২০২১ বিশ্ব জলবায়ুর জন্য অন্যতম একটি বছর। এই বছর বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং শীর্ষ জলবায়ু কর্মকর্তারা প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি নিয়ে পুনরায় আলোচনা করার জন্য গ্লাসগোতে ২৬ তম কনফারেন্স অফ পার্টিস কপ-২৬ এ জড়ো হয়েছেন। বিশ্ব একটি অস্থিতিশীল জলবায়ুর গুরুতর পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার একটি বিপজ্জনক পথে রয়েছে এবং দেশগুলির এই অঙ্গীকার এবং প্রতিশ্রুতিগুলি এই শতাব্দীর শেষের দিকে এই গ্রহের ভাগ্যের জন্য নির্ধারক হবে।
এবারের সম্মেলনের সভাপতি, ব্রিটিশ মন্ত্রী অলোক শর্মা বলেছেন, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সীমাবদ্ধ রাখতে হলে এখনি পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০১৫ সালে প্যারিসে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনার চুক্তি হয়েছিল। এবার বলা হচ্ছে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস নামিয়ে আনার কথা। এ পরিকল্পনা সফল না হলে উষ্ণ তাপমাত্রায় সমুদ্রসীমা বেয়ে অনেক দেশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে দরিদ্র দেশগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ধনী দেশগুলো। এজন্য যে অর্থ প্রয়োজন ছিল ধনী দেশগুলো তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে তারা এ দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যাতে তাদের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা সহজ হয়। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি। কার্বন নিঃসরণের পূর্বের অঙ্গীকারও পূরণ হয়নি। সে জন্যই প্রশ্ন থেকে যায় ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনে অধিক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে এ দেশগুলোকেই। অন্যদিকে, কার্বনের মাত্রা কমিয়ে আনার বাধ্যবাধকতায় তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন।
ইউনিসেফের নতুন এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে বসবাসকারী শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এছাড়াও বৈশ্বিক পর্যায়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা।
বাংলাদেশ, অস্থিতিশীল জলবায়ুর অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে ইতিমধ্যে বিশ্ব নেতাদের কাছে চিহ্নিত হয়েছে। এজন্যই, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বব্যাপী দায়িত্বের অংশীদার হওয়ার ব্যপারে বাংলাদেশ সর্বোপরি জোড় দিয়ে আসছে। কিন্তু বিশ্বও জানতে চায় জলবায়ু রক্ষায় বাংলাদেশ কতটুকু অঙ্গীকারবদ্ধ।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম সিভিএফ এবং ঠ২০-এর চেয়ার হিসেবে, বাংলাদেশ ৪৮টি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের স্বার্থ প্রচার করছে – যার ফলে বিশ্ব নেতাদের কাছে বাংলাদেশ একটি অগ্রণী উদাহরণ হতে পারে। বাংলাদেশ তার ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে তার শক্তির চাহিদার ৪০% পূরণ করার পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশের উচিত অবিলম্বে সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি প্রত্যাহার করা। একই সময়ে, বাংলাদেশের উচিত জীবাশ্ম জ্বালানির সাথে যুক্ত সম্পদ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া। সে ক্ষেত্রে, কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি বা বিনিয়োগকারীর কোনো স্টক, বন্ড বা স্পনসরশিপকে অবমূল্যায়ন করা উচিত। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের  ১০টি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিদেশী বিনিয়োগ অস্বীকার করেছে। ক্লিন এনার্জি প্রযুক্তি এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামোর জন্য দরকার শক্তিশালী বিনিয়োগ নীতি। সৌর শক্তির মোট উৎপাদন ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ গিগাওয়াট পর্যন্ত স্কেল করা যেতে পারে, যেখানে বায়ু শক্তি উৎপাদন ৩০ গিগাওয়াট পর্যন্ত স্কেল করা যেতে পারে। এগুলি অর্জনের মাধ্যমে, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুতের চাহিদার ৫০% পূরণ করতে পারে কেবল সৌরশক্তি।
বাংলাদেশের গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন বেশিরভাগই হয় শহর অঞ্চল থেকে। চলমান দ্রুত নগরায়নে, বাংলাদেশের উচিত কার্বন-নিরপেক্ষ শহর ও বসতি গড়ে তোলার জন্য আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করা। দেশের নগর পরিকল্পনার উচিত হাঁটার যোগ্য এবং সাইকেলযোগ্য শহর, গণ ট্রানজিট ব্যবস্থা এবং শহুরে সবুজায়নে সজ্জিত নীতি গ্রহণ করা। নতুন বিল্ডিংগুলিকে শক্তি সাশ্রয়ী হতে হবে এবং টেকসই উপকরণ দিয়ে তৈরি করতে হবে এবং পুরানো বিল্ডিংগুলিকে সঠিকভাবে সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাবগুলি প্রকাশ্যে এবং ব্যাপকভাবে প্রকাশ করা। বায়ু দূষণ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়বে। যথাযথ আদমশুমারির মাধ্যমে জলবায়ু অভিবাসীদের সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মূল চাবিকাঠি। এবং পরিশেষে, বাংলাদেশের উচিত তার জলবায়ু শিক্ষা এবং সম্পৃক্ততা কার্যক্রম জোরদার করা।
লেখক : প্রভাষক, স্কুল অফ বিজনেস, মোনাস ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া
        











