বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক শিশু বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) সূত্র মতে,সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ। প্রতিবছরই এ সংখ্যা বাড়ছে।
প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যার অভাব, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ ব্যাপক অপুষ্টিসহ বিভিন্ন রোগের শিকার। এতে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার যেমন কমে যায়, তেমনি ব্যাহত হয় তাদের মেধা ও মননের বিকাশ । যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব প্রতিফলিত হয়ে জাতীয় জীবনে।
শিশুবান্ধব বিদ্যালয়–
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশ বহাল রাখা বর্তমানে এক মুখ্য আলোচ্য বিষয়। নানা সমস্যার বেড়াজালে চলে বিদ্যালয়গুলো। তবুয়ো ‘শিশু বান্ধব বিদ্যালয়’ সনদ পেতে ন্যুনতম কতিপয় সুপরিবেশ বজায় রাখা চাই–
পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রেণী কক্ষ ও খেলার মাঠ: বিদ্যালয় ভবনের অবস্থান যেন নিরাপদ প্রাচীর বা ঘের সহ নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশের হয়। দরোজা–জানলার সংখ্যা যেন মেঝের অন্তত সিকি ভাগ থাকে। পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো প্রবেশ করে, এমন ব্যবস্থা থাকা। নার্সারি ও প্রাইমারি স্কুল একতলা বিল্ডিংয়ের হবে। সব স্কুল বিল্ডিং–এ বারান্দা থাকবে।
হাইস্কুলের জন্য কমপক্ষে ১০ একর এবং প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য কম করে হলেও ৫ একর পরিমাণের খেলার মাঠ থাকা। এক শ্রেণীকক্ষে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠ দান। শ্রেণীকক্ষ যেন ৪০০ স্কয়ার ফিট বা ১০ স্কয়ার ফিট/ প্রতি পড়ুয়া হিসেবে করা হয়। ফার্নিচার–এ যেন ব্যাক রেস্ট ও ডেস্ক ওয়ার্ক করার সুবিধা থাকে।
ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা ইউরিনাল ও শৌচাগার। প্রতি ৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি ইউরিনাল ও প্রতি ১০০ জনের জন্য একটি শৌচাগার।
খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সময় বরাদ্দ। দৈহিক শাস্তিকে ‘না’ বলা। পিঠে ভারী ব্যাগ আর না। এতে তৈরি হয় ‘স্কুল ব্যাগ সিনড্রোম’। পিঠে, ঘাড়ে ব্যথা এসব। বিদ্যালয়গামী শিশুর স্কুল ব্যাগের ওজন কোন মতেই যেন তার নিজ ওজনের দশ শতাংশের বেশি না হয়। ৫–৬ ক্লাশ পর্যন্ত স্কুলে বই রাখার বন্দোবস্ত করা । বিদ্যালয়ে নিরাপদে আসা যাওয়ার ব্যবস্থা। দু বা তিন চাকার গাড়ি ব্যবহার না করা। যানে বেশি ঠাসাঠাসি করে শিক্ষার্থী বহন না করা।
নিরাপদ খেলাধুলার মাঠ :
মাঠের উপরিভাগ যেন কংক্রিট জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরী করা না হয়। বা এতে যেন জমানো জল না থাকে। ভাঙ্গা কাঁচ, মোড়ানো কোনো বস্তু, কাঠের সূঁচালো অংশ মাঠে পড়ে থাকলে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। খেলার মাঠের চারপাশের ঘেরা যেন সুরক্ষিত থাকে, যাতে শিশু দৌড়ে সীমানা পেরিয়ে গাড়ি চলাচলের রাস্তায় গিয়ে না পড়ে ।
খেলার মাঠে নিরাপদে থাকার বিষয়ে শিশুকে শিক্ষাদান: খেলাধুলার সময়ে হঠাৎ করে কাউকে ধাক্কা না দেয়া। ভেজা খেলনা নিয়ে না খেলা। অত্যধিক গরম যেমন মেটাল জাতীয় খেলনা ব্যবহার না করা। সানস্ক্রিন এর ব্যবহার। জাম্প দেওয়ার পূর্বে যেন কাছে থাকা অন্য কোন শিশুর সাথে ধাক্কা না লাগে, তা বিবেচনায় নেওয়া। গাছে আরোহন জনিত সুরক্ষা– প্রিস্কুল বয়সের শিশু যেন ৫ ফিটের অধিক উচ্চতায় আরোহণ না করে। স্কুলবয়সী বাচ্চা ৭ ফিটের বেশি উঁচুতে যেন না উঠে। খেলাধুলার স্থানে কুকুর বা অন্যান্য পশু–প্রাণী না থাকা।
বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসেবা–
মেডিকেল চেকআপ; ছোটখাটো রোগের চিকিৎসা; পুষ্টিজনিত ব্যাধি শনাক্তকরণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ। ডেন্টাল পরীক্ষা: ডেন্টাল চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক দন্ত–চিকিৎসা। দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা: স্ট্রাবিসমাসের প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা। শ্রবণশক্তি মূল্যায়ন: কান, নাক এবং গলা পরীক্ষা এবং শ্রবণ–ত্রুটির জন্য স্ক্রিনিং পরীক্ষা। শিশুদের আপ–টু–ডেট টিকাদান নিশ্চিত করা; ঘাটতি হলে ‘ক্যাচ আপ টিকা’ প্রদান করা।
প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য: মনোবিজ্ঞানী, ফিজিওথেরাপিস্ট এবং থেরাপিস্টের সাথে পরামর্শ করে তাদের বিশেষ যত্ন সম্পর্কিত সুপারিশ। কিশোর–কিশোরীদের সাধারণ সমস্যার প্রতি মনোযোগ: সিগারেট এবং ড্রাগস্ ব্যবহারের ঝুঁকি, হতাশা স্ক্রিনিং এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সঠিক ব্যবহার।
খেলাধুলা, খেলার মাঠ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে শিশুদের চিকিৎসা ও তত্ত্বাবধান। শিক্ষক, সাপোর্ট স্টাফ–সহ সমস্ত স্কুল কর্মীদের স্বাস্থ্যের তত্ত্বাবধান। যক্ষ্মা, চর্মরোগ ও ডায়রিয়াজনিত রোগ শনাক্তকরণে বিশেষ গুরুত্বদান।
স্কুল–শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ সহ স্কুলে খারাপ পারফরম্যান্স করছে এমন শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। নিকটবর্তী, স্বাস্থ্য–কেন্দ্র বা হাসপাতালে ছোটখাট অসুস্থতা, ত্রুটি এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ফলো–আপ সুবিধা।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্য–শিক্ষা: স্কুল শিক্ষকদের, শিক্ষার্থীদের জন্য ‘স্বাস্থ্য–রেকর্ড’ স্থাপনে সহায়তা করা। সিনিয়র শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সিপিআর এবং প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ প্রভৃতি।
স্কুল ক্লিনিক–
বিদ্যালয়ে শিশু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লে, বমি, ডায়রিয়া, খিঁচুনি বা দুর্ঘটনার শিকার হলে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ ও ওষুধের ব্যবস্থা থাকা।
বর্তমানে বিদ্যালয়ে ভর্তিকালীন সময়ে সকল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর বিধান রয়েছে। এরমধ্যে কিছু সংখ্যক শিশুকে নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য চেকআপ এর আওতায় আনতে হয়। বিশেষতঃ ‘বিশেষ সাহায্য–সহযোগিতা সম্পন্ন’ শিশুদের জন্য স্কুল ক্লিনিকের প্রয়োজনীয়তা অনেক। কখনোবা স্কুল চিকিৎসক এসব শিশুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফারও করতে পারেন।
স্কুল নার্স: অনেক স্কুলে নিয়মিতভাবে সিনিয়র অভিজ্ঞ স্কুল–নার্স ও স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্ট–টাইম বেসিসেও স্কুল–নার্স নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। রেজিস্টার্ড মেডিকেল প্র্যাকটিশনার, বা সম্ভব হলে কোনো শিশু–চিকিৎসককে স্কুলের ‘স্বাস্থ্য কর্মকর্তা’ পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া পার্টটাইম সার্ভিসের আওতায় অন্যান্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিকিৎসকদের যেমন– নাক–কান–গলা ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ, স্পিচ–থেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট এর সহযোগিতা নেওয়া যায়।
