বৈশাখের মাঝামাঝি। ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। জনস্বাস্থ্যখাতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব কেন চীন দেবে সেটাই আমাদের আজকের আলোচনা। প্রথমেই দেখা যাক বর্তমানে পৃথিবীতে বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ কোনটি? একটানা পঞ্চম বছরের জন্য চীন ২০১২ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল। এটি বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৩০.১ ট্রিলিয়ন ডলারের ২২.৫ ট্রিলিয়ন বা ১৭.৩ শতাংশ অবদান রেখেছিল। ২০.৫ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৫.৮ শতাংশ নিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্ব জিডিপিতে ১৯.৯ ট্রিলিয়ন বা ১৫.৩ শতাংশ অবদান রেখে তৃতীয় স্থানে ছিল। ২০১৯ সালে ৯.২ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে ভারত চতুর্থ স্থানে, জাপান ৫.২ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে পঞ্চম স্থানে ছিল। অতএব চীন বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
এবারে দেখা যাক বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশ কোনটি ? গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত দুই দশকে বিশ্বের সম্পদ তিনগুণ বেড়েছে। ২০০০ সালে চীনের মোট সম্পদ ছিল ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২০ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ ট্রিলিয়নে। দুই দশকে বিশ্বের যে পরিমান সম্পদ বেড়েছে, তার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই চীনের। সুতরাং বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশ এখন চীন, যুক্তরাষ্ট্র নয়।
বিশ্ব জুড়ে চীন নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে। ট্রাম্প সহ পশ্চিমা নেতারা যখন করোনা পরিস্থিতির জন্য চীনকে দোষী সাব্যস্ত করছিল, সেখানে অন্যান্য দেশ তখন চীনের সহায়তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার বিভিন্ন গ্রুপ ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চীন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছিল এবং বেল্ট এন্ড রোডের সংগে যুক্ত ৭০টি দেশ এতে বিশেষ সুবিধা লাভ করছিল। স্বাস্থ্যখাতের সংকটে চীনের সাথে বিভিন্ন দেশের যোগাযোগ বাড়ছিল।
বর্তমানে দেশে দেশে চীনের চিকিৎসা সামগ্রী ও অনুদানের চাহিদা বাড়ছে। এ প্রসংগে উল্লেখযোগ্য ‘‘সার্বিয়ার প্রেসিডেন্টের উক্তি, ‘চীন একমাত্র দেশ যারা আমাদের সাহায্য করতে পারে’ [প্রথম আলো, ০৭–০৫–২০]।’’ পুরো ইউরোপ যখন ইতালীকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তখন বিপুল পরিমাণ মেডিকেল কীট নিয়ে এগিয়ে এসেছিল বেইজিং।
বর্তমানে চীন চারটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা খাতে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। উক্ত ক্ষেত্রসমূহ হলো–পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, প্রকৌশল প্রযুক্তি ও কম্পিউটার বিজ্ঞান। কৃষি বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং জৈব রসায়ন এবং পরিবেশ ও পরিবেশ বিজ্ঞান সহ আরও ১০ টি ক্ষেত্রে চীন দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেছে। ২০২০ সালে চীন প্রকৃতি, বিজ্ঞান এবং কোষসহ বিশ্বের শীর্ষ ১৫ টি গবেষণামূলক প্রকাশনায় ১৮৩৩ টি গবেষণাপত্র এবং নিবন্ধ প্রকাশ করে। এই কৃতিত্ব চীনকে ২০১৯ সালের তুলনায় র্যাংকিং এ দুই ধাপ এগিয়ে দেয়। এতে ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে দ্বিতীয় অবস্থানে পৌঁছায় চীন। ২০২০ সালে চীনা বিজ্ঞানীরা ১৬৯টি দেশ ও অঞ্চলের সহযোগীদের সাথে প্রায় ১৪৪৫০০ টি বৈজ্ঞানিক গবেষণা যৌথভাবে লেখেন যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৪৪০০ টি বেশি। চীনের মোট সহ–প্রকাশনার সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে ১১.১ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে চীনের বৃহত্তম অংশীদার। গত ৪০ বছর ধরে এআই প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। চিত্র সনাক্তকরন,কন্ঠ সনাক্তকরন সহ বিভিন্ন প্রযুক্তিতে চীন বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। এ আই প্রযুক্তির পেটেন্টের আবেদনের সংখ্যার দিক দিয়েও বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে চীন।
এবারে দেখা যাক এককেন্দ্রিক বিশ্বে চীন কেন সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে। প্রথমতঃ চীন করোনা পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। ‘‘উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটলে চীন অত্যন্ত দক্ষ হাতে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল। কেননা ভাইরাসটি চীনের অন্য কোনও শহরে ছড়িয়ে পড়েনি। পরিসংখ্যান বলছে, উহান থেকে বেইজিং এর দূরত্ব ১১৫২ কি.মি, সাংহাইয়ের দূরত্ব ৮৩৯ কি.মি। অন্যদিকে নিউইয়র্কের দূরত্ব ১৫ হাজার কি.মি, ইতালীর দূরত্ব ৮৬৯৫ কি.মি, ইরানের ৫৬৬৭ কি.মি.। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি । কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হলো করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে [ যুগান্তর, ১২–০৪–২০ ]।”
