জান আলীকে নিয়ে মকবুলের কবিতা : তক দে মিয়া বকশিস দিবা আসলত্তুন হানি

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২৯ জুলাই, ২০২৫ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পথিকৃৎ শিল্পপতি এ কে খানের পিতামহ জান আলী খান চৌধুরী ১৮ ও ১৯ একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার ও সমাজপতি ছিলেন। আঠার শতকে তাঁর জন্ম, উনিশ শতকেও তিনি বর্তমান ছিলেন। বরং তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় উনিশ শতকেই অতিবাহিত হয়েছিলো।

জান আলী খান চৌধুরী বংশের আদি পুরুষ মরহামৎ খান, তিনি একজন পাঠান বংশীয় বীর পুরুষ, সর্বশেষ গৌড়ে যাঁর অবস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। মরহামৎ খানের পুত্র শমসের খান গৌড়ের বাদশাহ’র মন্ত্রী ছিলেন। ১৫৭৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট আকবর ও বসন্ত মহামারির যুগপৎ আক্রমণে গৌড় বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। রাজপুরুষ থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত তখন যে যেদিকে পারে উর্ধশ্বাসে পালিয়ে যাচ্ছিলো। শমসের খানও এ সময় গৌড়ের মায়া ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে চট্টগ্রাম অভিমুখে ধাবিত হন। তিনি তৎকালিন বন্দর শহর চট্টগ্রামের বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় জনপদ হালিশহরে উপনীত হন এবং সেখানে একটি হাবেলী (কুটির) নির্মাণ করে তাঁর ডেরা পাতেন। শমসের খানের নির্মিত হাবেলী থেকে আধুনিক ‘হালিশহর’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে গবেষকদের অনুমান।

শমসের খানের পাঁচজন পুত্র ছিলো যথাক্রমে হামজা খান, তেগবাজ খান, শেরবাজ খান, নসরত খান ও আলী খান। পাঁচ পুত্র পরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে উপযুক্ত স্থান বাছাই করে ভদ্রাসন নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকেন। জ্যেষ্ঠপুত্র হামজা খান পাঁচলাইশ এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর নামে বিবির হাট এলাকা হামজারবাগ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এখানে তিনি মসজিদ, দীঘি ও উদ্যানবাটি নির্মাণ করেন।

শমসের খানের তৃতীয় পুত্র শেরবাজ খানেরই উত্তর পুরুষ হলেন জান আলী খান চৌধুরী। শেরবাজ খানের পুত্র শাহবাজ খান। তাঁর পুত্র আলী খান মোহরায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। আলী খানের পুত্র মনোহর আলী খান, তাঁর পুত্র জান আলী খান চৌধুরী।

জান আলী খান চৌধুরীর পিতা মনুহর খান, পুত্র আবদুল লতিফ খান (এএল খান), তাঁর পুত্র এ কে খান এবং এ কে খানের চার পুত্রএ এম জহির উদ্দিন খান, এ কে শামসুদ্দিন খান, সালাউদ্দিন কাশেম খান, সদরুদ্দিন খান ও এ এম জিয়াউদ্দিন খান।

সপ্তদশ শতাব্দিতে চট্টগ্রাম আরাকানের মগ রাজার দখলে ছিলো। দিল্লির সিংহাসনের উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে শাহজাদা সুজা আরাকান রাজের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁর অবস্থান সুখকর হয়নি। আরাকান রাজ তাঁকে হত্যা করেন। এই মর্মাান্তিক ঘটনার সংবাদ দিল্লিতে পৌঁছার পর সম্রাট আওরঙ্গজেব শোকাহত হন। তিনি আরাকান রাজের কবল থেকে চট্টগ্রাম উদ্ধার করার জন্য তাঁর মাতুল ও বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম অভিযান পরিচালনা করার জন্য নির্দেশ দেন। শায়েস্তা খান তাঁর পুত্র বুজর্গ উমেদ খানকে চট্টগ্রাম আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে বলেন। বুজর্গ উমেদ খান বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন এবং ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জয় করে পর্তুগীজ হার্মাদদের আস্তানা ধ্বংস ও মুসলমানদের উপর আরাকানিদের অত্যাচার বন্ধ করেন। বুজর্গ উমেদ খানের সঙ্গে এডমিরাল ইবনে হোসেনের নওয়ারা বাহিনীও (নৌবাহিনী) যোগ দিয়েছিলো। এসময় কর্ণফুলীতে বিরাট যুদ্ধ হয় এবং ঐ যুদ্ধে জমিদার মুনাওয়ার খান বিশেষ বীরত্বের পরিচয় দেন। মুনাওয়ার খান জান আলী খান চৌধুরীর পুর্বপুরুষ। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর শায়েস্তা খান চট্টগ্রামে মুসলমানদের প্রাচীন স্মৃতি মনে রেখে চট্টগ্রামের নাম পাল্টে নতুন নাম রাখেন ‘ইসলামাবাদ’। পাকিস্তান আমলে করাচীর পরিবর্তে ইসলামাবাদে নতুন রাজধানী নির্মিত হলে তার নাম ইসলামাবাদ রাখার প্রস্তাব উঠলে এ কে খান আপত্তি করেন। তিনি তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তিনি পাকিস্তানের নতুন রাজধানী ইসলামাবাদ নামকরণের বিরোধিতা করে বলেন, এটা চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক নাম।

