আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল এখন একটি জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। অত্যধিক লোভের বশবর্তী হয়ে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষের জীবনকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। গত ১লা ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘খাদ্যপণ্যের ভেজাল ঠেকাবে কে’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাবার তৈরিতে ফুডগ্রেড রংয়ের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে টেক্সটাইল কাপড়ের রং। এছাড়া কৃত্রিম ফ্লেভার মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম, মিষ্টি, পাউরুটি, বিস্কুট, দই, ললিপপ, চকলেট এবং কেক। শিশু খাদ্য গুঁড়ো দুধেও মিলছে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের উপস্থিতি। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় শাকসবজি, ফলমূল ও মাছ তরতাজা রাখতে ফরমালিন ব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বেগ পেতে হচ্ছে। খাদ্য ভেজালকারীদের কেবল জরিমানা না দিয়ে কারাদণ্ডসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কারণ ভেজাল খাবার তৈরি ও পরিবেশনের অভিযোগে প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালায় এবং ভেজালকারীদের জরিমানাও করা হয়। অভিযান শেষে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় এসব অসাধু ব্যবসায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রিত ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষের কিডনি বিকল, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগ হচ্ছে। এছাড়া দেশে খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার কোনো নজির নাই। ফলে তারা শুধু জরিমানার অংক গুণেই ফের একই কাজ করতে থাকে। মূলত এসব পণ্যের সহজলভ্যতা ও প্রশাসনের সঠিক নজরদারির অভাব এর জন্য দায়ী। ভেজালের সঙ্গে জড়িত লোকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যকে ভেজালমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধ হিসেবে প্রতিবেশী দেশ ভারত সরকার যাবজ্জীবন সাজা দিয়ে থাকে। এছাড়া চীনে মৃত্যুদণ্ড, পাকিস্তানে ২৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আমাদের দেশেও খাদ্যে ভেজাল মেশালে আইন আছে কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নাই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ২৫ লাখ ক্ষুদ্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়ী ও ১৮টি মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া দেশে প্রায় ৪৮৬টি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের অধীন প্রায় ১২০টি আইন ও নীতিমালা রয়েছে।
দেশে ক্ষুদ্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাদ্য ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগের পেশাগত জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ নেই। সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য একটি জাতীয় প্রত্যাশা। দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে যেন সবাই সহজে ও সুলভ মূল্যে খাদ্য পেতে পারে, সে জন্য সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
খাদ্যে ভেজালের সংবাদ আমরা প্রায়শই দেখে থাকি পত্রপত্রিকায়। এসবের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযানও চালানো হচ্ছে। আইনের আওতায় আনা হচ্ছে অপরাধীদের। তবুও থামছে না খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা।
খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে দেশের প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটকে (বিএসটিআই) আরো সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে দরকার কার্যকর ভূমিকা। ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হলে কিছুদিন ভেজালমুক্ত খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, কিন্তু পরে যেই–সেই হয়ে যায়। এর থেকে পরিত্রাণে আমাদের সমাজিকভাবেও নীতি–নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সৎ পন্থা অবলম্বন করতে হবে। নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সততা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার আলোকে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। ভেজাল প্রতিরোধে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবোধ, উৎপাদক, বিপণনকারী, ভোক্তা সবাইকেই সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে প্রতি বছর গড়ে দেশে প্রায় চার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে এবং অনেকে স্থায়ীভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফা এবং অধিক মেয়াদে সংরক্ষণের জন্য খাদ্যে ফরমালিন মিশ্রণ করে থাকে। খাদ্যে ভেজাল ও ফরমালিন মিশ্রণের বিরুদ্ধে যদিও অনেক আইন রয়েছে কিন্তু কেবল আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এটি সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। জনসম্পৃক্ততা ও সচেতনতার মাধ্যমেই কেবল এটি রোধ করা সম্ভব।