জলবায়ু পরিবর্তন ও লিঙ্গ সমতা-পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ড. সোমা ধর | শনিবার , ৮ জুলাই, ২০২৩ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২এর ফলাফল অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন, নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। হিসেব মতে, নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে ১৬ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮২ জন অধিক। তাই একটি দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেণির মর্যাদা আর উন্নয়ন ব্যতীত দেশের উন্নয়ন কি সম্ভব?

সত্যি কথা বলতে নারী, পুরুষ সকলের সহযোগিতা ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার আলো জাগাতে, জ্ঞানের পথ দেখাতে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো একজন পথ প্রদর্শক সত্যি খুব দরকার। আমি পুরুষ আমিই শ্রেষ্ঠ না ভেবে নারীও মানুষ, তারও সমমর্যাদা আছে, এই বোধ গড়ে ওঠা দরকার।

পুরুষের দৃষ্টিতে নারী অবলা, শক্তিহীন, মূল্যহীনএই মানসিকতার পরিবর্তনের লক্ষ্যে গোটা বিশ্ব আজ লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার। অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে লিঙ্গ বৈষম্য কী করে দূর করা যায় তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিশ্ব লিঙ্গ সমতা সূচকে বাংলাদেশের নারীরা রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানদণ্ডে এখনো অনেক পিছিয়ে।

২১ শতকের সূচনালগ্ন থেকে জলবায়ু পরিবর্তনে নারীদের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পরিবেশের উপর নারীর প্রভাব বেশি, কেননা নারীরা পুরুষদের চেয়ে প্রকৃতির উপর বেশি নির্ভরশীল। জাতিসংঘের গবেষণা অনুসারে জলবায়ুর পরিবর্তনে বাস্তুচ্যুত মানুষের আশি শতাংশই নারী। জলবায়ু, খাদ্য উৎপাদন ও নারীতিনটি এক অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

জলবায়ু পরিবর্তন ক্ষমতার কোনো লড়াই নয়, এটা টিকে থাকার লড়াই’ পরিবেশ বিজ্ঞানী ডায়ানা লিভারম্যানের চমৎকার এই উক্তি আমাদের শিহরিত করে। তিনি বলেন, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। টেকসই উন্নয়ন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে পরিবেশ সংরক্ষণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ আগামীতে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেবে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের সকল আলোচনায় নারীদেরকে অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নারীরা বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। কিন্তু এই নারীরাই জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত থেকে পরিবারসহ বিশ্বকে বাঁচাতে সক্ষম। পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জনাব সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় নারীর অবদানকে নীরব, কিন্তু শক্তিশালী বিপ্লব বলে চিহ্নিত করেছেন।

উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা পরিবার, সন্তান, গবাদিপশু, দৈনন্দিন খাদ্য, পানি, জ্বালানী ও পশু সংগ্রহ, বৃক্ষরোপণের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করে। সন্তান লালনপালন এবং পরিবারের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি সহানুভূতিশীল, যত্নশীল এবং অসমতাবিরোধী হতে থাকে। এই কারণে, মহিলাদের জীবিকা পুরুষদের তুলনায় বেশি জলবায়ুসংবেদনশীল হতে থাকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে বীজ সংরক্ষণ, অভিযোজন এবং জলবায়ু সহনশীল কৌশল গ্রহণে ভূমিকা রাখে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া অপরিহার্য।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে কৃষিকাজের সূচনা হয়েছে নারীদের হাত ধরেই। নারীরা প্রথম বুঝতে পারেন যে, মাটিতে বীজ পুঁতলে তা থেকে নতুনভাবে ফসল তৈরি হয়। শিল্পোন্নত কৃষির আবির্ভাবের অনেক আগেই নারী কৃষকরা মাটিতে পুষ্টির জন্য বিনা রাসায়নিক সার এবং উর্বরতা তৈরি করতে কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। পরিবেশ আন্দোলনের যাত্রা ও নারীদের দ্বারাই শুরু হয়েছিল। র‌্যাচেল কারসনের বই সাইলেন্ট স্প্রিং পৃথিবীকে নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার জন্য একটি প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল। শেষ পর্যন্ত এটি ধরিত্রী দিবসের প্রতিষ্ঠা এবং মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা তৈরির পথ সুগম করে।