এ ঐতিহাসিক পর্যালোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, জান আলী খান চৌধুরী তৎকালীন চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ বংশের মানুষ ছিলেন। চান্দগাঁও, মোহরা ইত্যাদি ছিলো তখন গণ্ডগ্রাম। এই গ্রামীণ জনপদের একজন অধিপতি, ভূস্বামী ও শাসক ছিলেন। সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিলো তাঁর হাতে। তিনি হাটহাজারী, চট্টগ্রাম শহর, রাউজান এবং রাঙ্গুনিয়ার বিস্তৃত এলাকার জমিদার ছিলেন। তিনি হয়তো রুক্ষ স্বভাবের কঠোর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সে কারণে অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি।

একবার তিনি জমিদারির খাজনা আদায়ের জন্য রাঙ্গুনিয়া গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে নৌকায় করে ফিরে এসে কালুরঘাটে নেমে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রিতে বিলের মধ্য দিয়ে মোহরায় তাঁর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট কিছু প্রজা এ খবর জানত। তারা দল পাকিয়ে জান আলী চৌধুরী বাড়িতে ফিরে আসার পথে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছিলো। তিনি যখন কালুরঘাটে নেমে সদর রাস্তা না ধরে বিলের মাঝ দিয়ে শস্যক্ষেত মাড়িয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে আল পথে যাচ্ছিলেন, রাতের পথঘাট ছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন, তখনই ওঁৎ পেতে থাকা প্রজারা তাঁর ওপর চড়াও হয়ে এলোপাথারি কিল ঘুষি চড় মেরে লাঠি দিয়ে পিঠানো ছাড়াও দা, ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকে। যতক্ষণ না তাঁর মৃত্যু হয় ততক্ষণ এই মারধর অব্যাহত ছিল।

জান আলী চৌধুরী বিখ্যাত লোক, দশ গ্রাম ও শহরের মানুষ তাঁকে চেনেন। সুতরাং তিনি অপঘাতে নিহত হয়েছেন এই সংবাদ চারদিকে বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়ে। জান আলী চৌধুরীর মৃত্যু নানা রকম জল্পনাকল্পনা, মুখরোচক আলোচনাসমালোচনার জন্ম দেয়।

জান আলী চৌধুরী নিহত হন ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩০৩১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামকক্সবাজার সড়ক ও কালুরঘাট সেতু নির্মাণের পর তাঁর নামে চট্টগ্রামকক্সবাজার রেল লাইনের মোহরা কাজীর হাট এলাকায় একটি স্টেশন স্থাপিত হয়, একই নামে একটি বাজারও আছে সেখানে। জান আলী চৌধুরীর পুত্র আবদুল লতিফ খান চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার ছিলেন। আর তাঁর পৌত্র অর্থাৎ আবদুল লতিফ খানের পুত্র গোটা বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। পাকিস্তান আমলেও তিনি সে দেশের পার্লামেন্ট মেম্বার ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। জান আলী চৌধুরীর প্রপৌত্র অর্থাৎ এ কে খানের পুত্র জহিরুদ্দিন খান বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী এবং পার্লামেন্ট মেম্বার ছাড়াও চিটাগাং চেম্বার ও এফবিসিসিআই’র সভাপতি ছিলেন।

