জলবায়ু ন্যায়বিচার ও পরিবেশগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ

তাহমিনা সানজিদা সাহীদ | বৃহস্পতিবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

জলবায়ু পরিবর্তনে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে সম্প্রতি একটি জাতিসংঘের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। গবেষণা বলছে, জলবায়ুর পরিবর্তনে যে মানুষজন বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদের আশি শতাংশই নারী।

পরিবারের সদস্যদের যত্ন আর খাবারের মতো দায়িত্ব তারা নেয়ায় বন্যা এবং খরায় তারা আরো বেশি সংকটে পড়েন। এ কারণে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে এই নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

গবেষণায় জানা যাচ্ছে, এটা শুধুমাত্র প্রান্তিক এলাকার লোকজনের সমস্যাই নয়। সারা বিশ্বেই নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম ক্ষমতা ভোগ করছেন এবং বেশি দারিদ্রের মুখোমুখি হচ্ছেন। চাকরি, আশ্রয় বা অবকাঠামোর অভাব দুর্যোগ এই নারীদের আরো বিপদে ঠেলে দেয়।

অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৪ সালের সুনামির পর যেখানে তিনজন পুরুষের বিপরীতে একজন নারী রক্ষা পেয়েছেন। কারণ জানা না গেলেও, সারা বিশ্বেই একই ধরণের উদাহরণ দেখা গেছে।

সম্প্রতি নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ পরিচালিত ‘তৃণমূল মানুষের কথা: স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফলে জানা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে নারীর স্বাস্থ্য ও জীবনজীবিকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। গত কয়েক দশকে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যে উষ্ণায়ন, পরিবেশের বিপন্নতা তার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর।

পানির স্তর নিচে নেমে যায়, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, দুইএকটি নলকূপে, যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা না হলে কলসি নিয়ে পানির খোঁজে দীর্ঘপথ হাঁটা। জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে নারীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যেতে হয়। শুধু খাওয়ার পানিই নয়, সংসারে সবকিছুর জন্য যে পানি সেই পানি সংগ্রহ করার দায়িত্বও নারীর। তাই সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় নারীকে সামনে দাঁড়াতে হয়।

এদিকে সুপেয় পানির জন্য ধুঁকছে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। পাহাড়ে বসবাসের কারণে সারা বছর এসব গ্রামবাসীকে স্থানীয় ঝিরিঝরনার পানির ওপর নির্ভর হয়ে জীবনধারণ করতে হয়। ঘরের সব কাজসহ পানের জন্য ব্যবহার করা হয় এ পানি। সাধারণত বর্ষার সময় থেকে শীত মৌসুম পর্যন্ত ঝিরিঝরনা থেকে পানি সংগ্রহ করা গেলেও মাঘফাল্গুন থেকে পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। সরকারের উদ্যোগে দুর্গম কিছু কিছু পাহাড়ি গ্রামে রিংওয়েল ও টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও শুকনো মৌসুমে এসব থেকে পানি মিলছে না। গ্রামবাসী আশপাশের নিচু জায়গায় তৈরি করা কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করলেও শুকনো মৌসুমে এসব কুয়াও যাচ্ছে শুকিয়ে।

এমন পরিস্থিতিতে গ্রীষ্মের দাবদাহে ঘর্মাক্ত হয়ে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে অনেকে কাপ্তাই হ্রদ থেকে পানি সংগ্রহ করছে, আবার কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে পাশের গ্রাম কিংবা হ্রদ থেকে পানি সংগ্রহ করছে। পানি সংগ্রহের কাজটি করতে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের। এ যেন এক কলসি ঘামের দামে এক কলসি পানি সংগ্রহ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, একসময় সারা বছরই ঝিরিঝরনার পানির ওপর নির্ভরশীল থাকলেও নির্বিচারে বন উজাড় ও পাথর উত্তোলন, সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং সেগুনগাছের আধিপত্যসহ আরও নানান কারণে প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে জলবায়ু পরিবর্তনও সুপেয় পানির উৎস কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ।

অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে ফসল হয় না। কাজের খোঁজে পুরুষকে ঘর ছাড়তে হয়। মেয়েরা রয়ে যায় সন্তান, বয়স্কদের দেখে রাখার দায়িত্বে। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তার। পুরুষ না থাকায় নিরাপত্তাহীনতাও তার। অরক্ষিত জীবন। তারপর হয়তো কখনো গ্রামও ছাড়তে হয়। শহরে বস্তিতে এসে ইটভাটা আর পোশাক কারখানার শ্রমিক হতে হয়।

উপকূলীয় জেলা খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নারীদের করুণ জীবন গাথা খুবই করুণ। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে চুল ও ত্বকের ক্ষতি হয়। রং কালো হয়ে যায় ও দ্রুত বার্ধক্য চলে আসে। এছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। সেখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য ভাটার সময় ভোরে ও দিনের বেলায় ফলে প্রায় ৭৮ ঘণ্টা তাদের লবণাক্ত পানিতে থাকতে হয়। এর ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ নারী অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন।

লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা এখন জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের নারী। নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লবণাক্ততাপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি। সে জন্য অল্প বয়সেই এ এলাকার নারীরা জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে জরায়ুসংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ছে। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার গর্ভবতী নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্তি লবণাক্ত পানি গ্রহণের ফলে নারীদের জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেয়ার হার বেড়েছে। এছাড়া নারীরা দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ, গোসল, কৃষি কাজ, গবাদিপশু পালন, চিংড়ির পোনা ধরাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নারীরা লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বিবেচনা করে সুপেয় পানি এবং টেকসই জীবনজীবিকার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

নারীকে পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় যত বেশি সংযুক্ত করা যাবে, আমরা তত বেশি লাভবান হবো। কারণ নারীরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি ও নাজুকতার মধ্যেও দুর্যোগকালীন তার দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে যান। তাই টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে উপকূলের নারীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচী নিতে হবে।

২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। উপকূল ও পাহাড়ি নারীদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বৈরী পরিবেশের ঝুঁকিতে রেখে কিভাবে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। টেকসই উন্নয়নে জেন্ডার সমতার কোন বিকল্প নেই ।

কিন্তু বাস্তবে উপকূল ও পাহাড়ি নারীদের সমতা দূরের কথা, এখনো স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে নারী স্বাস্থ্যর ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানী ডায়ানা লিভারম্যান বলছেন, ‘বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যাতে সব বড় সিদ্ধান্তে তাদের অংশগ্রহণ থাকে।‘ ‘কারণ জলবায়ু পরিবর্তন ক্ষমতার কোন লড়াই নয়, এটা টিকে থাকার লড়াই।’

তাই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই জলবায়ু ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করতে পরিবেশগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সরকারি বেসরকারিভাবে নারীদের আরো কার্যকর অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনীরব দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে কথকতা
পরবর্তী নিবন্ধআজাদীর পাতায় পাতায় এখনো শৈশবের শিউলি আর কামিনীর সুঘ্রাণ