স্বাস্থ্য শিক্ষাঃ স্কুল ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক–শিক্ষিকাদের অংশগ্রহণে প্রতি মাসে একবার বিদ্যালয়ে স্বাস্থ–শিক্ষামূলক অধিবেশনের আয়োজন। শিক্ষার্থীদের পুষ্টি সচেতনতা বাড়াতে, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধমূলক বিশেষ স্বাস্থ্য কর্মসূচি। অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধে গৃহীত কৌশলের বাস্তবায়ন। শিশুকে পরিচালনার জন্য মনোসামাজিক শিক্ষা বা শিশু সাইকোলজির প্রয়োগ– বিশেষত আচরণজনিত সমস্যার শিকার শিশুর ক্ষেত্রে।
স্বাস্থ্য ডায়েরিঃ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি ‘স্বাস্থ্য ডায়েরি’ থাকা উচিত। ডায়েরিতে শিশুর নাম, জন্মতারিখ, মা ও বাবার নাম–ঠিকানা, ফোন নম্বরসমূহ লিপিবদ্ধ রাখা। প্রতি বছর শিশুর ওজন, উচ্চতা নির্ণয় করে ডায়েরিতে লিখে রাখা। শিশু যেসব টিকা পেয়েছে, তার উল্লেখ থাকা।
স্বাস্থ্য ক্যাম্পের আয়োজন: বছরে অন্তত একবার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগ, দন্ত, চক্ষু, নাক–কান–গলা প্রভৃতি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে ‘স্বাস্থ্য–ক্যাম্পে’র আয়োজন। গঠিত স্বাস্থ্য–ক্যাম্পে বিশেষ স্বাস্থ্য–কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। স্কুল চিকিৎসক ও নার্স এর তালিকা অনুযায়ী ‘বিশেষ সাহায্য–সহযোগীতার’ শিশু শনাক্তকরণ ও রেফার করা।
স্বাস্থ্যকর স্কুল ব্যবস্থাপনা
স্কুল প্রাঙ্গণের স্যানিটারি অবস্থা এবং বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুবিধা রক্ষণাবেক্ষণ। পরিচ্ছন্ন টিফিন রুম।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সাধারণ রোগব্যাধি ও সমস্যা মোকাবেলায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমপক্ষে একজন শিক্ষক। প্রতি তিন–চার মাস পর নির্ধারিত দিনে শিক্ষার্থীদের একটি করে কৃমির বড়ি খাওয়ানো। প্রয়োজনে ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক এর সাহায্য গ্রহণ।
শিশুর জন্য দৈনিক প্রয়োজনীয় প্রোটিনের অর্ধেক ও দৈনিক ক্যালরির এক–তৃতীয়াংশ ‘লাভ না –ক্ষতি না’ এরকম পদ্ধতিতে স্কুল মিল চালু রেখে শিশুকে যোগানো যায়। যেসব এলাকায় দাঁতের ক্ষয় রোগ, আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা, রাতকানা, আয়োডিনের অভাবজনিত গলগন্ডসহ নানাবিধ অপুষ্টি সমস্যা বিদ্যমান আছে, সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট ধরণের খাদ্যপ্রাণ ও খনিজ ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
দৈহিক, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি, স্কুল রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে ‘বিদ্যালয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’ গুরতের্ব সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
শিশুবয়সে সুস্বাস্থ্য আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে স্কুল–স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে গণ্য করা নিতান্তই জরুরী। স্কুল পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তৈরি হবে দেশের উজ্জ্বল স্বাস্থ্যচিত্র। এ কারণে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে ‘স্কুলস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।