জাতীয় খেলা ‘কাবাডি’ : পুস্তকে আছে, বাস্তবে নেই!

মোহাম্মদ আইয়ুব | মঙ্গলবার , ২৩ মার্চ, ২০২১ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের এ প্রজন্মের শিশুরা সাধারণ জ্ঞানের বইয়ের বদৌলতে জানতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা ‘ফুটবল বা ক্রিকেট’ নয়! ‘হাডুডু বা ‘কাবাডি’ নামক খেলাটিই আমাদের আদি ও জাতীয় খেলা। কাবাডি খেলার সাথে প্রথম পরিচয় হয় পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে, তারপর খেলাটি সম্পর্কে অভিভাবকদের কাছে আমাদের প্রজন্ম জানতে চায়। কাবাডি খেলা কি? এটা কিভাবে খেলে? যে অভিভাবক গ্রামে শৈশব কাটিয়েছেন তারাই এর সঠিক তথ্য দিতে পারেন, আর যারা শহরে বড় হয়েছেন তারা সহজভাবে উত্তর দেন এটা গ্রামের চাষাভূষাদের খেলা, এসব খেলা আমরা খেলিনি। আবার অনেকেই উৎসাহের সহিত শিশুদের শোনান শৈশবের গৌরবগাথা আদি এই খেলার ইতিহাস এবং তা স্মৃতিচারণ করেন সগৌরবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা এখন ‘ক্রিকেট ও ফুটবল’। যে খেলার উৎপত্তি ও আগমন পশ্চিমা দেশ হতে। আবহমান কাল থেকে এই ভূখন্ডের অধিবাসী কাবাডি বা হাডুডু খেলে আসছে। সেই সুবাদে এই খেলাটি বাংলাদেশের জাতীয় খেলার মর্যাদা পায়। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নের ধাক্কায় গ্রাম বাংলার এই খেলাটি বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলছে। ভিনদেশের হাত ধরে এদেশে আগমন ঘটে ক্রিকেট ও ফুটবল। এসব খেলার প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ বা বিরোধ নেই কিন্তু যে খেলা আমাদের সংস্কৃতির সাথে জড়িত, যে খেলা বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে জড়িত তাকে উপেক্ষা করে ভিনদেশী খেলাকে বেশি মূল্যায়ন করতে আমি ব্যক্তিগত ভাবে নারাজ।
ভিনদেশী খেলাগুলো বাংলাদেশে বেশী জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ! গণমাধ্যমগুলো যদি ভিনদেশী খেলাগুলোর চাইতে কাবাডি বা দেশীয় খেলা বেশি প্রচার প্রচারণা করতো, তা হলে আমার মনে হয় কাবাডি’র এমন বেহাল দশা আজ আমাদের দেখতে হতো না। কাবাডি আজ পাঠ্যপুস্তক, একাডেমি, সরকারি কিছু নথি-স্থাপনা ও সংগঠন- প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ। দায়সারা ভাবে কোনমতে টেনেটুনে চলছে বাংলার মাটি ও সাংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত জাতীয় খেলা ‘কাবাডি’।
বাংলাদেশে কাবাডি যেমন জাতীয় খেলা, তেমনি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেরও জাতীয় খেলা কাবাডি। ভারত অন্যান্য খেলার সাথে কাবাডিকে সমানতালে ধরে রেখেছে। আমাদের দেশ পিছিয়ে থাকলেও পিছিয়ে নেই ভারত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ভালো অবস্থানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। যাই হোক পিছিয়ে আছি তাতে তেমন দুঃখ নেই। কষ্ট পাই তখন, যখন শুনি মহান সংসদে দাঁড়িয়ে একজন সাবেক মন্ত্রী বলেন বাংলাদেশের জাতীয় খেলা ফুটবল। যদিও সেদিন তিনি ভুল স্বীকার করেছেন।
কাবাডি আমাদের মাটির খেলা, প্রাণের খেলা, আমাদের আবেগ, আমাদের ঐতিহ্য। আমরা বিদেশের মাটিতে কাবাডিকে নিজেদের জাতীয় খেলা বলে সগৌরবে বলি। কিন্তু কাবাডি খেলা এই জনপদে কতটুকু ছড়িয়ে দিতে পেরেছি? মাঠে-ময়দানে কাবাডির গুরুত্ব কতটুকু উপস্থাপন করতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ? আন্তর্জাতিক অঙ্গে কতটুকু প্রমাণ করতে পেরেছে এটি আমাদের জাতীয় খেলা?
সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডিকে হাসি তামাশার মঞ্চে দাঁড় করেছে ক্রীড়া কর্তৃপক্ষ। বিশ্ব মঞ্চে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা এখনো প্রমাণ করতে পারিনি কাবাডি আমাদের জাতীয় খেলা। সারাবিশ্ব দেখতে পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ যে খেলাকে তাদের জাতীয় খেলা বলে, সে খেলা তারা ভালভাবে খেলতে জানেনা! তাদের মধ্যে অনেকে এই খেলাটি সম্পর্কে ভালভাবে জানেওনা! কথায় নয় খেলার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে কাবাডি আমাদের জাতীয় খেলা, কাবাডি আমাদের পূর্বপুরুষের বিনোদনের অংশ। যদিও কাবাডি খেলার পেছনে যথেষ্ট পরিমাণ পৃষ্ঠপোষকতায় অনীহা আছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। সিংহভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয় ভিনদেশী খেলাগুলোতে, যে খেলার সাথে আপামর বাঙালির হৃদয়ের কোন সম্পৃক্ততা নেই। বর্তমানে গণমাধ্যমগুলোর অতিমাত্রায় প্রচার প্রচারণার ফলে ভিনদেশী খেলাগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর সাথে বিজ্ঞাপন দাতাদেরও দেশ প্রেমের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করি।
দাপ্তরিক কাগজে বা লোকদেখানোর খাতিরে একাডেমিতে বন্দী রাখলে আগামী প্রজন্ম হারাবে ঐতিহ্যবাহী কাবাডি। লাইফ সাপোর্টে কাবাডি, একতরফা পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রচার প্রচারণা ছাড়া কাবাডিকে মাঠে ফিরিয়ে পাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই কাবাডিকে বাঁচাতে সময় থাকতেই ভাবতে হবে।
লেখক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালি সংস্কৃতিতে নারীর মাথায় কাপড়
পরবর্তী নিবন্ধগৌরবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও সুবর্ণজয়ন্তী