দেশসহ বিশ্ববাসীর জীবন প্রবাহে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্দয় প্রভাব গভীর অনুভূত। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশসহ ধরিত্রীর বহু অঞ্চলে তীব্র তাপদাহ ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করেছে। জনজীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত ও স্থবির। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মূলত দায়ী উন্নত বিশ্বের গ্রীন হাউজ প্রক্রিয়া ও অধিকমাত্রায় অপরিকল্পিত শিল্পায়ন–নগরায়ণ। এদের সুদূরপ্রসারী জলবায়ু–সুরক্ষা বিরোধী কার্যক্রমে পুরোবিশ্ব যারপরনাই পর্যুদস্ত। বন্যা–খরা–অতিবৃষ্টি– অনাবৃষ্টি– দাবদাহ– ভূমিকম্প– বজ্রপাতসহ নানা ধরনের কঠিন সংকটে বিশ্ব নিপতিত। এটি সুস্পষ্ট যে, জলবায়ু পরিবর্তনে শীতপ্রধান দেশগুলোর চেয়ে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলো অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত। অনাবৃষ্টির কারণ কোথাও খরা ও শস্য উৎপাদনে ব্যাপক অন্তরায় হিসেবে বিবেচ্য। অন্যদিকে অতিবৃষ্টি মৌসুমী ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস প্রায় জনপদকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। জীবনযাত্রা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে সভ্যতাকে যেন পরাজিত করে চলছে। নেতিবাচক কারণে জনদুর্ভোগ কোন পর্যায়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরাও তার চৌহদ্দী নিরূপণ করতে পারছে না। উন্নত বিশ্বের বৃহৎ বনাঞ্চলগুলো দাবানলে চরম আক্রান্ত। পর্যাপ্ত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অগ্নি নির্বাপণে হিমশিম খেতে হচ্ছে দক্ষ ফায়ার ফাইটারদেরকে। অনুন্নত বিশ্বে অপ্রতুল সুযোগ সুবিধা অহরহ অগ্নি দুর্ঘটনায় সম্পদ ও প্রাণহানির সীমাহীন আর্তনাদে ভরপুর। সর্বত্রই করুণ আহাজারিতে মানবজীবনের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সরকার বা কর্তৃপক্ষের নির্মম অবজ্ঞা–অবহেলা সমস্যাসমূহের নতুন নতুন জটিল অধ্যায় তৈরি করে চলছে।
নানামুখী মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে সমগ্র ধরিত্রী জুড়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া অতিশয় দৃশ্যমান। এশিয়া মহাদেশে এর মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ মহাদেশের অনেক দেশে বর্তমানে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। অতিসম্প্রতি মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে নজিরবিহীন বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ২৪ এপ্রিল ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত জাতিসংঘের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থার (ডব্লিউএমও) প্রতিবেদন অনুসারে, এশিয়া মহাদেশ দুর্যোগের ক্ষেত্রে শীর্ষে অবস্থান করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, আবহাওয়াগত রূপ বদল এবং পানিসংশ্লিষ্ট দুর্যোগের ক্ষেত্রে ২০২৩ সালে বৈশ্বিক তালিকায় ওপরে ছিল এশিয়া। ঝড় ও বন্যা ছিল ক্ষয়ক্ষতি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। তাছাড়া দাবদাহের ঘটনাও তীব্রতর হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এশিয়া মহাদেশ সবচেয়ে দ্রতগতিতে উষ্ণ হচ্ছে। ২০২৩ সালে এশিয়ায় গড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ১৯৬১–৯০ সালের গড় মাত্রার চেয়েও বেশি।
উক্ত প্রতিবেদনে দেওয়া বক্তব্যে সংস্থাটির প্রধান সেলেস্তে সাউলো বলেন, ‘এই অঞ্চলের অনেক দেশ ২০২৩ সালে উষ্ণতম বর্ষের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছে। সেখানে খরা, দাবদাহ থেকে শুরু করে বন্যা ও ঝড়ের মতো চরমভাবাপন্ন নানা পরিস্থিতির দেখা মিলেছে। দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট বিপর্যয়কে মাত্রা ও তীব্রতার দিক থেকে আরও ব্যাপক করে তুলেছে জলবায়ু পরিবর্তন। এ অবস্থায় গোটা অঞ্চলের দেশগুলোর তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করতে কর্মকর্তাদের একসঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে একটি আবহাওয়া পরিষেবা উন্নত করা উচিত। এতে ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন করা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কর্মকাণ্ড এবং কৌশলগুলো সময়ের জরুরি পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করে। গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাসের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর কোনো সাধারণ উপায় নয়; বরং অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক প্রয়োজন।’
আশাজাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, ইতিমধ্যে গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের তরুণ সমাজ যুক্ত হয়েছে। জলবায়ু কর্মীর উপাধিতে ভূষিত এসব তরুণ সমাজ জলবায়ু সুরক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ১৯ এপ্রিল একশনএইড বাংলাদেশ এর যুব প্ল্যাটফর্ম এক্টিভিস্টা বাংলাদেশ’র সহযোগিতায় আয়োজিত সমাবেশে জলবায়ু আন্দোলনকারীদের তৎপরতা অতি আশাব্যঞ্জক। দেশ ও বৈশ্বিক বেসরকারি বিনিয়োগ সংস্থা–ব্যাংক–বেসরকারি সেক্টরের নিকট জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়ন বন্ধ, নবায়নযোগ্য শক্তির সম্প্রসারণ ও টেকসই কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য তাদের জোরালো আহ্বান বিশেষ ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। ‘ফিক্স দ্য ফাইন্যান্স’, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করো’, ‘ক্ষতিকারক কৃষি চর্চায় বিনিয়োগ বন্ধ করো’, ‘ক্লাইমেট জাস্টিস নাউ’, ‘জলবায়ু সহনশীল টেকসই কৃষি চর্চায় বিনিয়োগ করুন’ সম্বলিত বিভিন্ন ফেস্টুন–প্ল্যাকার্ড, চিত্রকর্ম, গান ও নাটক প্রদর্শনে তরুণ জলবায়ু কর্মীদের সক্রিয় উপস্থিতি বিপুল সমাদৃত। তাদের দাবি এখন কথা বলার সময় নয়, শুধু কর্মের সময়। তারা এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যেখানে কোন লোভ এই পৃথিবী ও মানুষদের মঙ্গলকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ১৩ তে বলা হয়েছে, সকল দেশে জলবায়ু সম্পৃক্ত ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অভিঘাতসহনশীলতা ও অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। জাতীয় নীতিমালা, কৌশল ও পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কর্মব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি। অর্থবহ প্রশমন তৎপরতা ও বাস্তবায়ন–স্বচ্ছতার প্রেক্ষাপটে উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা মেটাতে ‘জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি)’ এর উন্নত দেশভুক্ত পক্ষ কর্তৃক প্রতিশ্রুত ২০২০ সাল নাগাদ যৌথভাবে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্য বাস্তবায়ন। সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে মুলধনী অর্থায়নের (ক্যাপিটালাইজেশন) মাধ্যমে ‘সবুজ জলবায়ু তহবিল’ (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড) সক্রিয় করার ব্যবস্থা গ্রহণ। নারী, যুবসমাজ, স্থানীয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর প্রাধিকারসহ স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কার্যকর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে কর্মপদ্ধতির প্রবর্ধন।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করে দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে উপকূলীয় এলাকায় বহু ভবন নির্মাণ করায় দুর্যোগে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও উপার্জন হারানোর হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভার মোকাবেলা সংক্রান্ত কর্মকান্ডে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে বার্ষিক বরাদ্দের ৬ থেকে ৭ শতাংশ ব্যয় করছে। বছরে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০০ কোটি ডলারের সমান। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই পরিবেশের অনুষঙ্গগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় সরকার কর্তৃক ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা ২০০৯’ চূড়ান্ত করা হয়। বর্ণিত এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ২০০৯–১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী উন্নত দেশের অর্থ প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা না করে নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের তহবিল গঠন বিশ্বে প্রথম যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
২২ এপ্রিল ২০২৪ ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান (ন্যাপ) এক্সপ্রো–২০২৪’ এবং ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (বিসিডিপি)’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকে রক্ষায় যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র এবং অর্থ ব্যয় না করে সেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় তিনি ছয়টি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে চাই। এ জন্য প্রয়োজন অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি, সহিষ্ণুতা শক্তিশালী করা এবং ঝুঁকি হ্রাসে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে এই ধরিত্রীকে রক্ষায় কাজ করা। উন্নত দেশগুলো ব্যাপক কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অধিক ভূমিকা রেখে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে রক্ষা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতায় এটি দৃঢ়ভাবে দাবি করা যায় যে, উন্নত বিশ্বের নেতৃবৃন্দ তাদের প্রতিশ্রুত কর্মপন্থা বাস্তবায়নে তেমন আন্তরিক নয়। তাদেরই সৃষ্ট সংকট সমূহের কদর্য অভিঘাত দরিদ্র দেশগুলোকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সীমিত সম্পদের মধ্যে এতসব কঠিন পরিস্থিতির উত্তরণ দেশগুলোর জন্য প্রকৃতপক্ষে প্রায় অসম্ভব। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, বৈশ্বিক উদ্যোগ একনিষ্ঠভাবে কার্যকর করা না হলে উষ্ণতা বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান জলবায়ু–পরিবেশ সংকট পুরোবশ্বিকে লন্ডভন্ড করবেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়