর করতে তাঁর গ্রন্থ ‘দেওয়ানুই শামস–ই তাবরিজি’তে একে একে যোগ করতে থাকেন গজল, কবিতা, যা আধ্যাত্মিকতার এক নতুন পাঠ হিসেবে সবার কাছে প্রকাশিত হয়। লোকমুখে তখন প্রচলিত হয় যে, তাবরিজির মৃত্যুর পর মাওলানা রুমিই তাবরিজি হয়ে ওঠেন। কারণ ততদিনে মাওলানা রুমির লেখা একেকটি লাইন মানুষের ভেতর নাড়িয়ে দিতে থাকে, ক্ষমতাশীল পৃথিবীকে তুচ্ছ করে দেয়ার মতো সব লেখা লিখতে থাকেন তিনি। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি দিন দিন যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করলেন। সুফিবাদ আর মানুষের নিজের আলো জ্বালাতে যেন আরও দুর্বার, দুরন্ত হয়ে উঠলেন। লেখালেখির আগে–পরে ধ্যানের সাথে এমন মগ্নভাবে তিনি ঘুরতে থাকতেন, যেন এই জগত ছেড়ে তিনি অন্য জগতে চলে গিয়েছেন! সুফিবাদের ইতিহাসে কখনও কেউ নিজেকে ধরে রাখতে চায়নি, বরং চেয়েছে স্রষ্টার কাছে সঁপে দিতে। রুমি প্রতিদিন নিজেকে সঁপে দিতেন স্রষ্টার কাছে। এ ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন,
“আমরা শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছি
যেমনটা তারারা আকাশে ছড়িয়ে থাকে
তারারা মিলে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে
এবং তার মাঝে আমরা নাচতে থাকি।”
রুমি তাবরিজিকে হারিয়ে এক অন্য রুমি হয়ে ওঠেন। জীবনের গভীর ভাবনা ভাবতে ভাবতে তার দিন কাটতে থাকে, জীবনে আর গুরুত্বপূর্ণ কেউ না আসলেও বন্ধু আসে আবারও, যার নাম ছিল সালাউদ্দিন জাকুব। পেশায় তিনি একজন স্বর্ণকার ছিলেন। রুমি অবশ্য এই বন্ধুকেও হারান। সফল আধ্যাত্মিক সুফি সাধকেরা হৃদয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করেন। জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, নবী মোহাম্মদ (স.) এর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে আল্লাহকে খোঁজো। সুতরাং তাঁর কাছে প্রার্থনা করো, ‘প্রভু আমাদের প্রকৃত রূপ দেখাও/যাতে আমরা বিভ্রান্ত না হই এবং ভুল না করি।’/এই বিবেচনায় স্থির হও, যা কিছু ভালো আর পরিষ্কার তা মুহাম্মদের চেয়ে/ ভালো আর কে বলতে পারে, কারণ তিনি তা–ই করেন, যা তিনি বলেন/নিজের চিন্তা আর বিবেচনা দ্বারা তাড়িত হয়ো না/বরং আল্লাহর কাছে নতজানু হও এবং তার বিবেচনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও। (ফিহি মা ফিহি বক্তৃতামালা–১)
সুফিজমকে কেউ কেউ গান–বাজনার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। শুধু আধ্যাত্মিক ভাবধারায় গান–বাজনা করলেই হবে না, এটিকে খোদা ভজনের সাধনায় নিয়ে যেতে হবে, তবেই সুফিবাদের চর্চা বলে বিবেচিত হবে। যেমন রুমি বলেছেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে আমার একটি মুহূর্ত আছে, যেখানে কোনো বার্তাবাহক নবী/ বা খোদার নিকটবর্তী পবিত্র ফেরেশতাদেরও প্রবেশাধিকার নেই।/ জেনে নাও, সেটাই হলো প্রার্থনার আত্মা/এবং সেই মুহূর্তটি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের এবং অচেতন হয়ে পড়ার।’
আল্লামা রুমি মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রদর্শিত পথে হাঁটতে বলেছেন, কিন্তু ধর্মান্ধ হতে নিষেধ করেছেন। তিনি আত্মাকে, চিন্তাকে সর্বদা মুক্ত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ‘আবরণ মুক্ত করো/মানুষের মন একটি ঘরের মতো/সব দরজা এবং জানালার কপাট নির্দ্বিধ খুলে দাও/চিন্তাকে রেখো না বেঁধে সোনার শেকলে/ মুক্তচিন্তা হচ্ছে সেই প্রচেষ্টা যা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ খোদার প্রতি/তাঁর অগণন উপহারের জন্য/মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে অবস্থান আল্লাহর মহানুভবতার প্রতি নির্মম অবজ্ঞা।’ তিনি জাগতিক লোভ–মোহ থেকে মুক্ত হতেও পরামর্শ দিয়েছেন।