কী এক অভূতপূর্ব ইতিহাস রচিত হলো বাংলাদেশের বুকে! বাতাসে আজও লাশের গন্ধ, হাসপাতালে আজও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে গুলিবিদ্ধ তরুণ–যুবা। চোখের আলো নিভে গিয়েছে অনেকের। হাত কিংবা পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করার আশংকা নিয়ে প্রাণে বেঁচে আছে কয়েকশো তরুণ। গণআন্দোলনের হাত ধরে পাওয়া নতুন দিনের আলোটুকুকে নিভিয়ে দেওয়ার কুটকৌশলও থেমে নেই তাই বলে। এটাই হয়তো বাংলাদেশের নিয়তি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে ছাত্র–জনতার অবিস্মরণীয় ও রক্তাক্ত গণ অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বলা যায় কি না, তা নিয়েও গেল কয়েক সপ্তাহে অসংখ্য নিবন্ধ রচিত হয়েছে। লেখকদের বেশীর ভাগই যে যার ভাবনা চিন্তা, মতাদর্শের আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। দেশ জাতির কল্যাণ ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের স্বার্থে নিজস্ব বিশ্বাসের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন, এমন কলমসৈনিকের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। বলাবাহুল্য শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগতির হাত ধরে আর্থ–সামাজিক উন্নয়ন সত্ত্বেও, রাজনৈতিক বিভাজনের যে দেয়ালটা রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে নির্মিত হয়েছিল, দিনে দিনে তা আরও উঁচু আর দুর্ভেদ্য হয়েছে, এবং এতো এতো রক্তস্নাত পালাবদল দেয়াল নির্মূলে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখে যারা গণআন্দোলনের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, বাঙালি জাতির অসভ্যতা নিয়ে যারপরনাই বিব্রত ও লজ্জিত হয়েছেন, তাঁরা হয়তো ভুলে গিয়েছেন কিংবা মনে করতে চাননা যে অভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ (অঘটন সমূহ) সাধারণ চোখে অশোভন মনে হলেও অস্বাভাবিক ছিল না, বরং অনিবার্য ছিল। জলপ্রপাতের মতো ধেয়ে আসা গণআন্দোলনের প্রকোপে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে অনেকেই ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’–এর ধুয়ো তুলে প্রকারান্তরে দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করছেন।
সকলের স্বাধীনতা আছে মতামত প্রকাশের, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার, বিশেষত দেশে যখন দীর্ঘদিন পর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ঢালাওভাবে ‘বাঙালি অসভ্য জাতি’, ‘এ জাতি কোনদিনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না’– এরকম হাজারটা অভিযোগের তীর যখন আমাদের জাতিসত্তাকে ক্ষতবিক্ষত করে, তখন ইতিহাসের অলিগলি ঘুরে আমরা দেখতে পাই– আমাদের তরুণযুবারা, যাদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা, তারা ইতিহাসের তাবৎ বিপ্লবীদের তুলনায় অনেক সভ্য, সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। যেখানেই অসভ্যতা, অসংযম ও দায়িত্বহীনতা দেখা গিয়েছে, সেখানে তারা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারেনি, তাদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে এবং হতাশা ও লজ্জার বিষয় এই যে, বিভ্রান্তিটা ছড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে তাদের পূর্ববর্তী শিক্ষিত প্রজন্ম অর্থাৎ, আমাদেরই পক্ষ থেকে। আমি সেই নষ্ট প্রজন্মের প্রতিনিধি, যারা জন্মসূত্রে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারিনি, কোন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেনি, দিন বদলে কোন অবদান রাখতে পারেনি।
গণআন্দোলনের মুখে পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠীর পলায়নের পর সরকার বিহীন কয়েকটি দিন ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়ানোর মতো করে সড়ক ও বাজার ব্যবস্থাপনা ও পাড়ায় পাড়ায় নিরাপত্তা রক্ষায় যে দূরদর্শীতা ও কর্মনৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছিল আমাদের কিশোর যুবারা, তা দেখে পৃথিবী অবাক তাকিয়েছিল। উর্দিধারী পেশাদার কর্মীগণ কীভাবে দায়িত্ব পালন করেন পাঁচ দশকের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশ তা দেখে আসছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর যারা এই বিপদকালীন অস্থায়ী পরিষদকে একদিনও স্বস্তিতে থাকতে না দেয়ার পণ করেছেন, তাঁরা ক্রমাগত নেতিবাচক ঘটনার জন্ম দিয়ে, প্রচার করে দেশকে অচল ও অর্থহীন প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে; তাঁরা মুচকি হাসেন, তিরস্কার করে ওঠেন– বেশ হয়েছে! এবার সামলাও! উপভোগ করো স্বাধীনতা! তাঁরা ভুলে যান বাংলাদেশ হেরে গেলে তাঁদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত জয় পরাজয়ের কোন অর্থ থাকেনা। শতধাবিভক্ত জাতিকে একতাবদ্ধ করতে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানসম্পন্ন যাঁদের এগিয়ে আসার কথা, তাঁরাই উস্কে দিচ্ছেন বিভেদের আগুন।