জাতিসংঘের গবেষণা মতে, নারীরা যখন পুরুষদের মতো একই সম্পদ ব্যবহার করে, তখন কৃষি উৎপাদন (২০৩০)% বৃদ্ধি হয় এবং (১২১৭)% ক্ষুধা হ্রাস হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় দুইতৃতীয়াংশ পরিবারে, নারী এবং মেয়েরা পানি সংগ্রহ এবং ব্যবস্থাপনার সাথে নিয়োজিত। তাই টেকসই পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার সাফল্য নিশ্চিত করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সকল স্তরে নারীদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। ইউ এন এর মেরি রবিন্সন ফাউন্ডেশন (পরিবেশ বিচার, বৈশ্বিক লিঙ্গ ও পরিবেশ জোট) ও ইউ এন এফ সি সি সি এর তৈরি প্রতিবেদন চিহ্নিত করেছে যে, কাঠামোগত লিঙ্গ অসমতা জলবায়ু বিজ্ঞান, চুক্তি ও নীতিনির্ধারণে নারীদের প্রতিনিধিত্বের পথে বাধা সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনে ইউ এন এফ সি সি সি ও জাতীয় প্রতিনিধিবর্গের মাঝে লৈঙ্গিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনের যুক্তি অনুসারে নারী ক্ষমতায়ন ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

বিশ্বজুড়ে ১৭টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি উদ্ভাবনী এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। নারীদের উপস্থিতির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণে আরও টেকসই নীতি নির্ধারণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সহযোগিতা এবং দ্বন্দ্ব নিরসন সম্ভবপর হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি, কারণ এটি সম্পদের প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করে। এর প্রভাবে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা আগামী ২০৩০ এবং ২০৫২ এর মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেড়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দিকে নিয়ে যাবে। যার দীর্ঘমেয়াদী ফলস্বরূপ মানুষ এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর গুরুতর, ব্যাপক এবং অপরিবর্তনীয় প্রভাবের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং আবহাওয়ার বিভিন্ন পরিবর্তন বেশিরভাগ খাত( কৃষি, মৎস্য, জ্বালানি, পর্যটন এবং নির্মাণ)- কে সরাসরি আঘাত হানবে ফলে জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হল লিঙ্গ সমতা। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও এখনো তা লিঙ্গ বৈষম্য কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

বাংলাদেশে নতুন জলবায়ু নীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন করার জন্য তৈরি বাজেট লিঙ্গ বান্ধব হওয়া দরকার। কেননা স্মার্ট অর্থনীতি পাওয়ার একমাত্র শর্ত হল জেন্ডার স্মার্ট। আর তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে জেন্ডার স্মার্ট ক্লাইমেট ফাইনেন্স অত্যাবশ্যকীয়। দেশ বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে এর কোনো বিকল্প নেই।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ জেন্ডার স্ট্রাটেজি (২০২৪২০৩০) অনুসারে, একটি টেকসই, সহিষ্ণু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ পেতে হলে লিঙ্গ সমতা ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (এমজিআই) প্রতিবেদন মতে, যদি লিঙ্গ সমতায় দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের সাথে সমস্ত দেশ মিলে যায়, তবে ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জিডিপিতে ১২ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১১% যোগ করবে।

২০২১ সালের নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত কপ২৬ সম্মেলনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখার নিমিত্তে নারীদেরকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সুযোগ সৃষ্টি ও নেতৃত্ব দেয়ার প্রতি আহ্‌বান জানানো হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সকল স্তরে যদি নারীপুরুষের সমতা বজায় রাখা যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নারীরা আরো বেশি ভূমিকা রাখবে। ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুসারে বৈশ্বিকভাবে লিঙ্গ বৈষম্য দূর হয়েছে ৬৮ শতাংশ। এই হিসেবে শতভাগ সমতা অর্জনে সময় লাগবে আরো ১৩২ বছর।

দিন আসবে, দিন যাবে, পরিবর্তনের পালা বদল চলবেই। একটু দেরিতে হলেও সমতা আসবে। কালের যাত্রায় বাংলার পিছিয়ে পড়া নারী সমাজ আজ এগিয়ে গেছে বহু দূর। সামনে আরো আরো এগিয়ে যাবে, যেতে বাধ্য। কেননা প্রকৃতি নারীকে শক্তিশালী করে তুলছে, সংবেদনশীল করে তুলছে। তাই আর পিছিয়ে নয়, এগিয়ে যাওয়ার দিন, আরো নতুন কিছু সৃজনের অপেক্ষায় আছে এই বাংলার প্রকৃতি।

লেখক : অর্থনীতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধতোমার গুণগান গাই অবলীলায়
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে