কতদিন-মাস-বছর হলো মা-বাবাকে দেখি না। মা-বাবার বরাভয় আশীর্বাদ হাত আর মাথায় পড়ে না! বাবা গত হয়েছেন আগে, তারপর মা। কবি আল মাহমুদ একবার এরকম বলেছিলেন-পরলোকে তাঁর অন্যতম চাওয়া, তাঁর মায়ের দেখা পাওয়া। স্বর্গলোকে আত্মীয়-পরিজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়-মহাভারতেও এরকম সচিত্র ধারণা দেওয়া হয়েছে। আসলে হয় কি?
কয়েক হাজার ধর্মমতের মধ্যে জনসংখ্যা ও প্রাচীনত্বের নিরিখে প্রধান কয়েকটা ধর্মের মতামত পড়ে মিল অমিল দুই-ই পরিলক্ষিত হয়। ইউটিউবে এ সময়ের নামী-দামী ধর্মতাত্ত্বিক বয়ান-বুলি প্রচুর শোনা যায়। স্বর্গলোক-চির বসন্তের অপ্রাকৃত সুখ-ভোগের স্থান। নরক তেলের কড়াইয়ে সিদ্ধ-দগ্ধ করা ভয়ংকর শাস্তির জায়গা। বিদেহী আত্মা পাপ-পুণ্য নিত্তির বিচার শেষে পরলোকে নানা স্তরে প্রেরিত হয়। আমাদের শৈশব কানে এসব ধারণা প্রবিষ্ট করানো হয় লোককাহিনী কিংবা পাঠ্য-ধর্মপুস্তকের কালো অক্ষরে সাজিয়ে। যেসব ধর্মমতে পুনর্জন্ম বিধান স্বীকৃত-সেখানে পুরাতন বস্ত্র ছেড়ে নতুন বস্ত্র পরিধানের মতো আত্মার নতুন জন্মে নতুন শরীরে প্রবেশ। কারো কারো বিশ্বাসে তা ঘটে স্বাভাবিক মৃত্যুর কয়েকদিনের মধ্যে। শহিদ ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়ে গাওয়া ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি…’ গানে দশমাস দশদিন পরে ‘জন্ম নেবো মা মাসির কোলে’ পুনর্জন্মের সেই ভাবনা বাঙালি মননের সরল উপস্থাপন।
একটা ধারণা মতে, প্রষ্ফুটিত ফুলে লেগে থাকা গন্ধের মত ইহলোকের যাবতীয় কর্মফল আত্মা বাহিত হয়ে পরলোকে যায়। সেখানে প্রাপ্ত কর্মফল অনুযায়ী সুখ বা দুঃখ ভোগ ঘটে। তবে মহান পুণ্যাত্মারা, জন্ম-মৃত্যু চক্র ভগ্ন করে দিব্যানন্দ নির্বাণ প্রাপ্ত হন। এ-ও উল্লেখ আছে-আত্মা স্বভাবত-ই অমর ও নিঃসঙ্গ।
যদি তাই হয়, তবে পরলোকে মা-বাবার সাথে পুনর্বার দেখা হওয়ার সংশয় থেকে যায়। আজ সঘন সজল মনে পড়ে-তাঁদের একাকিত্বের দিনগুলোতে সযন্ত খোঁজের ঘাটতি ছিল। নিজ ক্যারিয়ার ব্যস্ততা, অহর্নিশ সংসার-পরিবার চিন্তাচ্ছন্ন থেকে কত কথা মাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। সে আমাকে প্রথম কোলে নেওয়ার অনুভূতি, আমার বুদ্ধি হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রথম সন্তানের সুখাসুখ নিয়ে তাঁর আনন্দ ফাগুন-দুঃখবিন্দু বারি-ভালবাসার অতলস্পর্শী সমুদ্র কথন। আরও কতো কথকতা-তাঁর বুকে মাথা রেখে সকৌতুহলে আনন্দস্নানে-অশ্রুজলে ভেসে-শোনা জেনে নেওয়া বাকী! বাবার পাশে একান্তে বসে তাঁর মনোবাঞ্চা কিংবা কোনো কিছু বলার ছিল কিনা জানা হয়নি।
