এ লেখার একটা অংশ স্মৃতি ও শ্রুতি নির্ভর হওয়ায় এখানে অসম্পূর্ণতা বা ত্রুটি থাকলেও থাকতে পারে। তবে এটাকে কোনো অবস্থায় বিকৃতি বা বিচ্যুতি বলা উচিত হবে না। কারণ অসম্পূর্ণতা বা ত্রুটিটুকু একেবারে অনিচ্ছাকৃত। ইতিহাসের ছাত্ররা ইতিহাস রচনার সময় জানি, ক্রস চেকিং করে। এক্ষেত্রে কোথাও কোথাও সম্ভব হলেও সব ক্ষেত্রে পারা যায়নি।
ইতিহাসের ছাত্ররা ইতিহাস রচনায় পুরোপুরি আবেগ বর্জিত থাকেন। আমার ক্ষেত্রে তাও সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হয়নি, কারণ আবৃত্তি সংগঠন বোধন আমার আত্মার আত্মীয়। এর স্থান হৃদয়ের অনেক গভীরে। এ সত্য শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, বোধনের প্রায় প্রতিটি ছেলেমেয়ের জন্য সত্য। আমি বোধনকে হৃদয়ে ধারণ করি। যেমন ধারণ করি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে; মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদকে। এ জাতির চেতনার নিশান বাংলাদেশের ঐ লাল সবুজ পতাকাকে। যেমন ধারণ করি, আমাদের অস্তিত্বের প্রকাশ ঐ শহীদ মিনারকে।
বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের আবৃত্তি অঙ্গনে প্রাচীনতম সংগঠন হলেও আমার জল–জোছনার শহর, আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামে আবৃত্তি চর্চার ইতিহাস আরও অনেক বছরের পুরাতন। বোধন যেহেতু অতীতের সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসের উত্তরসূরি। এরই মধ্যে বোধন চট্টগ্রামের আবৃত্তি চর্চার ইতিহাসে শুধু না, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিজের আসন দৃঢ় করে নিয়েছে। তাই বোধনের ইতিহাস অতি অবশ্যই বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চার ইতিহাস। তাই চট্টগ্রামের আবৃত্তি চর্চার সেই প্রাচীনতম ইতিহাসের সঙ্গে বোধন আবৃত্তি পরিষদকে মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, মিলিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। বোধন নিজের মধ্যে আবৃত্তি চর্চার প্রাচীন সেই ইতিহাসকে ধারণ করে। হাজার বছরের লালিত প্রাচীন সেই ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হিসেবে ভবিষ্যতের পানে তাকাতে সংকল্পবদ্ধ।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই এ জনপদে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা রামায়ণ, মহাভারত, কাঁসাসুল আম্বিয়া, জঙ্গে কারবালা প্রভৃতি কাহিনী কাব্য সুর করে আবৃত্তি করতেন, যা কিনা আজকাল পুঁথি পাঠ নামে পরিচিত। সেসব অগ্রজ আবৃত্তি শিল্পীরা বর্তমানে বিস্মৃত প্রায়। সে পর্বের কোনো কুশীলবের কথা এখন আর জানা নেই।
আমার জল–জোছনার শহর, আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামে গত শতকের প্রথম দিকে বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, পূর্ণেন্দু পত্রী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আগমন এবং কবিকণ্ঠে আবৃত্তি পরিবেশন এখানে আবৃত্তি চর্চার দৃঢ় বুনিয়াদ নির্মাণে প্রভাব বিস্তার করে। এ ক্ষেত্রে ‘চট্টগ্রাম ১৯৪৩’ কবিতাটি সুকান্তের স্বকণ্ঠে আবৃত্তি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক পূর্ণেন্দু দস্তিদার, অ্যাডভোকেট সুখেন্দু গুহ গণজাগরণমূলক কবিতা আবৃত্তি করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ওই সময় শহর চট্টগ্রামের পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও আবৃত্তি চর্চা হয়েছে। এ ধারার একজন হলেন আনোয়ারার শৈলবাসিনী চক্রবর্তী (দিদিমনি)। ইতিহাসের এ পর্যায়ে আরও অনেকের নাম আমাদের নির্মম অবহেলায় আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।
