জলাতঙ্ক বা র্যাবিস আক্রান্তদের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ পশুর কামড় বা আঁচড়ের শিকার হয়। যাদের বেশিরভাগ হলো ১৫ বছরের কমবয়সী শিশু।
প্রধানত বাসা বা পাড়ার কুকুর (৯৯% শতাংশ ক্ষেত্রে), বেড়াল, শূকর ও নানা পোষা প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ে এ রোগের উৎপত্তি। তবে কেবলমাত্র জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কুকুর–বেড়াল–শেয়াল বা বন্য পশুর কামড় বা আঁচড়ে জলাতঙ্ক রোগ হয়ে থাকে। তাই সব কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে জলাতঙ্ক হবে, এ ধারণাটি ঠিক না। তবুও কখন কোন অবস্থায় প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে– সে সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা একবার উপসর্গ দেখা দিলে সে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি প্রায় শতকরা একশত ভাগ।
কিভাবে র্যাবিস ভাইরাস শরীরে ঢোকে–
হ র্যাবিস ভাইরাস দেখতে বুলেটের মতো। এটা এনভেলাপ যুক্ত আর.এন.এ ভাইরাস। র্যাবিস হলো স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ইনফেকশান, যে তন্ত্র আমাদের শ্বাস–প্রশ্বাস হাঁটা–চলা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এ রোগে মস্তিষ্ককোষ–সমূহ স্ফীত হয়।
হ র্যাবিস ভাইরাস পশুর লালাতে ঝরতে থাকে। পরে কামড় বা আঁচড়ে (থাবার নখে লেগে থাকা জীবাণু) দেহে ঢোকে।
কেন জলাতঙ্ক রোগ হতে শিশুমৃত্যু বেশি–
হ শিশুরা তাদের খেলাধুলার অংশ হিসেবে কুকুরকে রাগায়।
হ ছোটখাটো হওয়ার কারণে কুকুর শিশু শরীরের ওপরের অংশে কামড়ানোর সুযোগ বেশি পায়। যা নার্ভতন্তু বেয়ে দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছে ও সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম।
হ শিশু ত্বক নরম হওয়াতে ইনজুরি বেশি মাত্রার হয়।
হ ‘কুকুরে কামড়েছে’ এ কথা মা বাবা জেনে গেলে ইনজেকশন দিতে হবে– এ ভয়ে তারা বেশিরভাগ সময় বিষয়টা গোপন রাখে।
রোগ লক্ষণাদি–
সাধারণভাবে র্যাবিস ভাইরাস দেহে প্রবেশের ১ থেকে ৩ মাসের মধ্যে রোগ–লক্ষণ দেখা দেয়। তবে ক্ষত যদি মুখমন্ডল বা মাথায় হয়, কিংবা তা বড় আকার প্রকৃতির থাকে, তবে দুর্ঘটনার ৫ দিনের মধ্যে উপসর্গাদি প্রকাশ পায়। অন্যদিকে কামড়–আঁচড়ের ৮ বছর পরও র্যাবিস হতে দেখা যায়।
জলাতংক মূলত: দু’ ধরনের–
হ এনকেফালাইটিস ধরন– এটা ভয়ংকর প্রকৃতির। প্রথমদিকে জ্বর, গলাব্যথা, শিরঃপীড়া, বমি ইত্যাদি থাকে। কামড় বা আঁচড়ের স্থান চুলকায়। ক্ষত স্থানে থাকে ভিন্ন ধরনের স্নায়বিক অনুভূতি। পরবর্তীতে দ্রুত শিশুর আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। প্রধান লক্ষণ–কষ্টসাধ্য পানি পান ও শ্বাস–প্রশ্বাস (হাইড্রোফিাবিয়া–এরোফোবিয়া)। হাসপাতালে ভর্তির ১–২ দিনের মধ্যে এসব রোগীর মৃত্যু ঘটে।
হ প্যারালাইটিক বা ডাম্ব র্যাবিস– এই ধরনের র্যাবিসে প্রথমে জ্বর, ও পরে আক্রান্ত হাত–বা পায়ের অবশভাব নিয়ে উপসর্গের শুরু।
হ উপসর্গ দেখা শুরু হলে কোনো চিকিৎসাই আর কাজে আসে না।
চিকিৎসকের ভূমিকা–
হ কী ধরনের প্রাণীর কামড় জেনে নেন।
হ র্যাবিড অ্যানিমেল কিনা–পশুর আচার আচরণ কেমন ছিলো জেনে সিদ্ধান্ত দেন।
হ চিকিৎসক যদি র্যাবিড অ্যানিমেলের কামড় মনে করেন, তবে তিনি কয়েক ডোজ টিকা দিয়ে দেবার পরামর্শ পত্র লিখে দেন, যাতে অসুখটা প্রতিরোধ করা যায়।
জলাতঙ্কে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা–
হ পশুর কামড় বা আঁচড় দেওয়ার সাথে সাথেই, ক্ষতস্থান সাবান–পানি দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে দেওয়া চাই। কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধরে। এতে করে সংক্রমণ আশংকা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হ্রাস পায়। পরে ৭০% ইথানল, আয়োডিন, পভিডিন–আয়োডিন বা অন্যান্য অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করে নিলে ভালো। তারপর শিশু–বিশেষজ্ঞ বা নিকটস্থ হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যেতে হবে।
