আজ মহান শহীদ দিবস। মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা শহীদরা জাতিকে এক মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন। বাহান্নর সেই রক্তের দামে এসেছিল বাংলার স্বীকৃতি। আর তার সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। তার তিন দশক পরে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। বাঙালির ভাষার সংগ্রামের একুশ হয়ে উঠল বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন।
১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। সেদিন ছাত্র–জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ভাষা বিজ্ঞানীরা বলেন, ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে রাজপথ রক্তভেজা হয়েছিল শহীদদের প্রাণ বিসর্জনে। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার সূচনাপাঠ ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এর ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতিসত্তার নবতর উন্মেষ ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিস্মরণীয় প্রজ্বলনে বাঙালি অর্জন করেছে স্বাধীন–সার্বভৌম বাংলাদেশ। ৩০ লক্ষ শহীদান ও ২ লক্ষ জননী–জায়া–কন্যার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে লাল–সবুজের পতাকা উড্ডীন হয়েছে মূলত ভাষার আন্দোলনের উৎসসূত্রে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এর স্বকীয় বিকাশ ও বিস্তারে বিশ্বে এতবেশি রক্তদানের অধ্যায় একান্তই বিরল। প্রখ্যাত সাংবাদিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটির মর্মস্পর্শী প্রাণস্পন্দনে উচ্চকিত পথযাত্রায় বর্ণিল হয়েছে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের অনবদ্য ইতিহাস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একমাত্র ভাষা নির্ভর নির্ভেজাল এবং যথার্থ জাতীয়তাবাদী চেতনাই পারে গণতন্ত্রকে বিকশিত করে সকল মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। তেমন প্রত্যাশা পূরণ আমাদের ক্ষেত্রে হয় নি। বারবার তা ব্যাহত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের যে সাংস্কৃতিক উন্মেষ ঘটেছিল তাও বারবার পথ হারিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের চেতনার ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার আন্দোলন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। ভাষার দাবিটিই মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত করেছিল। স্বাধীনতার পর সেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলেও রাষ্ট্রভাষার সর্বজনীন প্রচলন ঘটে নি। বরং বৈষম্যের শিকার বাংলা ভাষা সাধারণের ভাষায় পরিণত হয়েছে। অপরদিকে বিত্তবান ও মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে শিক্ষা–দীক্ষা এবং ভাষা–সংস্কৃতিতে বাংলার পরিবর্তে স্থান পেয়েছে হাওলাতি বিদেশি ভাষা। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চরম আকার ধারণ করেছে। সমষ্টিগত উন্নতির বিষয়টিকে কেউ বিবেচনায় আনছে না। এই আত্মকেন্দ্রিকতার অবসান এবং সমষ্টিগত মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়েই সমষ্টিগত মানুষের ভাষা–সংস্কৃতি সর্বজনীন হতে পারবে। অন্য কোন বিকল্প পথে সম্ভব হবে না। মূল ব্যাধিটি বিদ্যমান ব্যবস্থা; সেটির আমূল পরিবর্তন কেবল জরুরি নয়–অপরিহার্যও বটে।
আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, একুশের চেতনার একটি বিশেষ দিক ছিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার। এর অর্থ শিশু–কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী–পুরুষ বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করবে; প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহৃত হবে। উচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার প্রচলন হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের এই আকাঙ্ক্ষা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বাঙালির হাতেই বাংলা ভাষা উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ও অফিস–আদালতে, ব্যবসা–বাণিজ্যে, বিজ্ঞাপনে ইংরেজি ভাষার দখলদারি ক্রমপ্রসারিত হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রমবিস্তার, সাধারণ শিক্ষায় ইংরেজি পাঠ চালু করার ফলে বাংলার গুরুত্ব ক্রমেই কমছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের মানসিকতায় বিদেশিয়ানার প্রভাব বাড়ছে। তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণে বিদেশি ভাষার আশ্রয় নেয়ায়, বিয়ে বা জন্মদিনের আমন্ত্রণপত্রে বিদেশি ভাষার ব্যবহারে, দৈনন্দিন বোলচালে বিদেশি বুলির মিশ্রণে, বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তিফলকে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দেয়ার মধ্যে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।