দেশভাগের পর পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রামে আবৃত্তিচর্চায় সম্পৃক্ত হন অধ্যাপক যোগেশ সিংহ, অধ্যাপক আবু হেনা তালুকদার, অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী, সাদেক আলী, মাহবুব হাসান, সাদেক নবী, আবদুল জব্বার, ডা.এস.পি. তালুকদার, মাহবুব–উল–আলম চৌধুরী, কাজী হাসান ইমাম, মনি ইমাম, ডা.কামাল এ খান, মৃণাল সরকার, অ্যাডভোকেট চিত্তরঞ্জন দাশ, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, অরুণ দাশগুপ্ত প্রমুখ। তবে এ সময় এমন কি পরবর্তীকালে মূলত নাটকের শিল্পীরা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করতেন। তাঁরা প্রধানত মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং কদাচিৎ সুকান্ত, জসীমউদদীনের কবিতা আবৃত্তি করতেন। জসীমউদদীনের কবিতার মধ্যে ‘কবর’ কবিতাটি বেশি আবৃত্তি হতো বলে শুনেছি।
গত শতকের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৫২’র ভাষা আন্দোলনের উপর রচিত প্রথম কবিতা মাহবুব–উল–আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ প্রায়ত রাজনীতিবিদ চৌধুরী হারুন উর রশিদ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আবৃত্তি করেন। এজন্য তাঁকে পুলিশী নির্যাতনও সহ্য করতে হয়। এ জনপদেও আবৃত্তি চর্চার ইতিহাসে এটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
গত শতকের ৬০’র দশকে একুশের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে আবৃত্তিচর্চার ধারা আরও বলিষ্ঠ এবং বেগবান হয়। এসময় বাঙালি স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৬০ দশকের উত্তপ্ত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে আবৃত্তি চর্চার মাধ্যমে আইয়ুবী দুঃশাসন হটানোর সংগ্রামে আরও যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন: প্রণব দাশগুপ্ত, জওশন আরা রহমান, অমিত ছন্দ, রণজিৎ রক্ষিত, মেজবাহ খান, মোস্তফা ইকবাল, রফিক ভুঁইয়া, এ.কে.এম.আসাদুজ্জামান, শফি কামাল, অজিত চক্রবর্তী, ফজল হোসেন, মাহবুবুল হক, সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদ, অলক দত্ত, প্রদীপ খাস্তগীর, পরিতোষ কানুনগো, সরোজ কুমার বল প্রমুখ। ৬০’র দশকে আবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অতি সাম্প্রতিক আমরা’, ‘সংস্কৃতি সংসদ’, ‘অনেক সূর্যের আশায়’, চট্টগ্রাম কলেজের ‘ইউ.এস.পি.পি.’, ‘যাত্রিক’, ‘জাগৃতি’, চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ‘অভিযাত্রী’, ‘অগ্রণী’, ‘মশাল’, ‘নবারুণ’ এবং চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ‘দিশারী’, কানুনগোপাড়া বান্ধব পাঠাগার, কানুনগোপাড়া নবারুণ সাহিত্য সংসদ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক সংগঠনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। সামরিক শাসনের বিধিনিষেধ এড়িয়ে সে সময় ছাত্রসংগঠনের সাংস্কৃতিক শাখা হিসাবে কয়েকটি সংগঠন কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর মধ্যে উদীচী, খেলাঘর, শাপলা কুঁড়ির আসর, আমরা পলাশ, কচি কাঁচার আসর প্রভৃতি জাতীয় সংগঠনগুলোর শাখাসমূহও সরব ছিল। এ সময় শহর চট্টগ্রাম এবং গ্রাম অঞ্চলেও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের তৎপরতা, শিক্ষা বোর্ডের উদ্যোগে স্কুল কলেজে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে আবৃত্তি প্রতিযোগিতা আবৃত্তি চর্চায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
গত শতকের ৭০ দশকের উত্তাল মূহূর্তে আমার জল–জোছনার শহর, আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামের আবৃত্তি চর্চার সঙ্গে যুক্ত হলেন কাজী আরিফ, সুদীপ দেওয়ানজী, জাকারিয়া মামুন, অভিক ওসমান, খালিদ আহসান, অঞ্জন দাশ, এনায়েত হোসেন, রশীদুল আনোয়ার, ফয়েজুল মতিন, নাজমুজ্জামান মাসুম, সৈয়দ আলমগীর কবির, কর্মসূত্রে চট্টগ্রাম অবস্থানকারী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রমুখ।
স্বাধীনোত্তর সময়ে আমার জল–জোছনার শহর, আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামের আবৃত্তিতে আমরা যাঁদের পেলাম, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলো: শান্তনু বিশ্বাস, সনজীব বড়ুয়া, রবীন ঘোষ, শুল্কা সেনগুপ্তা, অঞ্চল চৌধুরী, ডা.রাগীব মনজুর প্রমুখ।
৭০ দশকের শেষভাগে এসে আমার জল–জোছনার শহর, আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামের কয়েকজন নাট্যকর্মী ‘আবৃত্তি পরিষদ’ নামে একটি আবৃত্তি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে ডা. রাগীব মনজুরের একক আবৃত্তির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য এটা ছিল চট্টগ্রামের প্রথম একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান। এরপরে ‘আবৃত্তি পরিষদ’ আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি আবৃত্তি অনুষ্ঠান করে। তারপর সংগঠনটির আর কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে গোটা ৭০ দশকের তৎপরতাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আবৃত্তি চর্চার উদ্যোগসমূহ ব্যক্তি চর্চা বা ব্যক্তিগত উদ্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও পর্যন্ত দলগত বা নিয়মিত কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে সেদিনের অনেকেই আজ আর আবৃত্তি চর্চার সঙ্গে যুক্ত নেই।
চট্টগ্রামে আবৃত্তি শিল্পকে সাংগঠনিক কাঠামোর আওতায় এনে নিয়মিত চর্চা শুরু হয় ৮০ দশকের শুরুতে। এ সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রগতিশীল শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সম্মিলিত উদ্যোগে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হয় আবৃত্তি সংগঠন ‘অভিব্যক্তি’। কিন্তু এর কার্যক্রম ক্যাম্পাসভিত্তিক হওয়ায় এর প্রভাব শহর চট্টগ্রাম বা বাইরে কোথাও তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। মূলত ১৯৮৭ সালের ৯ জানুয়ারি ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’ এর আত্মপ্রকাশের পর চট্টগ্রামে দলগত এবং নিয়মিত আবৃত্তি চর্চার ব্যাপক আয়োজন পরিলক্ষিত হয়।
একলব্যের মতো আবৃত্তির শিল্পিত চেতনার আরধনায় স্থির ও অবিচল থেকে ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’ ১৯৮৭ সালের ৯ জানুয়ারি যখন হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির সংগ্রামী কাফেলায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে, তখন চট্টগ্রামে আবৃত্তিশিল্পী বলতে বুঝাতো কয়েকজন প্রবীণ নাট্যজনকে। ‘অভিব্যক্তি’র কথা মনে রেখেই বলছি, আবৃত্তি সংগঠন বলতে তখন সে একা। তাই ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’ আত্মবিস্মৃত ও আত্মহননকারী এ সমাজে বন্ধনহীন উন্মুক্ত ঝরণার মতো উদ্দাম বেগে এগিয়ে যেতে পারেনি। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে এ জনপদের আবৃত্তি অঙ্গনকে স্বাধীন সত্তার উপর দাঁড়িয়ে মুক্ত অভিব্যক্তি স্ফুরণে এক জঙ্গম ক্ষেত্রে পরিণত করতে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ফলার উপর বেড়ে ওঠা ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’ নামের সংগঠনটিকে সচেতন পদক্ষেপে আবৃত্তি চর্চা করতে হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যজন