বিভেদের সেই দুর্ভেদ্য দেয়াল ভাঙতেই বুঝি জাতির ভাগ্যে নেমে এসেছে আরেক মহাপ্লাবন। স্মরণকালের ভয়াবহতম এই বন্যা নিছক প্রাকৃতিক, না ভূ–রাজনৈতিক, তা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছে। উন্নয়নের নামে যত্রতত্র অপরিকল্পিত নগরায়ণ যে বন্যার ভয়াবহতাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে সেকথাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তবে কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়া উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢল যখন দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলার অর্ধকোটির বেশী মানুষকে পানিবন্দি করে ফেলে, তাঁদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ, ছাত্র–জনতা। যারা বাঙালি হয়েও বাঙালিকে অসভ্য, অকর্মণ্য বলে প্রতিনিয়ত গাল দেন, তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন এই অফুরান প্রাণশক্তি কোথায় পেল বাঙালী? মাসব্যাপী উত্তাল আন্দোলন শেষে দেড় দশকের অধিককালের দুঃশাসনের অবসানের পরও ঘরে ফেরার সময় মেলেনি অনেক ছাত্রজনতার। অতন্দ্র প্রহরী হয়ে জেগে থাকে ওরা। অন্যায় অনিয়ম দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিচারপতিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আবারও ইতিহাস সৃষ্টি করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এবার ওদের লক্ষ্য সংস্কার; ঘুনে ধরা সমাজটার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া। শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে ওদের ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা– ‘এবার নতুন কিছু হোক’, ‘নিজে সৎ থেকে হেরে গেলেও দুঃখ পাবো না’। নজরুল, জহির রায়হানসহ নানা মনিষীদের বাণী রাঙিয়ে তোলে তারা রক্তের অক্ষরে।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নাম ভাঙিয়ে কত কী যে ঘটে গেছে গেল কয়েক সপ্তাহে! কিন্তু ওদের সব কর্মপরিকল্পনা এখন বন্যাদুর্গত মানুষদের নিয়ে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে তহবিল সংগ্রহ করছে, শুকনো খাবার ও অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করছে, একেকটি পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা করে তুলে রাখছে, উপদ্রুত অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করছে– এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী দিনরাত খেটে এই কর্মযজ্ঞ সামাল দিচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবীদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। ওদেরকে কেউ বলে দেয়নি– এটা করো, ওটা করো। কী এক প্রাণের টানে ওরা কাজ করছে হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে! দুর্গত মানুষের সেবা করার জন্য ঠিক যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে ওরা। ওদের চোখেমুখে স্বপ্নের ঝিলিক।
উন্নত বিশ্বের ছেলেমেয়েরা কল্পনাও করতে পারবে না, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা কেমন করে সময় পার করছে। আমরা যাদেরকে সভ্য ও উন্নত জাতি বলে মনে করি তারা কিন্তু নিজের কাজ ফেলে দেশের কাজে এভাবে ছুটে যায়না। অবশ্য তাদের তা করার প্রয়োজনও পড়েনা। কারণ রাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে বাধ্য। ক্ষমতার পালাবদলে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসেনা। পরাজিত পক্ষকেও পালিয়ে বেড়াতে হয়না। সেসব দেশে জনতাই ‘ভিআইপি’। তবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের পাশে পৃথিবীর খুব বেশী জাতিগোষ্ঠীকে দাঁড় করানো যায় বলে মনে হয়না। এক প্রবাসী আত্মীয় বলছিলেন– অন্যের বিপদে নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কাজ বাংলাদেশীরাই করতে পারে। দেড় দশকের বেশী সময় ধরে উন্নত বিশ্বের সেরা বাসযোগ্য শহরে অবস্থানরত বন্ধুর স্বগতোক্তি – সত্যিই, বাংলাদেশীদের অসীম ধৈর্য।
সমাজের শিরায় শিরায় দুর্নীতির হাত ধরে যত অব্যবস্থা বিদ্যমান, সবকিছুকে নিয়েই দেশের মানুষ যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে, তা বিস্ময়কর। উন্নত বিশ্বের ছকে বাঁধা জীবনে অপ্রয়োজনে, বিশেষত অর্থহীন কাজে একটি কর্মঘণ্টা নষ্ট করার প্রবৃত্তি হয় না কারও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনির্ধারিত ছুটির কথাও তারা কল্পনা করতে পারবেনা। আর আমাদের এখানে প্রায় দু মাস হতে চলল বেশীর ভাগ শ্রেণীকক্ষে তালা ঝুলছে, শিক্ষার্থী শিক্ষকের দেখা নেই, বই খাতার সঙ্গেও সংযোগ নেই বলা চলে। এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যে কোন পালাবদলের সঙ্গে রক্তপাত, ধ্বংসযজ্ঞ আর শিক্ষাখাতের ক্ষয়ক্ষতি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আমরা এসব মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু একুশ শতকের ছেলেমেয়েরা আর তা হতে দেবেনা। ওদের চাই ‘নতুন কিছু’; বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত একটি শান্তির দেশ। নতুন দিনের অগ্রপথিক ওরা। আমরা ওদের পাশে দাঁড়াতে না পারি, ওদের কাজে যেন বাধা হয়ে না দাঁড়াই, নিজেদের স্বার্থে ওদেরকে যেন আর ব্যবহার না করি। ওরা আপন শক্তি আর আপন আলোয় গড়ে তুলুক নতুন বাংলাদেশ; জাগ্রত জনতার একটি বাংলাদেশ।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।