বাঙালি জাতি সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ একটি জাতি। বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের উন্নত সাহিত্যের গৌরবময় ধারাবাহিকতা। এটি অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার যে, নৃতাত্ত্বিকভাবে সমগোত্রীয় একটি জাতি একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় নিজ ঐতিহ্যের ধারা নিয়ে গৌরবের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল বসবাস করে আসলেও তার নিজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা বিশেষত জাতিরাষ্ট্র গঠনে অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার বছর। কিন্তু এ কারণে বাঙালির চেতনা বিদ্যমান ছিল না একথা বলার সুযোগ নেই।
মূলধারার নানান রাজনৈতিক কালপর্বে সামাজিক জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও বাঙালির জাতিসত্তার বিলোপ কখনই হয়নি বরং বহতা নদীর সজীবতা নিয়ে সে বর্তমানে পৌঁছেছে। বাঙালি জাতির এই সজীব সাংস্কৃতিক চেতনাই তার ‘জাতীয়তাবোধ’–এর শক্ত ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল, যা উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং দুইয়ের সম্মিলনে এক অপ্রতিরোধ্য ও দুর্বার আন্দোলন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং বাংলাদেশের জন্ম হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় চিহ্নিত করণের ইতিহাস। এই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নির্মম ও নৃশংস অত্যাচারের কাহিনি। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালি জীবনে শ্রেষ্ঠতম গৌরবের অধ্যায়। মহাকালের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন যে আলোর মশাল জ্বেলে দিয়েছিলেন, সেই মশাল হাতে পাকদোসরদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিকামী বাঙালি। নিরস্ত্র–নিরীহ বাঙালি কোথায় পেল এত সাহস! স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে সহায়ক মুক্তিযুদ্ধের অনেক গান, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক নির্মিত হয়েছে। যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে শিক্ষক, শিল্পী, কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার, সাংস্কৃতিক কর্মী তথা চিত্রশিল্পীর অবদান অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্দোলনে সাহিত্য–সংস্কৃতির বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত সত্যপ্রকাশে প্রণোদনা জাগিয়েছে। সেদিন বাংলার নিরীহ মানুষদের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অমানবিক শোষণ, অত্যাচার, জোর, জুলুম এবং নানা ব্যভিচারী কর্মকাণ্ডে সবাই বিষিয়ে ওঠে। কিন্তু প্রতিবাদের সাহস ও সামর্থ্য কোনোটাই ছিল না শান্তিপ্রিয় বাঙালির। এমনি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এক হয়েছিল পুরো জাতি। সে সময়ে এদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা সঙ্গীত, কবিতা, নাটক, যাত্রাপালাসহ শিল্পের আলোয়ে সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিকামী বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। দেশমাতৃকার মুক্তি অর্জনে জীবন বিসর্জন দেয়ার নির্ভীক চেতনাকে শাণিত করতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা চিরস্মরণীয়। শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয়– ৫২–এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯–এর গণঅভ্যুত্থানসহ সকল রাষ্ট্রীয় সংকটে সাংস্কৃতিক কর্মীরা সবসময় থেকেছে সোচ্চার। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীরা বিভিন্ন ধরনের দেশাত্মবোধক গান ও রক্তে আগুন ধরা কবিতার ঝাঁঝালো বাণীতে তেজের শিখা ছড়িয়ে দিয়েছিল বাঙালির আবেগের অগ্রপথে। কবিতার মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ ও চেতনা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করত, আর গানে করত প্রাণিত–শানিত। তেমনি নাটকও যুগিয়েছিল অদম্য সাহস। যুদ্ধকালীন এসব নাটক মুক্তির স্বপ্নে বিভোর বাঙালিদের উজ্জীবিত করে। বেশিরভাগ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে যোগ করেছে দেশপ্রেমের একটি স্বাতন্ত্রিক মাত্রা। মঞ্চের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতাকে অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছে বহু পথনাটক। সেসময় অকুতোভয় নাট্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা পথে–প্রান্তরে এমনকি ট্রাকে করে পথে পথে ঘুরে তেজদীপ্ত সংলাপ আর কবিতা–গানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে উজ্জীবিত করে তোলে। সে