জান আলী চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডের পর নোয়াপাড়ার কবিয়াল মকবুল মতান্তরে বাকলিয়ার মকবুল, যিনি কানা মকবুল নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। সেটি তখন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এবং হাট বাজারে তা পাঠ করা হতো, মানুষ ঘিরে ধরে কবিতা পাঠ শুনে আমোদ পেত। গ্রাম্য হাটবাজারে হাটের দিন হাটের মুখে বা মাঝখানে কোনো সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়ে গ্রাম্য কবিরা তাদের কবিতা পাঠ করতেন। মকবুলও তাই। জান আলী চৌধুরীর হত্যার খবর শুনে তিনি যে রসাত্মক কবিতা লিখেছিলেন, বটতলায় ছাপানো তাঁর সেই কবিতা নিয়ে চট্টগ্রামে শোরগোল পড়ে গিয়েছিলো। জান আলীর কবিতা শোনার জন্য হাটে মাঠে ঘাটে মানুষের জটলা সৃষ্টি হতো। জান আলীর প্রপৌত্র জহিরউদ্দিন খান (একে খানের পুত্র, শিল্পপতি, সাবেক মন্ত্রী ও এমপি) শিল্প চর্চা করতেন। সাহিত্যিক ও সঙ্গীত শিল্পী সুচরিত চৌধুরী তাঁর ভ্রাতৃসম বন্ধু ছিলেন। তিনি বড় হয়ে জান আলী চৌধুরীর ঘটনাটি সম্পর্কে জ্ঞাত হন এবং সে ঘটনা নিয়ে মকবুলের কবিতা লেখার কবিতাও জানতে পারেন। তিনি কবিতাটি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কিন্তু ততদিনে মকবুলও নেই। তাঁর কবিতাও উধাও। সুচরিত চৌধুরীকে নিয়ে জহিউদ্দিন খান কবিতাটি জোগাড় করার জন্য চারিদিকে লোক লাগিয়ে দেন। কিন্তু হায় ! ৬০/৭০ বছর গত হয়ে গেছে, জান আলী চৌধুরীর কবিতার খোঁজ কেউ রাখেন না। তিনি অনেক টাকাপয়সাও দিতে চেয়েছিলেন। কারো কাছে পাওয়া যায়নি। বটতলার পুঁথিপাঠ বা হাটুরে কবিতার যুগও ততদিনে বাসি হয়ে গেছে।

বদন মিয়া দীদারি নামে আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট নেতাকে আমি চিনতাম, তিনি চট্টগ্রামের পুরোনো ইতিহাসের অনেক চিজ তাঁর ভাণ্ডারে জমা ছিলো। পুরোনো ইতিহাসের প্রতি আমার আবাল্যপ্রেম, সেই প্রেমের বশে আমি বদন দীদারির কাছ থেকে আমি চট্টগ্রামের পঞ্চাশ ষাট দশকের অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি, যা’ ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বদন দীদারি কবিতা পাঠ করতে পারতেন, গান গাইতে পারতেন, লিখতেও পারতেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম থেকে তাঁর ইতিহাসখ্যাত ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করার পর বদন দীদারি ৬ দফার ওপর গান লেখা শুরু করেন।

বদন দীদারির বাড়ি আতুরার ডিপোর মৃধাপাড়া, কাঁহারপাড়ার কাছাকাছি। যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষ হয়েছিলো। আমি বদন দীদারি সাহেবকে নিয়ে কাঁহারপাড়া গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে উক্ত ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি।

যাই হোক, কথায় কথায় একদিন বদন দীদারি আমাকে জান আলী চৌধুরীকে নিয়ে মকবুলের লেখা কবিতা সম্পর্কে বলেন। আমি উৎসাহিত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করি কবিতাটি কারো কাছে আছে কিনা। তিনি বলেন, এতদিনে সেটি কারো কাছে থাকার কথা নয়। তবে কবিতাটি আমি পড়েছি, কিছু অংশ আমার মুখস্থ আছে। আশ্চর্য স্মরণশক্তি তাঁর। তিনি মুখে মুখে কবিতার অনেকটুকুুই বলে যান। আমি তাঁর অনুমতি নিয়ে লিখে নিই। চারণ কবি বদন মিয়া দীদারির স্মৃতি থেকে উদ্ধারকৃত জান আলী চৌধুরীকে নিয়ে লেখা মকবুলের কবিতার কিয়দংশ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে তুলে ধরলাম।

বাড়িত আছিল বাগ বাগিচা / গোলায় ছিল ধান / মনু মিয়ার প্রধান বেটা / জান আলী মিয়া নাম। সুন্দর বাড়ি ইন্দ্রপুরী

দেখতে চমৎকার / ১২ জন দারোয়ান ছিল ঘাটের মাজার। একদিন চৌধুরী সাব ভাবিতে লাগিল / রাঙ্গুনিয়ার কথা কিছু মনেতে উঠিল / সঙ্গে চাকর আছদ আলী / তারে নিল ডাকি / শাল দোচালা চাকরের কাঁধেতে দিল / হাঁটিতে হাঁটিতে তারা কালুরঘাটে গেল / উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম নিরখিয়া চায় / হাতের ইশারায় মিয়া মাঝিরে ডাকিল / মাঝির নৌকা কোথায় যাবে জিজ্ঞাসা করিল/ মাঝিয়ে উঠিয়া কয় আমি যাব রাঙ্গুইন্যা শহর / তিন আনা দর করিয়ে তিন জন হল সওয়ার / ভাসিতে ভাসিতে নৌকা রাঙ্গুনিয়া পৌঁছিল / তাহার পর চৌধুরী সাব কুলেতে উঠিল/ তিন আনার দর করিয়া এক আনা পয়সা দিল / মাঝি উঠিয়ে বলে আমি ভাল চিনি / তক দে মিয়া বখশিস দিবা আসলত্তুন হানি।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছার এখনই মোক্ষম সময়
পরবর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ১