বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানকে এর ভয়াবহ প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে। সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ঝুঁকি থেকে স্থিতিস্থাপকতা : দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের অভিযোজনে সহায়তা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। সেখানেই উঠে এসেছে এ তথ্য। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ চরম জলবায়ু ঝুঁকির মুখে পড়বে। উচ্চ তাপমাত্রা, ভয়াবহ বন্যা, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি–সব মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি উৎপাদন ও কর্মসংস্থান। পারিবারিক পর্যায়েও ঝুঁকি বাড়বে বহুগুণ।
জরিপে দেখা যায়, আগামী ১০ বছরে আবহাওয়াজনিত ধাক্কার আশঙ্কা করছে দক্ষিণ এশিয়ার তিন–চতুর্থাংশ পরিবার ও প্রতিষ্ঠান।
এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এবং ৮০ শতাংশ পরিবার কোনো না কোনোভাবে অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা উন্নত প্রযুক্তি বা অবকাঠামোর বদলে কম খরচের সাধারণ সমাধানের ওপর নির্ভর করছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি সমন্বিত ও বহুমুখী অভিযোজন কৌশল গ্রহণের তাগিদ দেয়। এতে বলা হয়, আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা, বীমা ও আনুষ্ঠানিক ঋণপ্রাপ্তি সহজ করা গেলে জলবায়ুজনিত ক্ষতির প্রায় এক–তৃতীয়াংশই এড়ানো সম্ভব। বেসরকারি খাত যদি প্রয়োজনীয় স্থানে দ্রুত বিনিয়োগ ও সম্পদ স্থানান্তর করতে পারে, তাহলে অভিযোজনের গতি আরো বাড়বে। বাজেট সংকটের মধ্যেও সরকার পরিবহন ও ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থায়নে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি এবং নমনীয় সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো প্রবর্তনের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে পারে। আগাম সতর্কবার্তা ও সাইক্লোন সেন্টারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুফল ইতিমধ্যে মিলেছে–প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এটি দেখায়, সঠিক বিনিয়োগ ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারলে স্থানীয় অভিযোজনে সাফল্য আরো বাড়ানো সম্ভব।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় শক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও তথ্য সংগ্রহ সবই ব্যয়বহুল। জলবায়ু অভিযোজন মোকাবেলায় বাংলাদেশের অনেক পলিসি রয়েছে, তা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং। তিনি আরো জানান, এ বিষয়ে পাইলট প্রকল্প চলমান রয়েছে। তবে, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের সমন্বয়ে বাংলাদেশ বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা, যার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। এ জন্য বিভিন্ন স্তরে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন, জাতীয় সরকারগুলো উচ্চাভিলাষী নির্গমন হ্রাস লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চুক্তি তৈরি এবং সহযোগিতা সহজতর করে। জলবায়ু কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দেওয়া, সম্পদ বরাদ্দ করা এবং পরিবর্তনকে চালিত করে এমন নীতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য শক্তি, অভিযোজন ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে যথেষ্ট আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের জলবায়ু প্রশমন এবং অভিযোজন প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। তহবিলের প্রাপ্যতা সরাসরি জলবায়ু কর্মকাণ্ডের গতি এবং স্কেলকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত। এর মধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বন বিভাগ, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন জলবায়ু–সম্পর্কিত উদ্যোগে ভূমিকা পালন করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘টেকসই ও নবায়ণযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, পরিবেশগত ঝুঁকির ঝুঁকি হ্রাস এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ও সমপ্রসারণের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের উপকূলের ২৫০টি গ্রামে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, জলবায়ু–সহনশীল অবকাঠামোই এখন সবচেয়ে বড় অপূর্ণ চাহিদা। দীর্ঘ মেয়াদে ৫৭ শতাংশ পরিবার পর্যাপ্ত দুর্যোগ–সুরক্ষা অবকাঠামোর অভাবকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে; ৫৬ শতাংশ পরিবার বলেছে, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা প্রয়োজনীয় অভিযোজন করতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অভিযোজন ব্যাপক হলেও ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে, ফলে আরো কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। দেশের সহনশীলতা গড়ে তুলতে আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা, জলবায়ু–স্মার্ট কৃষি এবং ঝুঁকিভিত্তিক অর্থায়ন বাড়াতে হবে।