হ কুকুর বাড়ি, পাড়ার পোষা কিংবা পরিচিত হলে,ও স্বাভাবিক আচরণের থাকলে সে কুকুর বা পশু বেঁধে রেখে ১০ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা। ১০ দিন পর উক্ত কুকুর বা প্রাণী সুস্থ থাকলে সাধারণভাবে ভয়ের কারণ থাকে না।
হ জলাতঙ্কগ্রস্ত কুকুর বা পশু পাগলের মতো আচরণ করে। বা রাগী কুকুর হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়, কিংবা সর্বক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে, মুখ দিয়ে লালা পড়ে, লালার সাথে জীবাণু নির্গত হয়। সামনে মানুষ বা পশু যাকে পায়, তাকেই কামড়াতে যায় ও কয়েকদিনের মধ্যে মারা যায়।
হ কুকুর যদি জলাতঙ্কগ্রস্ত মনে হয়, বা অপরিচিত হয়, বা ১০ দিন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না হয়, (যেমন কামড়ানোর পর কুকুরকে মেরে ফেলা হলে, বা এর খোঁজ না পাওয়া গেলে), তবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ও পরামর্শে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টি–র্যাবিস ভ্যাকসিন শুরু করতে হবে।
হ জলাতঙ্ক প্রতিষেধক হিসেবে বর্তমানে বেশ কয়েকটা উন্নতমানের নিরাপদ টিকা (এইচডিসিভি, পিসিইসি, পিভিআর) রয়েছে। ৬টি ইনজেকশন ০, ৩, ৭, ১৪,,৩০, ৯০, দিবস–এ শিডিউলে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কামড় বা আঁচড়ের ধরনের ওপর নির্ভর করে দিতে হবে র্যাবিস ইমিউনিগ্লোবুলিন, ও ধনুষ্টংকারের প্রতিষেধক টিকা।
হ কুকুর বা পশুতে কামড়ালেই বিষ নামানোর নানা প্রচলিত চিকিৎসা, পানি–পড়া, মাদুলি বাঁধা, বিশেষত স্বপ্নপ্রাপ্ত ওষুধ খাওয়ানো–এসবের কোনো মূল্য নেই। যা কোনো কোনো সময় ভয়ানক ক্ষতি ডেকে আনে।
হ র্যাবিস ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের যেমন– ল্যাবরেটরি স্টাফ, পশু আলয়ের কর্মচারীদের ০, ৭, ও ২৮–দিন, এই শিডিউল মেনে র্যাবিস প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ।
কুকুরের কামড় থেকে নিজের সুরক্ষা–
হ কুকুর বেড়াল ছাড়াও বড় বেড়াল শ্রেণির পশু (বাঘ, সিংহ) বন্য কুকুর, হায়েনা, কুমিরসহ আরো অনেক পশুর আক্রমণের শিকার হতে পারে যে কেউ, যার ধরন এক দেশ হতে এক অঞ্চল হতে অন্য দেশ বা অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন।
হ কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগী বেশি মেলে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মায়ানমারে। তুলনায় নেপালে ষাঁড়ের আক্রমণ চিত্রটা বেশি। ৬–১১ বছরের যারা, তারা কুকুরের কামড়ের বেশি শিকার হয়। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে এ হার বেশি।
হ ৬৫% আক্রমণ ঘটনা ঘরের চারপাশেই ঘটে থাকে। ছোটরাও ৭৫% ক্ষেত্রে আক্রমণকারী কুকুর শনাক্ত করতে পারে। ৫০% ক্ষেত্রে বিনা উসকানিতেই কুকুর কাউকে কামড়িয়ে দিতে পারে। বেড়ালের কামড় ছাড়া প্রিস্কুল ও স্কুলে অধ্যয়নরত বয়সে যে কেউ মানুষের কামড়ের শিকার হতে পারে।
হ শান্ত সুবোধ দেখালেও কখনো রাস্তার পশুকে আদর করতে বা খাওয়াতে না যাওয়া।
হ পোষা পশু–প্রাণীকে র্যাবিস টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসা।
কুকুরের কামড় থেকে শিশুকে পরিত্রাণ দিতে আচরণ কি রকম হওয়া উচিত–
হ কখনো কুকুরকে অতিক্রম করে দ্রুত চলে যেতে চেষ্টা না করা।
হ কুকুর কাছে এগুতে থাকলে শান্ত থাকা।
হ কুকুরকে আদর সোহাগ চুম্বন দিতে না যাওয়া।
হ কুকুরের চোখে চোখে তাকাতে নেই।
হ যদি কুকুর আক্রমণ করে বসে, তবে পা দুটো একত্রে রেখে নড়চড় ছাড়া পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা। বাহু ও হাত দিয়ে মুখ এবং ঘাড়ের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
হ যদি শুয়ে থাকা অবস্থায় আক্রমণ করে, তবে নড়াচড়া না করে শুধু হাত দিয়ে মুখমন্ডল ও কান রক্ষার চেষ্টা করা।
হ দুই যুদ্ধমান কুকুরকে কখনো থামাবার প্রচেষ্টা না নেওয়া।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।