জসীমউদদীন ও তাঁর ‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৯ আগস্ট, ২০২৫ at ৯:১৪ পূর্বাহ্ণ

জসীমউদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। জসীমউদদীনের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জসীমউদদীন মোল্লা যিনি পল্লীকবি জসীমউদ্দীন হিসেবে সমাধিক পরিচিত। ১৯০৩ এর ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে তাঁর জন্ম। বাড়ির সামনে সিঁড়ি। সিঁড়ির দু’দিকে লেবুগাছ, মাঝখানে ডালিমগাছ। এই জায়গাটিই তাঁর কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। ফলে তাঁর লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে পল্লী মানুষের জীবনের হালচাল এবং পল্লী অনুষঙ্গ উঠে এসেছে।

কবর’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে কবি জসীমউদদীনের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। ‘কবর’ কবিতাটি পাঠ করে অশ্রুসিক্ত হয়নি, এমন কঠিন হৃদয়ের মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। অগণিত পাঠকের হৃদয়জয়ী জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতাটি ২০২৫ সালে শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। ১৯২৫ সালে ‘কবর’ কবিতাটি প্রথম কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবি জসীমউদ্দীন সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বি.এ ক্লাসের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় তাঁর এ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবি হিসেবে এটি তাঁর এক অসামান্য সফল্য। ছাত্রাবস্থায় কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ায় কবি মহলে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়। জসীমউদদীন খ্যাতির শীর্ষে ওঠে যান। সাহিত্য সমালোচক আনিসুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে জসীমউদদীনের আত্মপ্রকাশ বলা যায় ১৯২৫ সালে, কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কবর’ কবিতা দিয়ে। ১৯২৩ সালে কল্লোলের প্রতিষ্ঠা ঘটে। …….. কল্লোলের দ্বিতীয় বর্ষে পরপর দু সংখ্যায় তাঁর দুটি কবিতা প্রকাশ পায়, তবে তা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু ওই পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় ‘গ্রাম্য কবিতা’ পরিচয়ে মুদ্রিত ‘কবর’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল।

জসীমউদদীন তাঁর আত্মস্মৃতিতে বর্ণনা করেছেন, ‘দীনেশচন্দ্র সেন একদিন এম. এ ক্লাসের সাহিত্যের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘জসীমউদদীনের মতো কবির শিক্ষক হতে পারা তাঁর জন্য বড় গৌরবের বিষয়। শেলি, কিট্‌স, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থবিশ্বসাহিত্যের এই মহারথীদের কবিতার চেয়েও জসীমউদ্দীনের কবিতা তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।’ জসীমউদ্দীন এম.এ পাশ করার পর তাঁর গুরু ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের প্রচেষ্টায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হতে গীতিকাসংগ্রাহকের দায়িত্ব পান। পাশাপাশি তিনি বাউলমুর্শিদিজারিরাখালি এইসব লোকগান নিজ আগ্রহে সংগ্রহ করেন। পরে তিনি এই সংগ্রহ নিয়ে বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর মুর্শিদি গানের আলোচনা প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল’ পত্রিকায়। পরে বই আকারে বের হয়। কবি জসীমউদ্দীন ছিলেন লোকসংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী। তাঁর কবিতা ও গানে এই অনুরাগের ছোঁয়া আছে স্পষ্টই।

রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে তিরিশের দশকে কবিতার আধুনিকতা নির্মাণ করেন কবি জীবানান্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে ও সমর সেন। এদের সাথে যুক্ত হলেন জসীমউদদীন। কল্লোলের তৃতীয় সংখ্যায় ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক মহল থেকে শুরু করে সাহিত্যের বিদগ্ধজনরাও জসীমউদদীনের কাব্য প্রতিভার সন্ধান পান। এটি শতাধিক চরণের এক দীর্ঘআখ্যান নিয়ে কবিতা।

কবর’ কবিতাটি জসীমউদদীন বিরচিত বাংলা সাহিত্যের একটি বহুল পঠিত কবিতা। এটি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটি কবির ‘রাখালী’ কাব্যে স্থান পেয়েছে। এ ধরনের কবিতাকে বলা হয় ড্রামাটিক মনোলগ বা একাকী কথন। দীর্ঘ এ কবিতার চরণ সংখ্যা ১১৮। বাঙালির প্রাণের আবেগ অতি নিবিড়ভাবে মিশে আছে এ শোকপ্রকাশক কবিতাটির প্রতিটি পংক্তিতে।

বাংলা সাহিত্যে যেসব মর্মস্পর্শী কবিতা আছে, তার মধ্যে কবর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কবিতাটিতে শুধু প্রিয়জনদের জন্য শোকই নয়, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের গাঢ় বেদনা আর ভালোবাসার রঙে আঁকা পল্লীজীবনের অসাধারণ ছবি অঙ্কিত হয়েছে। জীবনের ক্ষণিক আলো আর ভালোবাসার অপূর্ণতা এমন গভীরভাবে তুলে ধরলে, শব্দগুলো কেবল কবিতা নয়, মনে হয় যেন আত্মার আর্তনাদ। মৃত্যু আর শূন্যতার এই মিশ্রণে ভালোবাসার আবেদন যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এমন লেখা হৃদয়ে এক অমোচনীয় ছাপ রেখে যায়। কবিতাটির প্রথম স্তবক এরকম ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিমগাছের তলে,/তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

কবিতাটিতে কাহিনি বর্ণনাকারী এক গ্রামীণ বৃদ্ধ দাদু। আর শ্রোতা হলো তাঁর নাতি। নাতিকে উদ্দেশ্য করে বৃদ্ধ দাদু তাঁর জীবনের সকল প্রিয়জনকে হারানোর আকুতি ক্রমে ক্রমে ব্যক্ত করেছেন। বৃদ্ধের কাছে মনে হয় জীবনের নির্মম পথ তিনি আর চলতে পারছেন না। কবিতার শেষ স্তবকে তিনি নাতিকে বলছেন, ‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,/ অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে’। তিরিশের দশকে যখন ইউরোপীয় আধুনিক কাব্যের আদলে বাংলা কাব্যে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত হয় একই সময়ে জসীমউদদীন রচনা করেছিলেন ‘কবর’।

জসীমউদদীনের পূর্বজ ও সমসাময়িক কবিদের মধ্যে আরো অনেকেই পল্লীর জীবন ও প্রকৃতিকে তাঁদের কাব্যকবিতার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এদের মধ্যে করুণানিধান বন্দোপ্যাধায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, বন্দে আলী মিঞা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এদের কেউই পল্লীর জীবন ও প্রকৃতির রূপায়ণে জসীমউদ্দীনের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। এদের কবিতায় বিধৃত গ্রামীণ প্রকৃতি ও জীবনের চিত্র অনেকটাই দূর থেকে দেখা ছবির মতো। শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতিকে নাগরিক কোলাহলমুক্ত থাকার প্রয়াসে স্বতন্ত্র পথযাত্রার অসুষঙ্গ হিসেবে তাঁরা তাঁদের কাব্যের জন্যে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু জসীমউদদীনের কবিতায় বিধৃত পল্লীর চিত্র তাঁর কাছ থেকে দেখা ছবি।

শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্য সমালোচক ড. আহমদ শরীফ মনে করেন,‘জসীমউদদীন বাঙলা সাহিত্যের এক অনন্য কবি, ভাবেভাষায়ভঙ্গিতে তাঁকে আপাত দৃষ্টিতে লোকগাথার উত্তর সাধক ও উত্তরসূরি বলে প্রতীয়মান হলেও অঙ্গে ও অন্তরে এর রূপরস যে ভিন্ন তা সব সুদ দৃষ্টির, মর্জিত রুচির এবং প্রচ্ছন্ন রূপের ও রসের সমঝদার নিুপুণ পাঠক অনুভব ও উপলব্ধি করেন। বাংলাদেশে কোন কোন কবি জসীমউদদীনের অণুকরণে ও অনুসরণে অগ্রসর হতে গিয়েও তেমন সফল হননি। এতেও তাঁর অননুকরণীয় অনন্যতাই প্রমাণিত।’ তাই পল্লীজীবনের রূপায়ণে তিনি সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ও অকৃত্রিম। এই অকৃত্রিমতা তিনি তাঁর সমস্ত সাহিত্যসাধনায় আমৃত্যু ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোনো ধরনের মোহ বা প্রলোভন কখনো তাঁকে তাঁর মৌল পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এখানেই জসীমউদ্দীন অনন্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসৃজনের ভুবনে এক অক্ষয় নাম মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু
পরবর্তী নিবন্ধআনন্দলোকে মঙ্গললোকে