সময় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জ্বালাময়ী গান ও চরমপত্র পুরো জাতির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বিজয়ের স্বপ্ননেশা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল স্পষ্ট। ফলে ঘটেছে নানাভাবে। চিত্রকলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশের মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশের জন্য প্রচুর কাজ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অডিও–ভিডিও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অমূল্য উপাত্ত। যা পরবর্তী সময়েও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সর্বস্তরের সকল বাঙালির জন্যই অনেক বেশি অহংকারের। কেবল দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল লাখো বাঙালি। পরিবার পরিজন ছেড়ে অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ একটা সংগ্রামী জীবনে পাড়ি দেওয়ার মতো দুঃসাহস এই বীরের জাতির জন্যই হয়তো সম্ভব হয়েছে। দেশ কবে স্বাধীন হবে, আর স্বাধীন হলেও প্রিয়জনের মুখটা আর কখনো দেখা হবে কি না, এমনি অনিশ্চয়তার মধ্যে সবাইকে এক সুরে বেঁধে রেখেছিলো সে সময়কার অনবদ্য দেশাত্মবোধক গানগুলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালির জীবনের অন্যতম একটি চালিকা শক্তি ছিল সেই গানগুলো। দেশ–মাতার জন্য যুদ্ধকে বিশ্বাস করেই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে গেছেন নিঃশঙ্কচিত্তে নির্ভীকভাবে। এই গানগুলো প্রচারে শত বাধাবিপত্তি থাকলেও তাদের একাগ্রতার কারণে গানগুলো ঠিকই পৌঁছে গেছে কোটি–কোটি মুক্তিকামী মানুষের কানে, পৌঁছে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের ভাঙা রেডিওতে। চারপাশে যখন গণহত্যার খবর, তখন বাঙালিদের ভেঙে পড়তে দেয়নি এই গানগুলো, বরং আরো বেশি সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে উজ্জীবিত করেছে বারবার। প্রিয়জন হারানোর খবর পাওয়া হৃদয়ভাঙা যোদ্ধার মনকে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছে এই গানগুলো। বাংলাদেশের যুদ্ধ নাড়া দিয়েছিল সারা পৃথিবীর অসংখ্য শিল্পী হৃদয়কে। যুদ্ধ চলাকালীন ‘ঈড়হপবৎঃ ঋড়ৎ ইধহমষধফবংয’ ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল সারা বিশ্বে। নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে প্রায় ৪০,০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সাবেক বিটল্স সঙ্গীতদলের লিড গিটারবাদক জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় সেতারবাদক রবিশঙ্কর কর্তৃক সংগঠিত দুটি বেনিফিট কনসার্ট বিশ্বকে ভাবিয়ে তোলে। সেদিন বিশ্বেও বিপ্লবী শিল্পীদের মন কেঁদেছিল বাঙালিদের জন্য। তাদের গানগুলো বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের কানে পৌঁছে দিয়েছিল বাংলাদেশের রক্তাক্ত জন্মের কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গানগুলো যেমনি মুক্তিকামী বাঙালিদের অস্ত্রহাতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে, তেমনি কোনো গান নিয়ে গেছে অসহায় শরণার্থী শিবিরে। এই অসাধারণ সব গানই ছিল বাঙালির সাহস আর এগিয়ে চলার মূল উৎস। এই গানগুলোই অস্থির মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে যে বাঙালিরা বেঁচে আছে, যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে, মুক্তি একদিন আসবেই। এভাবেই আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন অস্তিত্ব আদায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে অসামান্য কৃতিত্বের অংশীদার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। যে আবেগ, বিশ্বাস, চিন্তা একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখায়, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে শেখায়, ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, ভবিষ্যৎমুখী, অভিন্ন জাতিসত্তায় প্রণোদিত করে তাকেই বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে, আছে হাজার বছরের সংগ্রাম এবং লক্ষ মানুষের রক্তে রাঙানো কাহিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাঙালি প্রথম নিজেদের ‘আমরা বাঙালি’ আত্মপরিচয়ে শনাক্ত করতে পেরেছিল। এই আত্মপরিচয় বাঙালিকে অস্তিত্ব সচেতন করে তোলে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। বাঙালির মননে যে স্বাধীনতার মানসপট তৈরি হয়েছিল তা সংগীতের ব্যঞ্জনায় যোদ্ধাদের গতিশীল করেছে এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশ–বিদেশে তার আলো ছড়িয়ে মাত্র ৯ মাসে এনে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।
লেখক : অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