একটি নতুন প্রতিষ্ঠানকে বিশাল অংকের ঋণ দেওয়া হল। তাও আবার কোনো প্রকার জামানত ছাড়াই। মূলত বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই উক্ত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ প্রস্তাব, ঋণ বিতরণে আবশ্যকীয় নিয়ম কিংবা বিধি কোনোটাই প্রতিপালন করা হয়নি। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, শুধুমাত্র ঋণের জন্যই উক্ত নতুন প্রতিষ্ঠানটিকে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, ব্যাংকারদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৪৮ কোটি ৯৭ লাখ ৯ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হেফাজতুর রহমান। একইভাবে চট্টগ্রামের ইলিয়াছ ব্রাদার্সের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আবছার আত্মসাৎ করে নিয়েছেন ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রায় ৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের এ ঘটনা উঠে এসেছে দুদকের অনুসন্ধানেই। এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম–১ এ পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম–২ এর উপপরিচালক মো. আতিকুল আলম।
একটি মামলায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক পটিয়া শাখার সাবেক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইলিয়াছ বাঙ্গালী, ষোলশহর শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত) এস কে এস মুরশেদ, একই শাখার সাবেক কর্মকর্তা (প্রিমিয়ার ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের বর্তমান সিনিয়র এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট) মো. নাছির উদ্দিন, সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমানে উপমহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত) এ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া খান এবং মেসার্স মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হেফাজতুর রহমান ও বোয়ালখালীর মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনালের মালিক মাহবুবুল আলম চৌধুরীকে আসামি করা হয়েছে। অপর মামলায় আসামি করা হয়েছে– বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক পটিয়া শাখার সাবেক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইলিয়াছ বাঙ্গালী, ষোলশহর শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত) এস কে এস মুরশেদ, একই শাখার সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমানে উপমহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত) এ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া খান, সাবেক মুখ্য কর্মকর্তা (বর্তমানে ঊর্ধ্বতন মূখ্য কর্মকর্তা) মোহাম্মদ হাশেম ও ইলিয়াছ ব্রাদার্সের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আবছারকে।
দুদক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক পটিয়া শাখার সাবেক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইলিয়াছ বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৩৬৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচারে সহায়তা করার অভিযোগটি অনুসন্ধান করতে গিয়েই বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অর্ধকোটি টাকারও বেশি টাকা আত্মসাতের এ ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। কোনোরকম নিয়ম নীতি না মেনে ঋণ বিতরণের এ ঘটনায় ব্যাংকারদের অবহেলা ও গাফিলতির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও দুদক জানিয়েছে।
ব্যবসায়ী অর্থাৎ মেসার্স মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হেফাজতুর রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ইলিয়াছ বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৩৬৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচারে সহায়তা করার একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেসার্স রহমান ট্রেডিং এর মালিক হেফাজতুর রহমান মূলত মেসার্স মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক হিসেবে পরিচিত। মেসার্স মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর আওতাধীন মেসার্স রহমান ট্রেডিং তৎকালীন সময়ে নতুন প্রতিষ্ঠান ছিল। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ষোলশহর শাখা ঋণ প্রস্তাব প্রেরণ করেন মেসার্স রহমান ট্রেডিং এর অনুকূলে, মেসার্স মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর নামে নয়। শাখা কর্তৃক ঋণ প্রস্তাবপত্রে মেসার্স মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক হিসেবে হেফাজতুর রহমানের ব্যবসায়িক দক্ষতা, সুনাম ইত্যাদি প্রশংসা করা হয়। কিন্তু মেসার্স রহমান ট্রেডিং যে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান এবং উক্ত নতুন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এলটিআর এর মত জামানতবিহীন (স্থাবর সম্পত্তির জামানত) ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিষয়ে কোনো পর্যালোচনা করা হয়নি। মেসার্স রহমান ট্রেডিং এর অনুকূলে প্রদত্ত ঋণটি হল এলটিআর বা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ঋণ। উক্ত ঋণ প্রস্তাব, ঋণ অনুমোদন ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিপূর্ণ মর্টগেজ গ্রহণ (স্থাবর সম্পত্তির মর্টগেজ) ব্যতীত ঋণ প্রদান করা হয়েছে। অনুসন্ধানকালে উক্ত এলটিআর ঋণ প্রস্তাব ও ঋণ বিতরণে আবশ্যকীয় নিয়ম/বিধি প্রতিপালন না করা, সম্পূর্ণ নতুন প্রতিষ্ঠান এর জন্য এলটিআর ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করা, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ কিনা সেটা বিশ্লেষণ ব্যতীত পর্যাপ্ত মর্টগেজ সম্পত্তি ছাড়া ঋণের প্রস্তাব করা, শুধু এলটিআর ঋণের জন্য একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি (ট্রেড লাইসেন্স অনুযায়ী) করা ইত্যাদিসহ সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যাংকারদের অবহেলা ও গাফিলতির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ইলিয়াছ ব্রাদার্সের চেয়ারম্যান ও চার ব্যাংকারের বিরুদ্ধে দায়ের করা অপর মামলার এজাহারে বলা হয়, ইলিয়াছ ব্রাদার্সের মোহাম্মদ নুরুল আবছারের বাকলিয়ার মেসার্স এস এ কর্পোরেশন নামের প্রতিষ্ঠানটি হেফাজতুর রহমানের প্রতিষ্ঠান মেসার্স রহমান ট্রেডিংয়ের মতোই। মূলত ঋণের জন্যই এ প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে। কোনোরকম নিয়ম নীতি না মেনে মেসার্স এস এ কর্পোরেশনকেও ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে ব্যাংকের অবহেলা ও গাফিলতির বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। পৃথক দুটি মামলার এজাহারে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ী হেফাজতুর রহমান ও মোহাম্মদ নুরুল আবছার ব্যাংকারদের সাথে যোগসাজশে নিজে লাভবান হওয়ার জন্য এবং অন্যকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।