আমাদের সাধারণ মানসে মৃত্যুভয় প্রতিমুহূর্তে বিভীষিকা জাগানিয়া। যেখানে রবীন্দ্রনাথ মাত্র আঠার বছর বয়সে “মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান…” অকুতোভয় সাহসী পংক্তিতে মৃত্যুকে সম্ভাষণ করছেন। “কোন তারাটি আমার” ঋদ্ধ ভাবনাযুক্ত “সন্মুখে শান্তি পারাবার… ” গানে বলে গেলেন-“মর্ত্যের বন্ধন হয় যেন ক্ষয়, বিরাট বিশ্ব বাহু মেলে লয়”। ‘পৃথিবীতে সুখী কে? আশ্চর্য কী? পথ কী? বার্তা কী? ধর্মবক এর চারটি গুঢ়ান্বেষী প্রশ্নোত্তরে আশ্চর্য কী? বিষয়ে রাজা যুধিষ্ঠিরের উত্তর ছিল-“প্রত্যহ প্রাণীগণের মৃত্যু হচ্ছে, তবু অবশিষ্টেরা চিরকাল বাঁচতে চায়, এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে”? এবং বার্তা কী প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন : “সূর্যের আগুনে, দিন-রাত্রির ইন্ধনে, মাস ও ঋতুর হাতা দিয়ে নেড়ে-নেড়ে, কাল এই মহামোহময় কটাহে প্রাণীবৃন্দকে রন্ধন করছে: এ-ই বার্তা”।
মানুষ এতো যে অস্তিত্ব কাতর! নিজেকে হারাতে চায় না। তাই মৃত্যু ঘিরে ‘ওপারে ভালো থাকিস’- ফেসবুকে লেখে। অংকুর বৃক্ষও পরিণত ফুলে-ফলে একদিন চলে যায়। তরু বন্ধু-সভা কিন্তু স্ট্যাটাস দেয় না-হয়তো বিজ্ঞান চিন্তা মেনে। কেননা আমার জানা থাকলে বিজ্ঞান, না জানা হলে অ-জ্ঞান।
পাতার অংশ ফুল হয়ে ফোটে! সৌরভ মাখানো! ফুল থেকে অলৌকিক ফল! পাখির যাপিত শরীরে মধুকন্ঠ সুর! কোটি তারা কোষে বিভূষিত ব্রহ্মান্ড-বিধাতার সুন্দর অঙ্গদ! তারি ধূলিক্ষুদ্র মর্ত্য মাটির গোলকে মাতৃজরায়ুতে ভ্রুণাবস্থায় এককোষী অপার্থিব ‘এই আমি’র বিষ্ময় উদ্ভব! রিপু-ইন্দ্রিয় সুসজ্জিত শরীর বাস্তবে। মনে হয় ইন্দ্রজাল সিন্ধুতে ভাসে আলো-আঁধারের দিন-রাত্রির কাঠামো। প্রতি দন্ড-পল রহস্যের কুজ্ঝ্বটিকায় ঢেকে। এই কঠিন বাস্তবতা ও মায়াবিশ্বের আড়ালে লুকিয়ে কোন পরম সত্য!
অনন্ত কালস্রোতে এই কি ঘটে তবে একবারের পরিচয়! দারা-সন্তান-পরিবার-বন্ধু-বান্ধবী-প্রিয়াসুধা কেবল এক জন্মের নাট্যমঞ্চে একটা ঢেউয়ে এসে স্নেহ-মোহ-ভালোলাগা-ভালোবাসায় বিস্তারিত হয়ে জন্মের মত হারিয়ে যায়! তাহলে কাছের জনকে কেন সদাই বুকে বেঁধে রাখি না! তবে কেন এই হিংসা-দ্বেষ-ছদ্মবেশ! একশো বছরেরও কম গড় আয়ুপ্রাপ্ত মানুষ জাতিতে-ধর্মে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত। প্রথমাবধি। এখনো! তাতে মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন পাড়া-প্রতিবেশি শিশু-বয়স্ক কারো প্রতি সদয় কাংখিত সেবা মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না। পতিত মানবজমিন। জগত আনন্দযজ্ঞে না নিজে বাঁচে, না অন্যকে বাঁচায়।
বাঙালি সক্রেটিস নামে আখ্যায়িত জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এক জায়গায় লিখলেন-‘পৃথিবীতে জীবন নিয়ে দুটো ভিন্ন মত আছে। প্রথমটা-এই জন্মটাই একমাত্র জন্ম, দ্বিতীয়টা হলো মৃত্যুর পরে আমাদের আরও জীবন গ্রহণ করতে হতে পারে’। মীমাংসাটা যদি জানা যেতো জীবন থাকতে! তবে এ দুই চিন্তার যাই ঘটুক না কেন, মাটির পৃথিবীর ঘরে আমার যে মা-বাবা তাঁদের সাথে আর কি কখনো দেখা হবে!
লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।