দ্বিতীয়তঃ চীন বিভিন্ন দেশের প্রতি করোনা মোকাবেলায় সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছিল। ‘বিশ্ব্ে যত মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন তার ১১ শতাংশের বেশি দক্ষিণ এশিয়ার। মৃতের ৬ শতাংশও এ অঞ্চলের। এ অঞ্চলের মানুষকে কোভিডের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক ক্ষতিতে পড়তে হয়েছে। দেশগুলোর স্বাস্থ্যখাতও এ মহামারী মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে চীন এই পরিস্থিতিতে দেশগুলোকে ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে। ঋণ দিয়ে সাহায্য করেছে [ মানবজমিন,০১–০৬–২১ ] ।”
তৃতীয়তঃ যদিও চীন যেভাবে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে তার স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ আছে, তথাপি অন্যান্য আক্রান্ত দেশের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করায় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দোষারোপের খেলা থেকে নিজেদের আলাদা করতে পেরেছিল।
চতুর্থতঃ পৃথিবীকে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় যে খেলা যায় তারই নিদর্শন হয়তো স্থাপন করলো চীন। প্রথম সনাক্ত ও মৃত্যুর পরেও স্বাভাবিক গতিতে চলেছে চীনের অর্থনীতি। অনেকেই ধারনা করেছে যে কোভিড–১৯ ল্যাবরেটরীতে প্রতিপালিত একটি ভাইরাস। পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে শাসন চালানোর হাতিয়ার হিসাবে এটি ব্যবহৃত হয়েছিল।
এবারে দেখা যাক এককেন্দ্রিক বিশ্বে অন্যান্য পরাশক্তি এবং জাতিসংঘের অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে রাশিয়া নিজেদের একেবারেই গুটিয়ে নিয়েছিল। জাতিসংঘ আস্থা হারিয়েছিল। কারণ ট্রাম্পের বিবিধ কার্যকলাপে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহ গুরুত্ব হারাচ্ছিল। ন্যাটোর কার্যকলাপ নিয়ে বারংবার প্রশ্ন তুলে যাচ্ছিল ট্রাম্প।
ডাব্লিউটিএ কে পাশ কাটানো হচ্ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের গুরুত্ব হারানোর ফলে পৃথিবীতে নেতৃত্বের সংকট তৈরী হচ্ছিল।
দেখা যাচ্ছে চীন বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রন নিতে চাইছে। প্রথমত ‘২০০০ সালে জাতিসংঘের মোট বাজেটের মাত্র ১ শতাংশের জোগান দিতো চীন। কিন্তু এখন তা দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে। জাতিসংঘের ১৫ টি বিশেষায়িত এজেন্সির ৪টির প্রধানের পদ এখন চীনের দখলে। যুক্তরাষ্ট্রের দখলে আছে মাত্র ১ টি [ প্রথম আলো, ২৮–০৬–২০ ]।’
দ্বিতীয়ত আঞ্চলিক রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরী করছে চীন। এশিয়ান ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ব্যাংক, ব্রিকস, বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রভৃতির মাধ্যমে চীন শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। অথচ একসময় মার্শাল প্ল্যানের আওতায় এসব করতো যুক্তরাষ্ট্র।
বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সম্পর্কে সংক্ষেপে বলছি। এটি গণচীন সরকারের গৃহীত একটি উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো। এটির মূল অর্থ হচ্ছে এক অঞ্চল, এক পথ। চীনের রাষ্ট্রপতি শি চিনফিং দ্বারা প্রস্তাবিত এ কাঠামো; দেশসমূহ, বিশেষ করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং যে সমস্ত দেশ প্রধানত দুটি উপাদান যথা-(১)ভূমি–ভিত্তিক রেশম পথ অর্থনৈতিক বলয় বা সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট এবং (২)সামুদ্রিক রেশম পথ নিয়ে গঠিত সে সমস্ত দেশের সাথে অবশিষ্ট ইউরেশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার উপর জোর দেয়। এই কৌশল বিশ্বব্যাপী কূটনীতিতে চীনের একটি বড় ভ’মিকা নেয়ার পথ সুগম করে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগে আগ্রহী চীনা কোম্পানী। চীনের স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সাইনাফার্ম ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
উপসংহারঃ আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের সাথে চীনের সম্পর্ক নিবিড়তর হচ্ছে। কিন্তু বিশ্্ব মোড়লের তকমা পরিধান করে যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া পদক্ষেপসমূহ বাস্তবমুখী না হওয়ায় সহযোগী রা্ষ্ট্রসমূহের সাথে তার দূরত্ব বেড়ে চলেছে। এর পরিনাম হচ্ছে জনস্বাস্থ্যখাতে বৈশ্বিক নেতৃত্বের আসন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় হারিয়ে ফেলছে আর চীন সে আসনে আসীন হচ্ছে।
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক।