আমার বাড়ির পাশ দিয়ে (দক্ষিণ বাকলিয়াস্থ, আবু জফুর রোড) বয়ে চলেছে বির্জাখালী নামক একটি প্রাকৃতিক খালের শাখা খাল। এক সময় উক্ত খালের উপর দিয়ে পালতোলা নৌকা চলত। শৈশবে এই দৃশ্য অবলোকন করে আমি গভীর আনন্দ পেতাম। নিয়তির নির্মম পরিহাস বর্তমানে বির্জাখালী খালের শাখা খালটির কোনো অস্তিত্ব নেই। খালের ওপর নির্মিত হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা ও অসংখ্য স্থাপনা। যার ফলে সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় এলাকার দুই–তৃতীয়াংশ জায়গা। পানিবন্দি হয়ে পড়ে এলাকার হাজার দশেক মানুষ।
একসময় প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রাম নগরীতে ছিল অসংখ্য পুকুর, খাল–বিল, হ্রদ ও জলাভূমি। এগুলো ছিল নগরীর সৌন্দর্যের প্রতীক। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের শেষ আশ্রয়স্থল। প্রায় ২২ টির মতো প্রাকৃতিক খাল এবং অন্তত ৩৩ টি উপখালে সমৃদ্ধ ছিল নগরী। প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক খাল হলো চাক্তাই খাল, সদরঘাট খাল, ঢাকা–ট্রাঙ্ক লেইন খাল, নাছির খাল, পাকিজা খাল রামপুর খাল, মহেশ খাল, কাট্টলী খাল, গইন্যাচড়া খাল, কালীরছড়া খাল, জামালখান খাল, হিজড়া খাল, মীর্জা খাল, চটেশ্বরী খাল, ত্রিপুরা ছড়া খাল, নোয়াখাল, উত্তরাখাল, শীতল ঝর্ণা খাল, জেলে পাড়া খাল, নেভাল কলোনি খাল, মুন্সিখাল, গুপ্তাখাল, রাজাখালী খাল, বারমাসিয়া খাল, পাথরঘাটা খাল, মনোহর খাল, মাঝিরঘাট খাল, বদরখালী খাল ও বির্জাখালী খাল।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, ভূমিখেকোদের হিংস্র থাবায় নগরীর প্রায় সবকটি খাল এখন আক্রান্ত। এখনো যেগুলো কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে সেগুলোর অবস্থা করুণ। খালের উপর তারা নির্মাণ করেছে বহুতল ভবন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ছোটখাট কলকারখানা, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিউটি পার্লার, মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, ট্রেনিং সেন্টার ইত্যাদি।
বিলীন হয়ে যাওয়া এসব খালগুলির উপর একসময় পালতোলা ও মালবোঝাই নৌকা চলাচল করত। চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী মালবোঝাই নৌকার সাহায্যে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রেরণ করা হতো। বর্তমানে খালগুলো তাদের চিরাচরিত রূপ ও ঐতিহ্য হারিয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে।
বলা বাহুল্য, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা ব্রিটিশ আমলের। এ সমস্যা নিরসনে ‘কমিটি ফর দ্য স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অব দ্য টাউন অব চিটাগাং’ ১৮৫৬ সালের ১৪ মে সভা বসেছিল। ওই সভার একপর্যায়ে আলোচনা হয়, ‘শহরের যে অংশে দেশীয় লোকজন বসবাস করতেন, জলনিষ্কাশন সেখানে গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছিল। সে জন্য প্রাকৃতিক খাল নালাগুলোর উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।’
ব্রিটিশ আমলে গঠিত ওই কমিটি জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেই থেমে থাকেনি। শহরের জঙ্গল পরিষ্কার এবং জলনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে উপকমিটিও গঠন করা হয়েছিল সে সময়। জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের ব্যাপারে গঠিত এই কমিটি পরে রূপ নেয় ‘চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি’ বা পৌরসভায়। এরপর সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দুঃখ দূর করতে ১৯৯৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল ‘চিটাগাং স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল মাস্টারপ্ল্যান’। ২০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশনের।
মহাপরিকল্পনায় তিনটি প্রাইমারি (মূল) এবং ১৫টি সেকেন্ডারি (শাখা) খাল খনন, বিদ্যমান মূল ও শাখা খালগুলোর সংস্কার এবং দখলমুক্ত করা, কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত খালগুলোর মুখে ৩৬টি টাইডাল রেগুলেটর (জোয়ার রোধক ফটক) স্থাপন, পাহাড়ি বালু ঠেকাতে বিভিন্ন খালে ১৯টি সিলট্র্যাপ (বালির ফাঁদ) নির্মাণ, বৃষ্টি বা জোয়ারের পানি সংরক্ষণের জন্য আটটি জলাধার সংরক্ষণ করার প্রস্তাব ছিল।
বলা বাহুল্য, ২০২২ সালের নভেম্বরে, বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন এবং ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে চট্টগ্রামের সাড়ে ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা সরাসরি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে আছে। আর পরোক্ষ ঝুঁকিতে আছে ৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকা।
গবেষকরা বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই নগরীর এসব এলাকা জলাবদ্ধতার ঝুঁকির মধ্যে আছে। সমীক্ষায় আরও বলা হয়, বিগত ৫৩ বছরে শহরের ৭০ শতাংশ খাল বিলীন হয়ে গেছে।
অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলায় আগ্রাবাদ, হালিশহর, বাকালিয়া, মোহরা, খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইসহ নগরীর নিম্নাঞ্চল শুষ্ক মৌসুমেও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কোম্পানি জন আর স্নেল যখন শহরের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেন, তখন নগরীতে ৭০টি খাল পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালিত সমীক্ষা অনুসারে, ৫৩ বছরে খালের সংখ্যা ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ২২টিতে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জন্য মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান শীর্ষক সমীক্ষায় আরও জানা গেছে, চসিকের মোট ২২টি ওয়ার্ড সরাসরি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে, এর মধ্যে ৬টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, ৩টি চরম ঝুঁকিতে এবং ১৩ টি ওয়ার্ড মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে।
জলাবদ্ধতার খুব দ্রুত সমাধান করা না হলে ভবিষ্যতে মাত্র ২০০ মিমি বৃষ্টিপাতেও শহরের বেশিরভাগ নিচু এলাকা ১ দশমিক ৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে বলে জানান গবেষকেরা।
প্রসঙ্গত, প্রবল বর্ষণে আকস্মিক জলাবদ্ধতার সৃষ্টির পিছনে পুরোপুরি দায়ী হলো মানুষ। এর দায় কোনোভাবেই প্রকৃতির ওপর বর্তায় না। কারণ প্রকৃতির সহজাত ধর্মই হলো বন্ধুভাবাপন্নতা। অথচ পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে মানুষ সবসময় প্রকৃতির সাথে বৈরি আচরণ করে আসছে। ফলে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে প্রতিশোধপরায়ণ, নির্বিচারে গাছকাটা, অবৈধভাবে পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল উজাড় করে দেওয়ার ফলে প্রতিনিয়ত কাঁদছে প্রকৃতি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, চট্টগ্রামে গত এক–দুই দশক ধরে প্রকট হয়েছে জলাবদ্ধতার সমস্যা। জলাবদ্ধতা নগরকে পঙ্গু করে ফেলে। অন্তত ছয় মাস নগরের সব কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায়। বর্ষা ভারী হলে এ সমস্যা আরও ভয়াবহ হয়। জলাবদ্ধতার পেছনে পাহাড় কাটা, কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, খাল নালা দখল হওয়াসহ নানা কারণ আছে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের দায়িত্বশীলদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।