জলবায়ু : সাধারণভাবে কোনো স্থানের ২৫–৩০ বছরের বেশি সময়ের আবহাওয়া অর্থাৎ বায়ু, তাপ, চাপ, গতি, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি আবহাওয়া উপাদানসমূহের গড়কে জলবায়ু বলা হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর এই পরিবর্তনই প্রকৃতি ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। আর জলবায়ুর পরিবর্তন কেবল বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। এটিকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। অন্যথায় জলবায়ু পরিবর্তন জীবজগতের বসবাসের অনুপযোগী হওয়ার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়– ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর কাছে বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ : আমরা জানি, পৃথিবীতে প্রতিদিন যে সূর্যকিরণ পতিত হয় ভূপৃষ্ঠ তা শোষণ করে নেয়। শোষিত সূর্যকিরণ আবার মহাশূন্যে বিকিরিত বা প্রতিফলিত হয়। প্রকৃতির এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মের এই শোষণ বিকিরণ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলেই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। জলবায়ুর পরিবর্তন মূলত হয়ে থাকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা Global Warming নামে পরিচিত। এটিকে গ্রিনহাউসের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। এ জন্য দায়ী গ্যাসগুলো যেমন কার্বন ডাই–অক্সাইড, ক্লোরো–ফ্লোরো কার্বন, মিথেন, ওজোন, জলীয় বাষ্প প্রভৃতির অত্যাধুনিক ঘনত্ব বৃদ্ধিই জলবায়ুর পরিবর্তনকে শাণিত করে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন তথা উল্লিখিত ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ– ১) জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। ২) যানবাহনের অদন্ধীভূত কার্বন যেমন কার্বন মনোঙাইড, কার্বন ডাই–অঙাইড, সালফার ডাই– অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড। ৩) শিল্পকারখানা হতে নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যের স্তূপ। ৪) অপরিকল্পিতভাবে ব্যাপক হারে বনাঞ্চল ধ্বংস এবং বনভূমি এলাকায় বিস্তৃত দাবানল। ৫) ওজোন স্তর ক্ষয় এবং পরিবেশে তেজস্ক্রিয় দূষণের বৃদ্ধি। ৬) মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুত বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী (যেমন এয়ারকন্ডিশনার, প্রসাধন ও প্লাস্টিক সামগ্রী প্রভৃতি)। ৭) জনসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধি ও অসম বণ্টন। ৮) কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগ। ৯) এ ছাড়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের অন্যান্য প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তন : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। এ দেশের মাঝবরাবর অতিক্রম করেছে। ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া ও জলবায়ু প্রকৃতির ওপর অনেকাংশে নির্ভর নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে পৃথিবীর স্বাভাবিক আচরণ ও প্রাকৃতিক ভা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অধিক জনসংখ্যার চাপ, মানুষের গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর, প্রাকৃতিক ও শক্তি সম্পদের ওপর অধিক চাহিদা প্রাকৃতিক উপাদানের উপর প্রভাব ফেলেছে।জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন নগরের আলিশান চেহারার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে দগদগে ঘা।
আইপিসিসি–এর তথ্যানুযায়ী, ২০৩০ সালের পর এ দেশের প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ অনেক কমে যাবে। উপকূলীয় জোয়ার–ভাটার স্রোত, বন্যা, নদী ক্ষয়, লবণাক্ততার দ্বারা উপকূলীয় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। নদীর ক্ষীণ প্রবাহের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নদ–নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে, তীব্র বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি স্বাদুপানির মৎস্যসম্পদের নিদারুণ ক্ষতিসাধনও করবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে পূর্বের মতো দেশীয় মাছ এখন আর পাওয়া যাবে না। ‘মাছে–ভাতে বাঙালি ট্যাগটি আজ আর সেভাবে উচ্চারিত হতেও দেখা যায় না। বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাংশের উপকূলীয় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার প্রায় ১৩% কৃষিজমি লবণাক্ততার শিকার হয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১৬% এবং ২১০০ সাল নাগাদ তা ১৮%-এ পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ ঝুঁকি এলাকা বা দেশগুলোর একটি, যার মূলেও রয়েছে জলবায়ুর এই ব্যাপক পরিবর্তন। এ ছাড়া ধারণা করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে ৩০ শতাংশ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বন ও জলবায়ুবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে ১২৫টির মতো বৃক্ষ প্রজাতি বিপন্নপ্রায় এবং ৩৯ প্রজাতির প্রাণী হুমকির সম্মুখীন। জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে সর্বাঙ্গীনভাবে বিবেচনায় রেখে অন্তত আমরা গাছ লাগাব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশদূষণ, খাদ্যাভাব, কর্মসংস্থানের সংকটসহ প্রভৃতি নানা সংকটের আবর্তে পৃথিবী এমনিতেই নিপতিত। সর্বোপরি, উষ্ণায়ন এবং তৎসৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে–এ কথা বলা বাহুল্য।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, আরকেএস ফাউন্ডেশন